Header Ads Widget

Responsive Advertisement

নিষিদ্ধ নারী - পার্ট ১৩

অরুনিকার দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। সে কীভাবে ভুল করতে পারে! একটা বারের জন্য কেন তার মনে হলো না। এই সবের পেছনে অমল থাকতে পারে। দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে অরুনিকা।এখন! এখন সে কী করবে? নিজের মনেই ছটফট করছিল অরুনিকা।
—অমল মুচকি হাসছে। এই খেলা যেন তার খুব ভালো লাগছে। প্রতিবারের মতো এইবারেও সে সফল। আভাকে বাঁচানোর চেষ্টায় অরুনিকার পরাজয় হয়েছে আর অমলের হয়েছে জয়। অরুনিকাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অমল বলল, তোমাকে দেখতে ভিষণ সুন্দর লাগছে লক্ষীটি। আগের চেয়ে তোমার রূপের আগুন যেন আরও বেড়েছে। নিজেকে ধরে রাখতে পাচ্ছি না।
অরুনিকা বলল, আমার কাছে তুই আগেও যা ছিলি এখন তাই আছিস শয়তান। অতীতে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আমাকে অন্ধকার জগতে এনে ফেলেছিলি অপমান সহ্য করতে না পেরে আমার বাবা-মা আত্মহত্যা করেছিল। আর আজ তুই আমার ছোট বোনটার জীবন ধ্বংস করার চেষ্টা করছিস!
—তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে লক্ষীটি। আভার জীবন ধ্বংস করার চেষ্টা করছি না অলরেডি করে ফেলেছি। এই বলেই সে হো হো করে হেসে উঠল।



—অরুনিকা দৌঁড়ে গিয়ে অমলের গলা টিপে ধরল। তুই আমার বোনের সাথে এই সব করতে পারিস না। গলা টিপে ধরার পরও অমলের হাসি থামেনা। ঘরের পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে দুইজন বন্দুকধারী লোক। অরুনিকা ভয়ে অমলের গলা ছেড়ে দেয়।
—তোমার কি মনে হয় অরুনিকা? আমার জীবন নেওয়া এতোই সস্তা! তুমি আমার কাছে আসবে আর গলা টিপে মেরে ফেলবে। না অরুনিকা এটা তোমার ভুল ধারণা। এত সহজে আমাকে মারতে পারবে না।
—হাতের ঈশারায় বন্দুকধারী লোকদের চলে যেতে বলে অমল। ওরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল। অমল বিছানায় বসতে বসতে বলল, আচ্ছা চলো দু'জনে আজ রাতটা গল্প করি। কাল থেকে তো তোমার আবার কাজ শুরু করতে হবে।
—অরুনিকা বলল,কিসের কাজ!
—তুমি যে কাজ পার। সেই কাজই এখন থেকে এখানে করবে। ব্যপারটা কিন্তু খুবই মজার। দুই বোনের মাঝে প্রতিযোগিতা চলবে। রাত শেষে কে কত কামাই করল তার হিসেবে বসবে। অমল কথা শেষে হো হো হো করে হাসছে। দেখে মনে হচ্ছে এই সব কথা বলে সে বেশ মজাই পাচ্ছে।
—অরুনিকা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। অমল যেই জায়গায় আছে সেখান থেকে কীভাবে আভাকে নিয়ে সে পালাবে! একবারের জন্য কেন তার অমলের কথা মনে হলো না। আগেই যদি সে জানত ছোট স্যার হচ্ছে অমল তাহলে পরিকল্পনাটা সেই হিসেবে করা যেত। তখন কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলত অরুনিকা।
—কি হলো অরুনিকা? এতো কী ভাবছ? এখান থেকে পালানোর চিন্তা করা ছেড়ে দাও। বৃথা চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে। তার থেকে বরং আমাকে তৃপ্ত কর এতেও লাভ আছে তোমার এই বলে অরুনিকার কাছে এগিয়ে গেল অমল।
