আরিজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। আজমাইন ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে আর বোঝাচ্ছে ওকে ভয় পেতে বারন করছে। কি করেই বা আরিজা শান্ত হবে, যে মানুষটা ওকে এতটা ভালোবাসে, ও যাকে এতটা ভালোবাসতো আজকে তাকে, আব্বু আম্মুর কথা আর তাদের দেওয়া কসমের জন্য ছেড়ে আসতে হয়েছে। হয়তো সম্পর্কগুলো এরকমি হয়, কাচের মত ঠুনকো, সমান্য আঘাতেও ভেঙ্গে যায়। নয়তোবা হারিয়ে যায় কোনো মিথ্যে মায়া বা মিথ্যেকে কেন্দ্র করে। আজমাইন অনেকক্ষণ আরিজাকে বোঝায় পর, দুই হাতে ওর চোখ মুছে দিয়ে ওর একটা হাত ধরে বললো।
আজমাইন - রিল্যাক্স, রিল্যাক্স একটু শান্ত হও। আমি বুঝতে পারছি তোমার জীবনে কিছু একটা হয়েছে যার জন্য এভাবে কান্না করছেন। আব্বু আম্মুকে ছেড়ে আসার কান্না এরকম নয়, সেটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতো। এখন আমাকে বলো, কি হয়েছে ?
আরিজাও রাফিনের কথা ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না বলতে লাগলো।
আরিজা - (কান্না করে করে) আসলে আমি একটা ছেলেকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম, ঐ আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আব্বু আম্মুর কথা রাখতে গিয়ে ওদের কসমটা রাখতে গিয়ে, ওই মানুষটাকে আমার ছেড়ে আসতে হয়েছে। ও হয়তো এখন আমাকে অনেক বেশি ভুল বুঝচ্ছে আর অনেক বেশি ঘৃণা করছে। রাফিন বলেছিলো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর আমিও ওকে ভালোবাসি ওকে ছাড়া থাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না, কিন্তু আব্বু আম্মুর কথা রাখতে গিয়ে আপনাকে আমার বিয়েটা করতে হয়েছে।আমি কি করে একটা মানুষকে ভালোবাসার পর আপনাকে বিয়ে করলাম। তারপরও আবার আপনাকে কি করে মেনে নিবো বলুন। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি করবো। আপনি একটু বলবেন আমাকে আমার কি অপরাধ ছিলো, কি অন্যায় করেছিলাম আমার আমার আমি যে আমার ভালোবাসাটাকে এভাবে আমাকে হারিয়ে ফেলতে হলো। আমি আব্বু আম্মুকে বারবার বলেছিলাম ওই ছেলেটা আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না আর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। কিন্তু ওরা আমার কোনো কথায় শোনেনি। আমার কথাটার কোনো মূল্য ওদের কাছে নেই। ভাগ্যের কাছে আমি অসহায় তাই উপায় না পেয়ে আপনাকে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছি। আপনি আমাকে মাফ করবেন। আমি আপনাকে কখনোই স্বামীর অধিকার নারকিন। আমি দিতে পারবো না।কিন্তু আপনি চাইলে আমার সাথে সবটাই করতে পারেন। আপনি আমার স্বামী কিন্তু আমি মন থেকে কখনো আপনাকে মেনে নিতে পারবো না, আমার মনে শুধু রাফিই থাকবে সবসময়।
আরিজা কথাই আজমাইন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো।
আজমাইন - দেখতাম সবাই প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্যে জড়াতো, কিন্তু আমিই আজ অব্দি কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। বন্ধুরা আমাকে অনেক করে বলতো আমি রিলেশনে কেনো করিনা? আমি বলতাম আমি সব ভালোবাসা আমার স্ত্রীর জন্য রাখবো। কিন্তু আজকে এরকম একটা ঘটনা ঘটবে আমি সেটা জানতাম না। তুমি একটা কাজ ভুল করেছো নিজের ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে এসে।
আজমাইন কথায় আরিজা অবাক হলো।
