Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ভুল সিদ্ধান্ত

শোনো বৌমা আমি তোমার শাশুড়ি, আমি কখনোই তোমাকে বলবো না যে আমাকে মায়ের মতই ভাববে। শাশুড়ি মায়ের আচমকা এই ধরনের তির্যক কথায় শ্বশুরবাড়িতে মাত্র পদার্পণ করা নববধূ নাদিয়া খানিকটা ভড়কে যায়। সে জানে এই যুগের শাশুড়িরা কখনো মা হতে পারে না বড়জোর নাটক করে ঠিক তেমনি বৌমারাও কখনো মেয়ে হয়ে উঠতে পারে না কিন্তু তাই বলে ভরা মজলিসে ভদ্রমহিলা এ ধরনের কথা বলবে তা নাদিয়ার কল্পনার বাইরে ছিল।


মোটামুটি সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে নাদিয়ার ননদ রিপা ঘরে নক করলো,
-ভাবী আসবো?
-এসো এসো, নাদিয়া খানিকটা অপস্তুত অবস্থায় খাটে বসে আছে।
-তুমি কিছু মনে করো না, মা একটু এভাবেই কথা বলে।
নাদিয়া অনেক কিছুই মনে করেছে, সে স্বাধীনচেতা মেয়ে কিন্তু মুখের উপর এভাবে বলা যায় না তাই কষ্ট করে একটু হাসলো।
-এখন ওঠো, এসব ভারি জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে রিলাক্স করো, তারপর কিছু খেয়ে নাও । বাব্বাহ সারাদিন এসব জবরজং জিনিসপত্র পরে মুখে রং মেখে রাখা! আমি এভাবে বিয়ে করবো না, পালিয়ে বিয়ে করবো, এই ঝামেলা আমি নিতে পারবো না।
শাশুড়ি মায়ের কথা অপছন্দ হলেও রিপাকে নাদিয়ার ভীষণ পছন্দ হলো।
বাথরুম থেকে বের হয়ে নাদিয়া দেখে তার স্বামী সাগর খাটের উপর বসে আছে।
-এসো নাদিয়া খেতে বসি, খুব ক্ষুধা লেগেছে । সারাদিনে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে তোমাদের বাড়িতে ভালো খাবার দাবার দিলেও লজ্জায় কেন যেন খেতে পারিনি।
-তোমার আবার লজ্জা শরম আছে নাকি? কই পাঁচ বছরের সম্পর্কে তো দেখি নি।
-আরে মিথ্যা বলব কেন?
-তুমি অলরেডি মিথ্যা বলে ফেলেছ সাগর
-কখন মিথ্যা বললাম?
-এই যে আমাদের মধ্যে পাঁচ বছরের সম্পর্ক কিন্তু তুমি ঘটনাটা এমনভাবে সাজালে যেন আমাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। ঘটক এলো ছবি দেখালো, তোমরা আমাকে দেখতে গেলে, পছন্দ করে আংটি পরানো হলো
-আরে নাদিয়া, আসলে মা এসব লাভ ম্যারেজ পছন্দ করে না আর অন্যদিকে আমার তোমাকে চাই, তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাই করতে পারি না তাই এসব করেছি। আচ্ছা মিথ্যা বলেছি মানলাম কিন্তু তোমাকে পাওয়ার জন্যই তো, এবার খাবেন তো মহারানী?
-আসছি আমারও ক্ষুধা লেগেছে, নাদিয়া খানিকটা মুখ ভেংচে বললো।
নাদিয়া বরাবর ঘুমকাতুরে, সে অবশ্য অ্যালার্ম সেট করে রেখেছে সকাল সাতটার । কিন্তু কোন দিক দিয়ে যে এলার্ম বাজলো কে জানে! ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রায় নটার কাছাকাছি। কি বিশ্রী কি বিশ্রী এখন কি হবে? কাল রাতে ভদ্র মহিলার যে রূপ ও দেখেছে তাতে তো মনে হচ্ছে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। নাদিয়া কোনরকম হাঁচরে পাঁচরে তৈরি হয়ে নিচে এলো। এসে দেখে রিপা কলেজে চলে গেছে আর বাবা ভার্সিটিতে, উনি একজন অধ্যাপক। সাগরকে কোথাও দেখতে পেল না, কাজের মেয়েটি রান্নাঘরে কি যেন করছে। নাদিয়ার কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব হতে লাগলো।
সে পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
কাজের মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- কি নাম তোমার?
-আমার নাম সবিতা, ভাবী আমি সাত বছর ধরে এখানে কাজ করতেছি
-মা কোথায় জানো?