******
মরমর অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে ডক্টর মৃণাল। পায়ের ব্যথায় জর্জরিত মৃণাল কাতর স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, জল আমাকে কেউ জল দাও। বাইরের কোলাহলে মাঝের কারো কান অব্দি মৃণালের কাকুতি পোঁছাল না। মৃণাল বিড়বিড় করে জল জল বলতে বলতেই জ্ঞান হারাল। ঠিক সেই সময় ঘরে চুপিসারে একজন ঢুকলো । সে অন্ধকার ঘরে লুকাবার স্থান খুঁজতে নিয়ে মৃণালের পায়ের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
— পড়ে যাবার পর ভয়ে কাঁপতে থাকা এক মেয়েলি কন্ঠ শোনা গেল। কে এখানে! কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আরও একবার মেয়েটি বলল,কথা বলছেন না কেন? কে এখানে! এবার মেয়েটি সাহস করে উঠে দাঁড়িয়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে বেড় করে লাইট জ্বালায়। ঘর আলোকিত হতেই মেঝেতে মৃণালকে পড়ে থাকতে দেখে মেয়েটি ভাবে হয়ত সে মারা গেছে। মেয়েটির চোখ ছলছল করছে কারণ এই লোকটাকে সে চিনে। এক সপ্তাহ আগে এই লোকটিকে তার সামনেই তো অমলের বডিগার্ড গুলি করেছিল। লোকটির কথা ভেবে মেয়েটির খারাপ লাগে। নিজের বোনকে বাঁচাতে এসে বেচারা নিজেই মারা গেল। হটাৎ তখনি তার মনে পড়লো শুধু বোনকে বাঁচাতে তো লোকটি আসেনি। অমলের কথা অনুসারে এই লোকটি তাকে-ও বাঁচাতে এসেছিল। কিন্তু এই লোকটি তাকে কীভাবে চিনে? আচ্ছা দি-ভাইয়ের সাথে কোনভাবে লোকটির যোগাযোগ ছিল না তো! না এটা সম্ভব না। তার দি-ভাই তো জানেই না সে অপহরণ হয়েছে। সে যাইহোক এখন যে তাকে একটা লাশের সাথে আত্নগোপন করে থাকতে হবে এই ভাবতেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় মেয়েটি।
—দরজা বাইরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই তারা এখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে। মেয়েটি ভয়ে চারিদিকে তাকায়। লুকিয়ে থাকবার মতো ঘরে কিছুই নেই। বড় বড় কাগজের বাক্স আর পুরনো কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই নেই। মোটামুটি সব গুলো বাক্সে পুরনো কাপড়চোপড়ে ভর্তি। মেয়েটি একটা খালি বাক্সে ভেতর উঠে নিজেকে কিছু কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল।
—ঘরের ভেতর অমলের সাথে আরও কিছু লোক ঢুকল। অমলের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভিষণ রেগে আছে। রেগে থাকবেই না কেন! কত বছর পর অরুনিকার সাথে যৌন খেলায় লিপ্ত হতে চেয়েছিল আর সেই সময় কি না এই অঘটন ঘটলো। অমল চেঁচিয়ে বলল, সামান্য একটা মেয়েকে দেখে রাখতে পারিস না তোরা। তাড়াতাড়ি খুঁজে বেড় কর। ম্যাডাম যদি জানে মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। আর আমি মরার আগে তোদের খুন করব হারামজাদার দল।
—পেছন থেকে একজন বলল, ছোট স্যার আমাদের কোন দোষ নেই। মেয়েটি এমন ভাব করছিল যেন নেশায় আছে। অথচ নেশা যে কেটে গেছে এটা বুঝতেই পারিনি।
—অমল চেঁচিয়ে বলল, বেশি কথা না বলে মেয়েটাকে খুঁজে বেড় কর। মৃণালের দিকে তাকিয়ে অমল বলল, ওই শালার কি অবস্থা!