আজমাইন - অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি এইসব আমাকে বিয়ের আগে বলতে পারতে তাহলে যেভাবেই হোক আমি বিয়েটা বন্ধ করতাম। কারন জানোতো ভালোবাসাটা জোর করে হয় না। আমি ভালোবাসাটা লে কাউকে ভালোবাসিনি বলে যে কারো ভালোবাসাকে সম্মান করতে জানিনা তেমনটা নয়। এই কথাগুলো তোমার বিয়ের আগেই আমাকে বলা উচিত ছিলো। এখন বলে কি লাভ বলো, তারপরও আমি তোমার লাইফের সবটা জানতে চাই বলে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
আরিজা - (কান্না করে করে) আমি নিরুপায় ছিলাম। আব্বু আম্মুর কথা রাখতে গিয়ে আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছে। তাছাড়া আপনাকে বিয়ে না করলেও ওরা অন্য কোথাও আমাকে বিয়ে দিতো।
আজমাইন - দেখো বিয়ের আগে এররকম প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক অনেকেরই থাকে, যদি ছেলেটাকে সত্যিকারের ভালোবেসে থাকো, তাহলে ওকে ভুলতে পারবে না। এত সহজে আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না, তাই তুমি সময় নাও তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না, আর আমি তোমাকে কোনো বিষয়ে জোর করবো না। কারন জানোতো জোর করে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। কথাগুলো রে কখনো ভালোবাসা পাওয়া বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা কথা বলোতো ?!যদি রাফিনকে এতোটাই ভালোবাসো তাহলে বিয়ের আগে ওর হাত ধরে চলে গেলে না কেনো? তোমাদের বিয়ে হলে কিংবা একটা বেবি হলে আব্বু আম্মুর সামনে আসতে, তখন ওরা ওই পিচ্চিটার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তোমাদের সবাই মেনে নিতো।
আরিজা - আমি তেমনটাই করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আব্বু আম্মু তার আগেই ওদের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলো, আমি যদি ওই ছেলেটার সাথে পালিয়ে যায় তাহলে ওদের মরা মুখ দেখবো। আপনিই বলুন আমি কি করবো। আমি নিরুপায় ছিলাম উপায় না পেয়ে বিয়েটা করতে হয়েছে। আপার নিরুপায় - আমি আপনাকে আমাকে মাফ কখনোই আমার ভালোবাসাটা দিতে পারবো না, মন থেকে স্বামী হিসেবে মানতে পারবো না। আমি অনেক আগেই একজনকে কথা দিয়ে ফেলেছি, ওকে আমি ঠকাতে পারবো না ।
আজমাইন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত বোধহয় লাইফে এটাই হবারই বাকি ছিলো। স্কুল লাইফ পার হওয়ার পর থেকে যে কয়টা রিলেশনে জড়াতে চেয়েছে তার কোনোটাই হয়নি, তাই আর চেষ্টাও করেনি। ভেবেছিল ভবিষ্যতে যে ওর লাইফে আসবে তাকে সবটা দিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করবে। কিন্তু যাকে বউ হিসেবে পেলো সেকি নাকি অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসে, আজকে বাসর রাতে সেটা ওকে বলছে, এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। ওর এই সুন্দর কপালে হয়তো সেটাই লেখা ছিলো। আজমাইন কথাগুলো ভেবে নিজে নিজে একটু হাসে আর বলে।
আজমাইন - আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কিন্তু চাইলে এখান থেকে চলে যেতে পারো, আমি তোমাকে আটকাবো না। আরো উল্টো হেল্প করবো। তুমি হয়তো আমার কথায় অবাক হচ্ছো, কিন্তু জোর করে কাউকে ভালোবাসা যায় না। শুধু অধিকারটায় খাটানো যায়৷ তুমি চাইলে চলে যেতে পারো, আমি তেমার আব্বু আম্মুকে বুঝিয়ে বলবো।
আরিজা - আমি নিরুপায়, যেতে পারবো না। ভাগ্যের কাছে আমার হাত পা বাঁধা, আর ওই মানুষটা এখন আমাকে হাজারটা গালি দিচ্ছে, ঘৃণা করছে। ও হয়তো সারাজীবন আমাকে ভুল বুঝেই যাবে।