সবিতা কথা শেষ করার আগেই সাজেদা বেগম মানে নাদিয়ার শাশুড়ি বের হয়ে আসলেন।
-উঠে গেছো তুমি?
নাদিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে বেশ অস্বস্তি নিয়ে মাথা নড়লো
-মুরুব্বিদের সাথে কথা বলার সময় মাথা নেড়ে উত্তর দিতে হয় না এটা জানো না
-সরি মা
- আচ্ছা হয়েছে, যাও খাবার টেবিলে যাও, নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধা লেগেছে
নাদিয়া খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে পরোটা আলু ভাজি আর গরুর মাংস।
- খেয়ে আমার রুমে একটু এসো, এই সবিতা বৌমার খাবার পরে চা বা কফি যেটা চায় সেটা বানিয়ে দিবি।
খাওয়া শেষে নাদিয়া নিজেই দুই কাপ চা বানিয়ে শাশুড়ির ঘরে গেল
-এ সময় আবার আমার জন্য চা নিয়ে এলে কেন?
-আমি বানিয়েছি মা আসুন না একসাথে খাই
-বসো তোমাকে কিছু ছবি দেখাই আসলে বিয়েটা এত হুটহাট হয়ে গেল যে আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে তেমনভাবে তোমার দেখা সাক্ষাত হয়নি আর যেহেতু রিসিপশনটাও হচ্ছে না তাই পরে অনেক আত্মীয়-স্বজনকে তুমি চিনতে পারবে না তারা একান ও কান করে অহংকারী বউ বলে বদনাম রটাবে।
কিছু দিন পর রাতের বেলা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নাদিয়া সাগরকে বললো,
- সাগর আমার তো ছুটি শেষ আগামী রবিবার থেকে অফিস করতে হবে
-হ্যাঁ করবে কে মানা করেছে
-মা আবার কিছু বলবে না তো?
-মা আবার কি বলবে, অদ্ভুত কথাবার্তা তোমাকে দেখেই তো এনেছে যে তুমি চাকরিজীবী।
শনিবার ডিনারে নাদিয়া খানিকটা আমতা আমতা করে আগামীকাল তার অফিস যাওয়ার ব্যাপারটা বললো।
-শোনো বউমা, মেয়েদের চাকরি করাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না কিন্তু আমাদের যুগ তো শেষ এখন তোমাদের যুগ শুরু। ছেলেমেয়ে সবাই একসাথে কাজ করছে। তোমার ইচ্ছে হলে অবশ্যই চাকরি করবে সমস্যা নেই কারণ তোমাকে দেখেই এনেছি না হলে শর্ত দিয়ে দিতাম। সে যাই হোক খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। এখান থেকে কিন্তু তোমার অফিস বেশ দূরে, বাবার বাড়ি থেকে যে ১৫ মিনিটে পৌঁছাতে এখান থেকে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার বেশি লেগে যাবে ঢাকা শহরে জ্যামের যে অবস্থা। নাদিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। সাগরের অনেক আত্মীয়-স্বজনের সাথে নাদিয়ার পরিচয় হয়েছে। কথায় কথায় নাদিয়া জানতে পারলো তার দাদী শাশুড়ি এখনো বেঁচে আছে এবং থাকেন উনার মেয়ের বাসায় । এই বাড়ির ধারে কাছে নাকি উনি আসেন না। মা ছাড়া বাকি সবাই উনাকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসে আর বাবা প্রতি মাসে একটা অ্যামাউন্ট ওনার বোনের কাছে পাঠিয়ে দেন। নাদিয়ার মনে এতদিন শাশুড়ি সম্পর্কে একটা সংশয় ছিল উনি ভালো নাকি খারাপ তা নিয়ে কিন্তু এবার মনে হচ্ছে মনে হয় খারাপের পাল্লাটাই বেশি তা নাহলে নিজের শাশুড়িকে কেন ননদের বাসায় রাখবেন? এমনকি দাদি শাশুড়ির এই বাড়িতে আসা পর্যন্ত এলাউড না, কি অদ্ভুত।
ছুটির দিন দুপুর সবাই খাওয়া-দাওয়া করছে, সপ্তাহের এই একটি দিনই সবাই ফ্রি থাকে।
খেতে খেতে নাদিয়া সাগরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-সাগর এখান থেকে আমার অফিস বেশ দূরে তাই ভাবছি কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় আলাদা বাড়ি নেব। সাগর থ মেরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, একবার বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো
-কি হয়েছে বৌমা! এখানে তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে? বাবা বলে উঠলেন
-না তো বাবা ওই যে বললাম যাওয়া আসাটা যা একটু সমস্যা
-তুমি চাইলে আমার গাড়িটা ব্যবহার করতে পারো, হ্যাঁ যেহেতু আমরা ঢাকা শহরে থাকি এই জ্যাম দূষণ এগুলো নিয়েই আমাদেরকে থাকতে হবে তার মানে এই না যে আলাদা হয়ে যেতে হবে
-তাই নাকি বাবা! আমাকে এতগুলো কথা বলতে পারছেন অথচ নিজের স্ত্রীকে বলতে পারেননি?