—পেছন থেকে ন্যাড়া মাথার এক লোক এসে বলল, খুব একটা ভালো না। পায়ে সম্ভবত ইনফেকশন হয়েছে।
—ডাক্তার নিয়ে আয়। ম্যাডাম কিন্তু মারার হুকুম দেয়নি। ভালো ভাবে চিকিৎসা কর হারামজাদার। সুখে থাকতে ভুতে ধরেছিল তাই এখানে মরতে এসেছে। এই বলেই হনহনিয়ে চলে গেল অমল।
—ঘর থেকে সবাই যেতেই মেয়েটি বাইরে আসে। লোকটির নাম তাহলে মৃণাল। তার মানে লোকটি এখনো মরেনি জ্ঞান হারিয়েছে। আশেপাশে পানি আছে কি না খুঁজে দেখল মেয়েটি। কোথাও পানি নেই। পানি থাকলে তাও জ্ঞান ফেরানো যেত। এখন তার পক্ষে বাইরে গিয়ে পানি নিয়ে আসা সম্ভব না। আজ যদি সে ধরা পড়ে তাহলে চিরজীবনের জন্য সে এই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
— কিছুক্ষণ পড়েই আবারও ঘরের দিকে কেউ আসছে। মেয়েটি বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আবার লুকিয়ে পড়ে। ডাক্তার এসেছে। দুইজন লোক মিলে কয়েকটা বাক্স সরিয়ে রেখে বাইরে থেকে একটা সিঙ্গেল খাট নিয়ে এসে শুয়ে দেয় মৃণালকে। ততক্ষণে মৃণালের জ্ঞান ফিরেছে। সে আবার বিড়বিড়িয়ে বলল,আমাকে জল দাও। মৃণালের জল চাওয়া দেখে একজন লোক জল নিয়ে আসে। মৃণাল ঢকঢক করে জল পান করে। ডাক্তার পুরোনো ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করে আবার নতুন ব্যান্ডেজ করে দেয়। মৃণাল এই সুযোগ বুঝে মেডিকেল বক্স থেকে একটা কেঁচি তুলে নেয়। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, তোমাদের ছোট স্যারকে বলবে এটার ভিজিট দিতে হবে না। নতুন কোন কচি মেয়েকে এক রাতের জন্য যেন পাঠিয়ে দেয় আমার কাছে।
—ডাক্তার যাওয়ার পর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ আর জল সহ কিছু খাবার রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যায় লোক দুটিও।

—লোক দুটি যেতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েটিকে দেখতেই ছানাবড়া চোখ করে মৃণাল বলল, তুমি এখানে কীভাবে?


হসপিটালের করিডরে এক নারী অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। শরীরের বেশভূষায় কোন ভালো পরিবারে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। করিডর দিয়ে যাতায়াতের সময় ডাক্তার, নার্স আর সাধারণ মানুষ সবাই মেয়েটিকে দেখছে কিন্তু এগিয়ে কেউই আসছে না। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো কিছু কথা সাজিয়ে নিজেদের ভেতর আলোচনা করছে আর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে মেয়েটিকে। তারপর যে যার মতো চলে যাচ্ছে।
—ডক্টর অদিতি হসপিটালে রাউন্ড দিতে এসেছে সাথে আছে কয়েকজন ইনর্টানি। করিডর দিয়ে যাবার সময় মেয়েটিকে দেখে থমকে দাঁড়ায় অদিতি। মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা দেখে এক নার্সের উদ্দেশ্য বলল, মেয়েটিকে নয় নাম্বার ওয়ার্ডে নিয়ে যা-ও।
—নয় নাম্বার ওয়ার্ড! নয় নাম্বার ওয়ার্ডের কথা শুনে নার্স অবাক হয়ে যায়। বহু বছর হলো ওই ওয়ার্ডে তো কোন রুগীই রাখা হয় না। তাহলে ডক্টর অদিতি তাকে কেন ওই ওয়ার্ডে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বলল! মনের ভেতর প্রশ্ন ঘুরপাক করলেও মুখ ফুটে বলার সাহস আর হয় না। ডক্টর অদিতির কথা মতো নার্স ওয়ার্ড বয় এর সহায়তা নিয়ে ওই মেয়েটিকে স্ট্রেচারে তুলে নয় নাম্বার ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। নয় নাম্বার ওয়ার্ডে কোন বেড নেই। তাই মেয়েটিকে স্ট্রেচারে রেখেই নার্স চলে যায়।
—রাউন্ড শেষ করে অদিতি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসতে বসতে কাউকে ফোন দিল। ওপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই ডক্টর অদিতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, চোখ কান বন্ধ করে থেকে বিপদ ডেকে আনার চেষ্টা চালাচ্ছ নাকি! আজকাল আমি কি আর ক্লিনিক বা হসপিটাল কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না! যেখানেই যাই তোমার মেয়েদের দেখতে হয়। নয় নাম্বার ওয়ার্ডে সূচনা আছে।তুমি এসে ওকে নিয়ে যাও।।
*****
দিপেশ এর অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। জেলের ভেতর তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে। কথা ছিল রণক যদি বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলে দিপেশ জেলের ভেতর ভিআইপি অবস্থায় থাকবে। কিন্তু জেলে আসার পর থেকে দিলাত্রী সেনের হুকুমে জেল সুপার রাত নেই দিন নেই সব সময় নির্যাতন চালাচ্ছে তার উপর। শুকিয়ে নরকঙ্কাল হয়ে গেছে দিপেশ। এখানে থাকলে মৃত্যু অবধারিত। পালাতে হবে তাকে কিন্তু কীভাবে সম্ভব!
