Header Ads Widget

Responsive Advertisement

পরকীয়া

 "স্ত্রী পরকী'য়ায় আসক্ত হয়ে চলে যাবার পর অতিথিকে বিয়ে করেছে নীল। অতিথির এটি প্রথম বিয়ে হলেও দেড় মাসের বিবাহিত জীবনটাকে রঙিন করে রাঙিয়েছে তাঁর স্বামী। স্ত্রীকে খুশি রাখতেই যেন তাঁর আর ফুরসত নেই। অতিথি বুঝতে পারে প্রথম স্ত্রী চলে যাওয়াতেই হয়তো তাঁর প্রতি নীলের যত্নের এই আধিক্য। নীলকেও যেন মায়ার বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে রেখেছে অতিথির মায়াময় নারী স্বত্ত্বা। যেন দুজনের মাঝে চলছে ভালোবাসার এক মিষ্টি প্রতিযোগিতা। কার ভালোবাসার পাল্লা যে ভারি তা যেন বাটখারা দিয়ে পরিমাপ করলেও পরিমাণের কোন ব্যত্যয় ঘটবেনা কোনভাবেই।



এতো কিছুর মাঝেও কিছু একটা অপ্রাকৃত অনুভূতি যেন হঠাৎ হঠাৎ নাড়িয়ে দিয়ে যায় অতিথিকে। নীলের কেনা ১৫০০ স্কয়ার ফিটের নতুন ফ্ল্যাটটাতেই তাদের নতুন সংসার। প্রথম স্ত্রী এই ফ্ল্যাটে ওঠার আগেই চলে গিয়েছিল এ সংসার ছেড়ে। তাই প্রথম স্ত্রীর স্পর্শ না থাকায় অতিথির এই ফ্ল্যাটটাতে কেমন একটা আরাম বোধ করে। কিন্তু যত বিপত্তি ওই গেস্ট রুমটা নিয়ে। এই রুমটাই যেন এক আকাশ স্বস্তির মাঝে এক টুকরো অস্বস্তির উপস্থিতি। অজ্ঞাত কারণে বিয়ের প্রথম থেকেই এই রুমটায় এলে অতিথি যেন কোনভাবেই টিকতে পারেনা। সবে ধন নীলমণি নীলের বাবা মা না থাকায় তেমন কোন আত্নীয় স্বজন এ বাড়িতে আসেন না বলে এই গেস্টরুমটাকে ছোট-খাট একটা লাইব্রেরি বানিয়েছে সে। গ্রন্থকীট নীলের নানা দেশের নানা লেখকের বইয়ে ঠাসা কাঁচে ঘেরা ছাদস্পর্শী আলমারিটাকে অসামঞ্জস্যভাবে বিভক্ত করেছে একটা পিলার। এই পিলারটাই যেন অসহ্য অনুভূতিকে প্রগাঢ় করতে বদ্ধপরিকর। অথচ এই পুরো ফ্ল্যাটে এই রুমটা নীলের সবচেয়ে পছন্দের। ছুটির দিনগুলোতে নীল খুব করে চায় অতিথির সাথে গল্প করতে করতে এই রুমটায় বসে চা খেতে। কিন্তু এখানে কয়েক মিনিট কিংবা কয়েক ঘন্টা তো দূরে থাক, কয়েক সেকেন্ডের জন্য এসে দাঁড়ালেও তাঁর পুরো শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে শুরু করে তা কি করে বোঝাবে সে নীলকে। বই পড়তে ইচ্ছে হলেও কোনরকমে বই নিয়ে এখান থেকে পালাতে পারলেই যেন সে বাঁচে। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন। এ সংসারে অতিথি তো আর শীতের পাখি নয়। নিজের বাড়িতে স্বস্তি নিয়ে থাকতে না পারলে চলবে কি করে। এই ভাবনাতেই এই বেখাপ্পা পিলারটায় একটা বড় আয়না কিনে টাঙিয়ে দিল সে। যাতে এই বইয়ের আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবির নিচে চাপা পড়ে যায় এই পরগাছাতুল্য পিলারের অসামঞ্জস্যতা। ঠিক সেই রাতেই ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখলো অতিথি। দেখলো দুপুরের খাবার খেয়ে গেস্টরুমে একটা বই আনতে গেছে। বেশ সময় নিয়েই প্রিয় একজন লেখকের একটা বই খুঁজে বের করলো সে। বইটা নিয়ে ফিয়ে আসতেই হঠাৎ ওর মনে হলো কেউ যেন পেছন থেকে অস্ফুটস্বরে তাকে ডাকছে। ফিরে তাকাতেই সে দেখলো এক নারী অবয়ব পিলারে সদ্য লাগানো আয়নার ভেতর থেকে আকুল হয়ে তাকে ডাকছে হাজার বছরের বন্দী দশা থেকে মুক্তির আশায়! ঠিক এই মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে গেল অতিথির। যে পিলারে তার এতো অস্বস্তি সেটা নিয়ে এই বীভৎস স্বপ্নটা যেন গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। এবার অতিথি ভাবলো, "নাহ্ এই গেস্ট রুম, এই পিলার নিয়ে বড্ড বেশি মাতামাতি করছি আমি। এভাবে চলতে থাকলে আমার নিজের বাড়ি, নিজের সংসার কোনকিছুই আর আমার থাকবে না। আমিতো নিজের ইচ্ছায় ভালোবেসে নীলকে বিয়ে করেছি। হয়তো এটা আমার প্রথম বিয়ে আর নীলের দ্বিতীয় বিয়ে বলেই আত্নীয় স্বজনরা নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল বলে আমি অবচেতন মনে ওসব নিয়ে অতিরিক্ত ভাবছি। আমাকে এবার ভুলে যেতে হবে অতীতের সব। আজ থেকে আমাকে ভাবতে হবে আমিই নীলের বর্তমান, আমিই ওর ভবিষ্যৎ আর ওর অতীত কি আমি জানিনা। ব্যস্ কাল থেকে আমার নতুন সংসার আমি আবার নতুন করে গোছাবো। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।"