-তুমি কি বলছো মা?
-আপনার মা কেন আলাদা থাকেন? আপনার স্ত্রী যদি আপনার মায়ের সাথে একসাথে থাকতে না পারেন তাহলে আমি কেন আমার শাশুড়ির সাথে একসাথে থাকবো, আমারও আলাদা সংসার চাই।
-ভাবী এবার কিন্তু তুমি বেশি বেশি বলছো রিপা খানিকটা রুক্ষ সুরে বলে
- রিপা তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি এর মাঝখানে তুমি এসো না।
মিসেস সাজেদা এতক্ষণ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলেন। এবার প্রায় বাজখাই গলায় উনি বললেন,
-ঠিক আছে হয় তুমি আলাদা হয়ে যাও আর না হয় কিছুদিন তোমার দাদী শাশুড়িকে এখানে এনে রাখো
-কিছুদিন না মা, উনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনার ছেলের সাথেই থাকবেন। তাহলে আমিও এই বাড়ি ছাড়বো না আর আপনার ছেলেও আপনার থেকে দূরে যাবে না।
সাজেদা বেগম সায় দিলেন কিন্তু নাস্তা শেষ না করেই উঠে চলে গেলেন।
নাদিয়া আর সাগর মিলে দাদীকে আনতে গেল। দাদীর মুখে হাসি, সেই হাসির তুলনা হয় না। যেন অনেকদিন পর নিজের ঘরে ফিরছেন, নাদিয়ার মনটা ভরে গেল।
সেই রাতে সাজেদা বেগম ভাত খেলেন না। বৃদ্ধা দাদী ডিনার টেবিলে অনেকদিন পর যেন ছেলের থালায় এটা ওটা তুলে দিয়ে পরম তৃপ্তি পাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবার মুখেও তেমন একটা হাসি নেই আসলে উনি বোধ হয় স্ত্রীকে ভয় পান।
পরদিন সরকারি ছুটির দিন হওয়াতে নাদিয়া অভ্যাস মত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো। এই বাড়িতে আসার পর এই নিয়ে তার কোন ঝামেলা হয়নি।
-কি ব্যাপার বউ এইটা তোমার ওঠার সময় হইলো? রুক্ষ স্বরে দাদী জিজ্ঞেস করলেন।
-আজ তো সবার ছুটি দাদী তাই একটু ঘুমিয়ে নিলাম
-তুমি না বাড়ির বউ , সকালে উঠে নাস্তা পানি তো দেখি কিছুই বানাও না অবশ্য যেমন শাশুড়ি তেমন তার বৌ
নাদিয়ার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, সে চলেই যাচ্ছিল এমন সময় বৃদ্ধা আবার ডাক দিল
-এটা কি পোশাক পরছো তুমি! এরকম পোশাক কোন বাড়ির বউ পরে? বাড়ির বউ পরবে শাড়ি।
-দুঃখিত দাদী, আমি বাড়িতে সারাদিন শাড়ি পরে থাকতে পারবো না । কোন অনুষ্ঠান বা অন্য কিছু হলে বড়জোর শাড়ি পরে যেতে পারি নাদিয়া একটু উচ্চস্বরে বললো
-অসভ্যর মত আমার সাথে কথা বলবে না। শিক্ষা দীক্ষা তো বাবার বাড়ি থেকে কিছুই পাওনি, শাশুড়িও শেখায়নি কিছু। উনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন , নাদিয়া ওনার সামনে থেকে চলে গেল, তার অসম্ভব রকম বিরক্ত লাগছে।
নিজের রুমে যাওয়ার পথে নাদিয়া দেখল সাজেদা বেগম চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পরদিন অফিস থেকে ফিরতে তার একটু বেশি দেরি হয়ে যায়। অফিসের চাপ বেশি ছিল, তাছাড়া জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে সব মিলিয়ে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল। বাড়ি ফিরে নাদিয়া দেখে গোল মিটিং এর মত সবাই বসে আছে। সে অনেকেই অপ্রস্তুত বোধ করলো, কেউ কিছু বলল না
শুধু খেকিয়ে দাদী শাশুড়ি বলে উঠলেন,
-এই বউ আনছো তুমি সাজেদা, রাত বিরাতে যেই বউ বাড়ি ফিরে আসে। মেয়েদের আবার চাকরি বাকরি কিসের, কোন ছেলের সাথে ঢলাঢলি করে আসছে না হলে বাড়ির বউ আবার এত রাতে বাইরে থাকে?