****
সেন বাড়িতে জমকালো আয়োজনের ভেতর দিয়ে হলুদের পর্ব শেষ হয়েছে রণক আর অতিক্ষার। অতিক্ষাকে এখন দেখতে হাসিখুশি মনে হচ্ছে। তার মুখে ভালোবাসা হারানোর দুঃখের ছাপ খুঁজে পায় না রণক। কিন্তু রণকের মুখ তার আর অরুনিকার বিচ্ছেদের দুঃখ স্পষ্ট। রণকের মনে প্রশ্ন জাগে। নারীরা কি তাহলে সত্যি সব কিছুতে মানিয়ে নিজের দুঃখ-কষ্ট আড়াল করতে পারে! অতিক্ষার থেকে নজর ঘুরিয়ে রণকের চোখ খুঁজছে দিলাত্রী সেনকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না অরুনিকার দেশে ফেরার খবর পাচ্ছে ততক্ষণ বিয়ে অসম্ভব তারপক্ষে। দিলাত্রী সেনের কাছে অরুনিকা আর আভাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব সে আগেই দিয়েছে। কিন্তু মায়ের আচরণ দেখে রণকের সন্দেহ হচ্ছে। দিলাত্রী সেন হয়ত তার প্রস্তাব মতো কাজ করবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রস্তাবটা আবার দিবে। যদি মেনে না নেয় তাহলে এখান থেকে পালানো ছাড়া তার আর কোন উপায়ও নেই। অরুনিকাকে বাঁচাতে হবে।
—মায়ের কাছে বসে রণক কাকুতি মিনতি করছে। যে করেই হোক চীন থেকে অরুনিকা আর আভাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর মা।
—এটা অসম্ভব রণক। কেটিভ থেকে কাউকে বের করে নিয়ে আসা এতো সহজ না। আর যেখানে ওই বেশ্যা নিজ ইচ্ছেতে গেছে সেখান থেকে ওরে ফিরে আনার প্রয়োজনটা কি! ওই বেশ্যা কলকাতাতে যে কাজ করবে এখন না হয় চীনে করল। সমস্যাটা কোথায় আমিতো এটাই বুঝিতেছি না।
—মায়ের সাথে কথা বলে রণক যে সময় নষ্ট করছে এটা স্পষ্ট। মনে মনে সে নিজেকে প্রস্তুত করে এখান থেকে সে পালাবে।
*****
মৃণালের এর উদ্দেশ্য মেয়েটি বলল, ধীরে কথা বলুন। জোরে কথা বললে আমি ধরা পড়ে যাব।
—মৃণাল ধীর স্বরে আবারও বলল আভা তুমি এখানে কীভাবে আসলে? ওদের হাত থেকে পালালেই বা কি করে?
—সে সব কথা না হয় পড়ে হবে। আমি তো আপনাকে চিনি না তাহলে আপনি কীভাবে আমাকে চিনেন?