নীলকে এই স্বপ্নের কথা বলে আর এই অযথা অস্বস্তি বাড়াতে চাইলো না সে। পাছে নীল যদি ভাবে যে সে হয়তো এই সংসারটাকে কোনভাবেই আপন করে নিতে পারছে না। বরং পরদিন থেকে সে নিজেকে এটাই বিশ্বাস করাতে শুরু করলো যে নীলের জীবনে সেই প্রথম নারী এবং তার সাথে এটাই নীলের প্রথম সংসার। আজ প্রথম অতিথি পুরোটা বিকেলটা একা একা গেস্ট রুমে বসে বই পড়ে কাটালো। সত্যি তার আর আগের মতো সেই অস্বস্তি লাগছে না। সে নিজের মনেই মুচকি হাসলো আর ভাবলো বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায় প্রবাদটির যথার্থই বলে লোকে। সারাদিন সে সংসারের টুকটাক কাজ করেই কাটিয়ে দিল। নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্বযুদ্ধ কাটিয়ে ওঠার প্রয়াসে আজ যেন হঠাৎ করেই এই সংসারটাকে আরও বেশি আপন মনে হতে লাগলো তাঁর। সন্ধ্যার দিকে নীল ফিরলো।
নীল- অতিথি একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম যে।
অতিথি- কিসের ঝামেলা?
- অফিসের কাজ আমাকে কাল ভোরেই খুলনা যেতে হবে তিন দিনের জন্য। আবার সেখানে স্ত্রীকেও নিয়ে যাওয়া যাবে না।
- যেতে হবে যাবে। এতে ঝামেলা কিসের?
- ওমা! ঝামেলা না। তুমি এই বাড়িতে একেবারেই নতুন। তার ওপর এই বিল্ডিংয়ে কাউকেই চেনো না। কোন বিপদ আপদ হলে কি করবে তুমি?
- এটা কোন ঝামেলা হলো নীল। আমি একা থাকতে মোটেই ভয় পাই না। আর তাছাড়া আমার সংসারে আমি নতুন হবো কেন। আর কাউকে চিনি না তো কাল গিয়ে চিনে নেব। এসব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না বুঝলে।
- শোন তুমি বরং কাল ভোরেই রাজশাহীতে তোমার বাবার বাসায় গিয়ে এ কদিন থেকে আসো।
- আচ্ছা তুমি কি পাগল হলে বলতো? রাজশাহী কি বাড়ির কাছের কথা যে ইচ্ছা হলো আর চলে গেলাম। আর আমি তো ইউনিভার্সিটিতেও তিন চারদিনের বন্ধ পেলে বাড়ি যেতাম না। হোস্টেলেই থেকে যেতাম। আর এটাতো আমার নিজের সংসার।
- তাহলে কি করবে?
- আহা এতো ভাবছো কেন বলতো? আচ্ছা আমার কথা শোন। এটা কি তোমার জীবনের শেষ ট্যুর। তোমাকে তো প্রায়ই এমন ট্যুরে যেতে হয়। আমি কি দুদিন পর পরই রাজশাহী যেতে পারবো? আমাকে তো একা থাকতে অভ্যস্ত হতে হবে তাই না? তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি যদি একা থাকতে না পারি তাহলে টিকিট কেটেই সোজা বাসায় চলে যাবো। খুশি?
এবার কিছুটা স্বস্তি পেল নীল। পরদিন খুব ভোরে উঠেই নীল চলে গেল। আজ আর তেমন কোন কাজ নেই ভেবে ইউনিভার্সিটির প্রিয় বান্ধবী প্রিয়ার সাথে সারাটা দিন টইটই করে ঘুরলো অতিথি। বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। ছোটবেলা থেকেই বেশ সাহসী স্বভাবের হওয়ায় এই তিন বেডের ফ্ল্যাটটাতে একা রাত্রিযাপন করতে তেমন কোন অসুবিধা হলোনা তাঁর। সিনেমাখোর অতিথি নেটফ্লিক্সে একটা সিনেমা দেখতে দেখতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সহসাই। ঘড়িতে ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট। অকস্মাৎ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুম থেকে জেগে উঠলো সে। এসির মধ্যেও ঘেমে নেয়ে একাকার। আবারও স্বপ্ন! স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন! সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন! একা