-আপনি চুপ করুন অনেক কথা বলে ফেলেছেন, ভদ্রতা শেখেননি? নাদিয়া গলা উঁচু করে বললো
-এই মেয়ে এই তুমি আমাকে চুপ করতে শেখাও ঠাস করে একটা থাপ্পর মারলে তারপরে বুঝবে মুরুব্বিদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়
-আসুন তো মারুন দেখি আমার গালে একটা থাপ্পড়, তারপর ১৪ শিকের ভেতরে ঢুকাবো । ফাজলামো পেয়েছেন, অসভ্য মহিলা। সাগর তোমার ওই ফুফুকে ফোন করো, এখনই এসে যেন এই মহিলাকে নিয়ে যায় ,এখন মানে এখন। মা আপনি ওখানে বসে কি করছেন? আমি ভুল করেছি আমাকে একটা থাপ্পড় দিন, আমার উপর রাগ ঝাড়ুন, আপনি বসে আছেন কেন, বলতে বলতে নাদিয়া প্রায় কেঁদে ফেললো।
রাত সাড়ে দশটায় অনেক অভিশাপ দিয়ে দাদী শাশুড়ি বাড়ি থেকে পোটলাপুটলি নিয়ে বিদায় হলেন।নাদিয়া তখন তার শাশুড়ির ঘরে।
-মা, তুমি আমায় কিছু বলবে না? আমি যে ভুল করেছিলাম, কথা বলবে না আমার সাথে? আমার তো মা নেই, তুমি বলেছ শাশুড়ি কখনো মা হতে পারে না কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারে তাই না মা । আমি না হয় মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করে গেলাম তুমিও একদিন আমার মা হয়ে উঠবে।
-মাগো তখন তোমায় কিছু আমি বলিনি, যদি বলতাম তাহলে তোমার কাছে আমি খারাপ শাশুড়ি হয়ে‌ উঠতাম। বিয়ের পরপর মেয়েদের মনে এমনিতেই অনেক আশঙ্কা থাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে আসা, সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবারে এডজাস্ট করে নেওয়া সহ আরো অনেক কিছু। তিনি দুদিনেই তোমার কাছে অসহ্য হয়ে গেছে আর জানো উনার সাথে আমি কাটিয়েছি জীবনের চারটা বছর। আমার কোন কিছুই ওনার পছন্দ ছিল না। আমার গায়ের রং চাপা, আমার বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক দেয়া হয়নি, আমি শহরের মেয়ে গ্রামের কাজকর্ম তেমন কিছু জানি না সারাক্ষণ আমাকে কথা শুনতে হতো, আতঙ্কে থাকতাম, অনেক অনেক দিন খেতেও পেতাম না জানো, খাওয়ার কমতি ছিল না কিন্তু হয়তো মেহমান চলে এসেছে পরে আর রান্না করার পারমিশন ছিল না আমার ভাগের খাবারটা মেহমানের রিজিকে চলে গেছে। সাগরের বয়স যখন এক মাস তখন জানি না কেন আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকতো পরে অবশ্য ডাক্তার এক বান্ধবীর সাথে কনসাল্ট করে জেনেছিলাম এটাকে নাকি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে। ওই সময় এই মহিলার তীর্যক কথাগুলো আমি নিতে পারতাম না, মুখে মুখে তর্ক করতাম। একদিন উনি আমার গায়ে হাত তুললেন প্রচন্ড মারধর করলেন। আমিও রাগের মাথায় খুব গুনাহের একটা কাজ করে ফেললাম, ঠাস করে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিলাম গালের মধ্যে। তোমার শ্বশুর আব্বা যখন ফিরে এলো আমার তখন রক্তাক্ত অবস্থা, সাগর তখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে। এর মধ্যে উনার মায়ের মরা কান্না হয় এই বউকে ছাড়তে হবে নয়তো উনি গলায় দড়ি দিবেন। তোমার শ্বশুর উপায় না পেয়ে আমাকে আর সাগরকে আমার বাবার বাড়িতে রেখে এলেন। তারপর সাত মাস একা ছিলাম সাগরকে নিয়ে। তোমার শ্বশুর আব্বা কোন খোঁজ খবর নেয় নি তখন তো ফোনের যুগ ছিল না। আমি বুঝতাম মানুষটা নিজেও ভুক্তভোগী, সে না পারছে নিজের মাকে ছাড়তে না পারছে বউকে তালাক দিতে, যদি তালাক দেওয়ার হতো এতদিনে দিয়ে দিত। আমার ভাই আমাকে সাহস দিলেন, বললেন এভাবে জীবন চলে না আমি যেন তোমার শ্বশুর আব্বাকে নিজে ডিভোর্স নোটিশ পাঠাই। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ভাইয়া আমাকে বললেন,