—তোমার দিদি অরুনিকা আমার বন্ধু।
—দি-ভাই কি জানে আমি এখানে? অমল-দাদাই যে আমার দিদিকে পাচার করেছিল,এটা আমি জানতাম না। আগে যদি জানতাম তাহলে ওই শয়তান টার সাথে এখানে এসে ফাঁদে পড়তাম না।
—হ্যা, অরুনিকা সব জানে। অরুনিকা আর আমি দুজনেই এখানে তোমাকে আর মৃধাকে উদ্ধার করতে এসে ছিলাম। কিন্তু পারলাম না। আমি পারলাম না আমার মৃধাকে উদ্ধার করতে।
—দি-ভাই এখানে আছে! মানে তুমি বলতে চাচ্ছ তোমার মতো দি-ভাই এখানে বন্দী?
—হ্যা, তোমার দি-ভাই নিজ ইচ্ছায় বন্দী হয়েছে। আমাদের প্লান ছিল একজন ভেতরে থাকবে আর একজন বাইরে। কিন্তু এখন আমরা দুজনেই ভেতরে।
— আপনি বন্দী হয়েছেন কারন আপনি বোকা ছিলেন। আপনাকে ঈশারা করা স্বত্তেও আপনি বুঝেননি। আপনার উপর সন্দেহ করেই আমার শরীরে মাইক্রোফোন সেট করে পাঠিয়ে ছিল আপনার কাছে ।
—ঠিক বলেছ, আসলেই বোকা আমি। আমার জন্য অরুনিকার প্লানে জল পড়ছে। এখন আর কিছুই করার নেই আমাদের।
—কে বলছে কিছু করার নেই? আমি খোঁজ নিয়েছি। পেছনের একটা গেইট আছে ওখানে পাহারাদার থাকে না। দি-ভাই কে খুঁজে বেড় করে আমাদের পেছনের গেইট দিয়ে পালাতে হবে।
—মৃণাল মুচকি হাসছে। এখানে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়াই যেখানে অসম্ভব। সেখানে পেছনের গেইট দিয়ে পালানোর কথা বলছে এই মেয়ে।
—আপনি হাসছেন কেন!
—হাসছি তোমার কথা শুনে। যদি পালানো এতোই সহজ হতো তাহলে তোমার দি-ভাই হাতে হাত রেখে বসে থাকত না। অরুনিকা এখন চুপচাপ আছে। তার মানে সে নতুন কোন প্লান করছে। আমাদের উচিত অরুনিকার অপেক্ষা করা।
—আপনার কি মনে হয় সেই অপেক্ষার সময় আমাদের হাতে আছে। কোন এক ম্যাডাম আছে যার ভয়ে আপনাকে ডক্টর দেখান হলো। সেই ম্যাডাম যদি আপনাকে একবার মারবার হুকুম দেয়, তাহলে আপনি সোজা উপরে। আর আমি যদি এদের হাতে ধরা পড়ি তাহলে আমাকে পাঠানো হবে ভিআইপি রুম সার্ভিসে। শেষের কথা বলতে বলতে আভার চোখ ছলছল করে উঠে। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল আমি এইরকম জীবন চাইনা এর থেকে মৃত্যু ঢের ভালো।
—ভুল বললে আভা এখানে যদি তোমার মৃত্যু হয়। তাহলে তুমি দেহ পসারিণী হও বা না হও লোকে তোমাকে দেহ পসারিণী বলবে। তুমি কেটিভ এর বাইরে গিয়ে মরলে সমাজের বাকী নারীদের মতোই সম্মানিত শেষকৃত্য অধিকারী হবে।
—আভা ছানাবড়া চোখ করে বলল,গুলি তো পায়ে লেগেছে তাহলে মাথার সমস্যা হলো কি করে!
—কে বলছে তোমাকে আমার মাথার সমস্যা হয়েছে।
—কে আবার বলতে যাবে আমি তো চোখের সামনে দেখছি আপনাকে। আপনি একটা উম্মাদ। উম্মাদ না হলে ভুল ভাল কথা বলতেন না। আমি যদি কেটিভের বাইরেই যেতে পারি তাহলে কোন দুঃখে মরব!