এই ফ্ল্যাটে এই গভীর রাতে প্রচন্ড ভয়ে অতিথির প্রাণ ওষ্ঠাগত। কারণ সে হুবহু সেই স্বপ্নটাই আবার দেখেছে যে গেস্ট রুমে পিলারের ভেতর থেকে সেই নারী অবয়ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বন্দীশালা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায়। এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবছে কালই প্রিয়ার বাসায় যাবে সে। প্রিয়া এই তিনটা দিন ওর বাসায় থাকার জন্য এতো করে বলছিল আর এখন নিজের বেশি বোঝার জন্য নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ওর। বাকি রাতটা আর ঘুম হলো না ওর। এপাশ ওপাশ করতেই কানে ভেসে এলো ফজরের আযানের শব্দ। অতিথি ভেবেছিল সকাল সকালই চলে যাবে প্রিয়ার বাসায়। কিন্তু ভোরের আলো ফুটতেই ভয় যেন হুট করেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেল। তাই সে ভাবলো বিকেলেই যাবে বন্ধুর বাসায়। আজ বরং সে বিল্ডিংয়ের বাকি ফ্ল্যাটের সবার সাথে পরিচিত হবে। নীল থাকলে রান্নাবান্নার ঝামেলায় তো আর কোথাও যাবার সময় হয় না। আজ যেহেতু কাজ নেই তাই আজই যাবে সে।
সাত তলা বিল্ডিংটার নিচ তলার পুরোটাই গ্যারেজ। প্রতি তলায় এক ইউনিট বলে ওদের ফ্ল্যাট বাদে বাকি থাকে পাঁচটা ফ্ল্যাট। অতিথি প্রথমে গেল দুই তলায়। চল্লিশোর্ধ ভদ্রমহিলা ওকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনিই এ বাড়ির জমির মালিক।জমিটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে দেয়ায় তিনি এই বিল্ডিংয়ের তিনটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন। ভদ্রমহিলা খুবই অতিথিপরায়ণ। তিনি সাগ্রহে অতিথিকে পুরো বাসাটা ঘুরে দেখালেন। বাসা দেখতে দেখতে হঠাৎ অতিথি চোখ আটকে গেস্ট রুমের ঠিক সেই জায়গাটায়। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই জায়গাটা একেবারেই সমান। কোন পিলারের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। অতিথি বাধ্য হয়ে উনাকে প্রশ্ন করেই ফেললো শেষমেষ।
অতিথি: আচ্ছা এই জায়গাটায় কোন পিলার নেই কেন? আমাদের ফ্ল্যাটে তো এখানে একটা পিলার পড়েছে।
ভদ্রমহিলা: পিলার? কি বলছেন? পিলার আসবে কোত্থেকে? এখানে আমার ফ্ল্যাট তিনটা। আমার একটাতেও তো এখানে কোন পিলার নেই। বাকিগুলোতেও থাকার কথা না।
ভীষণ অবাক হলেও অতিথি আর কোন কথা বললো না। বরং উনার সাথে হাসি বিনিময় করে খুব দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রমহিলার বাকি ফ্ল্যাট দুটো বাদে অন্য দুটো ফ্ল্যাটে পরিচিত হবার ছুঁতোয় পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলো। সত্যিই তো কোন ফ্ল্যাটেই ওই অদ্ভুতকায় পিলারটা নেই। বাসায় ফিরে অতিথি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সে পাশের আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিং থেকে একজন রাজমিস্ত্রীকে দারোয়ানকে দিয়ে ডেকে আনলো। এবার চলছে পিলার ভাঙার কাজ। কেন এই পিলারকে নিয়ে ওর মনে এতো অস্বস্তি। কেন সে একই স্বপ্ন পরপর দুইবার দেখলো। কি রহস্য লুকিয়ে আছে এই পিলারের মাঝে। এই সব প্রশ্নের উত্তর ওকে জানতেই হবে আজ। খুব বেশি সময় লাগলো না। আনাড়ি হাতের ইঠের গাঁথুনি ভাঙতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রীর। পিলারের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কঙ্কাল। নীলের কাবার্ডে অতি যত্নে রাখা প্রথম স্ত্রীর সাথে ফ্রেমবন্দী মায়াময় ছবিতে তাঁর স্ত্রীর হাতের আংটির সাথে কঙ্কালের অনামিকায় আটকে থাকা হীরের আংটিটাও মিলে যাচ্ছে অবিকল!


ছোটগল্প।
লেখনীতে: সামান্তা স্বর্ণা।

Post a Comment

0 Comments