আরিজা এরকম কান্নাকাটিতে আজমাইন খুব খারাপ লাগছে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপরও ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। নতুন বউয়ের মুখ থেকে এরকম কিছু শোনাটা অস্বাভাবিক, আর সেটা শোনার পর, যে কেউ নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা, রিয়েক্ট করবে। কিন্তু আজমাইন সেটা করলো না, ও বুঝতে পারছে করব, তাই ভালোবাসাটা কোনো খেলার জিনিস নয়, তাই সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর লাইফেই কি শেষ মেষ এটা হবার ছিলো। আজমাইন বারবার কথাগুলো ভাবছিলো। ও আরিজা কান্নাকটি দেখে অনেকবার বললো। ও চাইলে চলে যেতে পারে, কিন্তু আরিজা যেতে পারবে না।
- এই ভেবে, রাফিন হয়তো এখন ওকে হাজারবার ঘৃণা করছে, নামের পাশে প্রতারক মিথ্যাবাদীটা জুড়ে দিচ্ছে। সব ভালোবাসার পূর্ণতা পায়না, এই গল্পটা হয়তো তার মতোই। যাইহোক এখন আপনাদের পরিচয়টা দিয়ে নেই। এতোক্ষন বউয়ের মুখ থেকে যে মহৎ কথাগুলো শুনলো সে, আজমাইন হোসেন সাব্বির। পড়ালেখা শেষ করেছে প্রায় একটা বছর হলো। আহ বছর হলো। এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে, ওনার অধাঙ্গীনির নাম আরিজা মেহেজাবীন। আজকে ওদের বিয়ে হয়েছে, আর নতুন বউ কি বললো সেটাতো আপনারা তার মুখেই শুনতে পেলেন। আসলে আজমাইন আরিজাকে একটু মিথ্যা বলেছে।
- ও আরিজা কিছুদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে দেখেছিলো, আর সেখান থেকেই আজমাইন ওকে বেশ ভালো লাগে, যার জন্য আজমাইন ওর আব্বু আম্মুকে আরিজা কথা বললে। আব্বু আম্মু অনেক খুশি হয়, তারপর আরিজার বাসায় কথা বলতে চাই। আজমাইন ঠিকানা যোগাড় করে ওদের দিলে ওরা আরিজা বাসায় কথা বলে। এর মাঝে আবার রাফিনের সাথে আরিজা সম্পর্ক আছে সেটা ওর বাসা থেকে জেনে গেছিলো। আর ওর আব্বু আম্মু ভাবে রাফিন ছেলেটা বেশি ভালো না, তার ওপর বেকার, তাই ওকে মেনে নিতে পারেনি। সবটা জানার পর আরিজা আব্বু আম্মু ওকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিলে ও বলে। রাফিনকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না, তখন আব্বু ওনার মাথায় হাত দিয়ে কসম দেয়।
ওনাদের কথায় বিয়েটা না করলে ওদের মরা মুখ দেখবে। কথাগুলো শোনার পর আরিজা আর কোনো উপায় না পেয়ে ওদের কথায় রাজি হয়ে যায়। তারপর রাফিনকে নিজের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ওর প্রতি একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি করে, ওর থেকে চলে আসে। যেনো রাফিন ওকে ওর সাথে কথা হয়েছিলো, রাফিন ভুলে যায়। আরিজা একটু আগে অনেক কান্না করছে বারবার বলেছে, ওর সাথে কেনো এরকমটা করলো। এরকমটা না করলেও পারতো, কিন্তু ভাগ্যের কাছে আরিজা নিরুপায় ছিলো। কোনো উপায় ছিলোনা তাই চুপ করে থাকতে হয়েছে। আজমাইন কোনো উপায় না পেয়ে আবারো আরিজা চোখের পানি মুছে দিলো আর বললো।
আজমাইন - প্লিজ শান্ত হও, ভাগ্যের ওপর আমাদের কোনো হাত থাকে না, সেটা আমাদের মেনে নিতেই হয়। আমিতো বললাম তুমি চাইলে চলে যেতে পারো। কিন্তু তুমিই যাবে না, আবার আমাকেও স্বামী হিসেবে মানবে না। ভালোবাসতেও পারবে না। এটা আমি এমনিতেই ভালোবাসতেও পারবে না। বুঝতে পারছি, তাহলে কিভাবে হলো বলো। তোমাকে তো একটা পথ বেছে নিতেই হবে। এভাবে কতদিন থাকবে, আর আমিতো একটা পুরুষ তোমাকে ছেড়ে কতোদিন দূরে থাকবো। তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমিতো তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
0 Comments