******
উত্তেজনা নিয়ে অরুনিকা রুমের ভেতর পায়চারী করছে। নিজের মনে মনে সে চিন্তা করে, সে নিজে যে অভিশপ্ত জীবনে আছে এখন কি তাহলে আভাও। না না এটা হতে পারে না। তোকে ভাবতে হবে। ভাব অরু ভাব এখান থেকে কি করে বের হওয়া যাবে ভাব। নইত আভার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
— ঘরের ভেতর এক অসম্ভব সুন্দর বাঙালি নারীকে ঢুকতে দেখে পায়চারী থামায় অরুনিকা। ঘরের ভেতর ঢুকেই অরুনিকার কাছে এসে কোন ভনিতা ছাড়াই বলল, এখান থেকে আমি আপনাকে বের হতে সাহায্য করব। কিন্তু তার বদলে আমাকে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
—অরুনিকা ভাবে এটা আবার নতুন কোন ষড়যন্ত্র কি না অমলের। তাই সে মেয়েটির উদ্দেশ্য প্রশ্ন করল। তুমি কে!
—দেখুন পরিচিত হবার মতো সময় নেই। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি সব ব্যবস্থা করব।
—অরুনিকা বুঝতে পারে না তার কি বলা উচিত! যদি কেটিভ থেকে এই মেয়ে নিজেই বের হতে পারে। তাহলে কলকাতা নিজে কেন যেতে পারবে না!
—মেয়েটি বারবার পেছন দিকে তাকাচ্ছে। কেউ এসে পড়লে বিপদ। অরুনিকার উত্তরের অপেক্ষা যেন মেয়েটি করতে পাচ্ছে না। এইবার সে খপ করে অরুনিকার দুই হাত ধরে বলল, দেখুন আপনি কোন চিন্তা করবেন না।কেটিভ থেকে আপনাদের নিরাপদেই বের করে নিয়ে যাব। আপনি শুধু আমার কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন।
—অরুনিকা আর চুপ থাকতে পারে না। এবার সে প্রশ্ন করল। তুমি কেটিভ থেকে বের যদি হতেই পার তাহলে কলকাতা যেতে তোমার সাহায্যের কেন প্রয়োজন!
—কারণ একটাই পাসপোর্ট নেই। পাসপোর্ট নতুন করে করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন তাও আমার কাছে নেই। শুধু আমার কাছে কেন! এখানে কারো কাছে কেটিভের বাইরে এক দিন অতিবাহিত করার মতো টাকা নেই। শরীরে বিনিময়ে এরা আমাদের খাবার দেয় শুধু।
—অরুনিকা বলল, তুমি যদি সত্যি আমাদেরকে এখানে থেকে বের করে নিয়ে যেতে পার তাহলে কলকাতা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেব তোমাকে। তার আগে আমার বোন আভা কেমন আছে! এই খোঁজ নাও।
—মেয়েটি হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে নিয়েছে। তখন অরুনিকা তার নাম জিজ্ঞেস করল। মেয়েটি বলল, আমার নাম অক্ষরা- এই বলেই চলে গেল।

অরুনিকা অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির যাওয়ার পথে দিকে চেয়ে থেকে মনে মনে ভাবল। সে কি ঠিক শুনল! মেয়েটা টা কি সত্যি নিজের নাম অক্ষরা বলল?


অরুনিকা আর চিন্তা করতে পাচ্ছে না। সব কিছুই যেন জট বেঁধে আছে। এই জট ভদ্র সমাজের মুখোশধারী লোকেদের। জীবন তার সাথে অমানুষিক খেলা খেলেছে। আগে ভগবানের কাছে নালিশ করলেও এখন আর সে করে না। কিন্তু তার চোখের সামনে যখন সমাজের এই মুখোশধারী লোকেদের জন্য দিনের পর দিন অসহায় নারী -শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অসহায় নারীদের জন্য এই সমাজ কিছুই করে না। সমাজের আইনকানুন সব কিছুতেই এখন গলদ। গলদ যদি না থাকত তাহলে কি আর পাবলিক সার্ভেন্টের চোখের সামনে পাচারকারীরা দিনের পর দিন নারী-শিশুদের পাচার করতে পারত! সমাজ এখন কলুষিত। এই কলুষিত সমাজের অধিকাংশ লোকেরাই আমাদের মত নারীর জীবনের রদবদলের জন্য দায়ী। যদি তারা দায়ী না হতো তাহলে মৃধা বা অক্ষরা কেন এই কেটিভে অবস্থান করেছে। আভাই বা এই কেটিভের অংশ হতে চলেছে কেন! হায় ভগবান তোমার কাছে কি কোন উত্তর আছে?