- প্রথমবার ডিভোর্স নোটিশ পাঠালেই ডিভোর্স হয়ে যায় না যদি তোর স্বামী তোকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসে তাহলে তোকে হারানোর ভয়ে অবশ্যই ছুটে আসবে আর যদি ভালো না বাসে তাহলে এই সম্পর্কে জড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। আমি তার কথা মতই কাজ করলাম এবং ফল পেলাম ডিভোর্স নোটিশ পাওয়ার পরের দিনই তোমার শশুর আব্বা গিয়ে উপস্থিত হলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না , একেবারে পায়ে পড়ে গেল, মানুষটাকে দেখে মায়া হচ্ছিল একই সাথে রাগও হচ্ছিল খুব ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিলাম,
- তোমার মা তো গলায় দড়ি দেবে
তিনিও খুব শক্তভাবে বলেন,
- আমি ভুল করেছি সাজেদা, মায়েদের সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে নিতে নেই। যদি পারো তোমার এই অধম স্বামীকে ক্ষমা করো , তোমার ছেলের অক্ষম বাবাকে ক্ষমা করো, তুমি জানতেও পারবে না এই সাত মাস আমি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি কিন্তু তোমাদের কাছেও আসতে পারিনি। মায়ের ওই একটি কথাই আমাকে সরিয়ে রেখেছিল কিন্তু যখন তোমার বিচ্ছেদের চিঠি পেলাম আমার সমস্ত জীবন উলটপালট হয়ে গেল। মনে হলো আমার জীবনটাই ব্যর্থ ।কখনো তোমাকে বলা হয়নি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমি তোমাদেরকে নিয়ে আলাদা সংসার করবো। হ্যাঁ মায়ের দায়িত্ব পালন করবো, তাকে টাকা পয়সা দিয়ে দিব। তিনি যদি ভালো মানুষ হতেন তাহলে এই ধরনের কথা কখনোই বলতেন না, অন্তত ছেলের সুখের কথা চিন্তা করতেন। তার চোখের সামনেই তো এই সাত মাস উনি আমাকে দেখেছেন,আমার কষ্টগুলো দেখেছেন কিন্তু তারপরেও উনি কখনোই নিজের জেদ ছাড়েননি।
নাদিয়া মন দিয়ে শাশুড়ির কথা শুনছিল তার চোখ ছলছল হয়ে যায়।
-তারপর তোমার শ্বশুর আমাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার গড়ে তোলে, বছর চারেক পরে রিপার জন্ম হয়।
-তোমার আর কিছু বলতে হবে না মা। এখন আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও, নাদিয়া তার শাশুড়ির কোলের উপর শুয়ে পরলো মাথা রেখে।
-বিয়ের আগের প্রেম ভালবাসার কথা আমার একদম পছন্দ না কিন্তু তাই বলে কি আমি তোমাদের ভালবাসাকে মেনে নেই নি? ছেলের সুখের জন্য প্রকৃত মা সবকিছুই করে কিন্তু উনি কিছুই করেননি কি করে উনাকে ক্ষমা করি বলোতো?
-মা তুমি জানতে আমাদের কথা!
-মায়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন রে মা
- থাক আমার গোয়েন্দা মা লাগবে না কিন্তু তুমি আমার যেমন শাশুড়ি আছো তেমন শাশুড়ি মা থাকো, যেন আমি গর্ব করে বলতে পারি আমার শাশুড়ি মা বেস্ট। সাজেদা বেগমের চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল নাদিয়ার কপালে।


ভুল সিদ্ধান্ত (ছোটগল্প)।
লেখনীতে: Collected।
Credit Goes to The Right Owner.

Post a Comment

0 Comments