—অরুনিকার বুক মুচড়ে এক ধাক্কায় কান্না চলে এলো গলায়। চোখ ছলছল করছে। সে শুধু চায় তার বোনকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে দূরে নিয়ে যেতে। ধৈর্য যে সে আর ধরতে পাচ্ছে না। অক্ষরার অপেক্ষা সে অধীর আগ্রহে করছে।
***
—অক্ষরা আজ মনের আনন্দে কাস্টমারদের সার্ভিস দিচ্ছে। এই কেটিভে আশার আলো পাওয়া অসম্ভব এক স্বপ্ন। কিন্তু কেন জানি এখন তার কাছে সম্ভব মনে হচ্ছে। প্রায় এক যুগ হলো এই কেটিভে সে আছে। যৌবনে পদার্পণের সাথে সাথেই তাকে এই কেটিভে পাঠানো হয়েছিল। রাতের পর রাত কেটিভকে সে আলোয় সাজতে দেখেছে। কিন্তু সেই আলো এখানকার সব নারীর জন্যই ছিল অন্ধকার। কেটিভ থেকে পালানোর চিন্তা সে অনেকবার করেছে কিন্তু কখনো পালানো আর হয়ে ওঠেনি। চোখের সামনে কত নারীকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মরতে দেখেছে সে। কারণ একটাই টাকার অভাবে কেটিভ থেকে খুব বেশি দূরে কেউই যেতে পারত না।
—ভোর রাতের দিকে নিজের কাস্টমারকে বিদায় করে সে লুকিয়ে এলো অরুনিকার ঘরে। অরুনিকা তখন ঘুম। সারারাত বোনের চিন্তাই ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণ আগেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
—অক্ষরা আস্তে আস্তে ডাক দিল। এই যে শুনছেন! উঠুন।
—অরুনিকা পিটপিট করে তাকাল। অক্ষরাকে দেখেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বলল, তুমি এসেছ! আমি সারারাত তোমার অপেক্ষা করেছি। আভার কোন খোঁজ পেলে? মনের ভেতর একটা খারাপ আশংকা নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে অরুনিকা বলল, ওর কোন ক্ষতি তো হয়নি?
—অক্ষরা বলল, আপনি অস্থির হবেন না। আপনার বোন পালিয়েছে। কোথায় আছে সে খোঁজ এখনো পাইনি। সবাই আপনার বোন'কে খুঁজতেই ব্যস্ত। সে নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। কারণ সে যদি না পালাত তাহলে তাকেও আমাদের সাথেই ভিআইপি সার্ভিসে পাঠাত।
—পালিয়েছে তার মানে কি বলতে চাচ্ছ সে এই কেটিভে এখন নেই?
—কেটিভ থেকে পালানো সহজ না। সে কেটিভেই আছে।
—আভা যে কেটিভে আছে তুমি এত শিউর হলে কীভাবে? হতেই তো পারে সে কেটিভ থেকে দূরে পালিয়েছে।
—শিউর হচ্ছি কারণ কোন মৃত্যুর খবর কানে আসেনি। বেশির ভাগ মেয়েরা কেটিভের পেছন দরজা দিয়ে পালায়। এটাই কেটিভের পাতানো ফাঁদ। পেছনে দরজায় কোন পাহারাদার থাকে না। এটা সবার চোখেই পড়ে। যেটা চোখে পড়ে না সেটা হলো পেছনের দরজায় চব্বিশ ঘণ্টা গুপ্ত পাহারাদার থাকে। পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি করে মেরে ফেলে।
—অক্ষরার কথা শুনে অরুনিকা ভয় পেয়ে ঢুকি চিপে বলল, তুমি কি এখানে আমাকে ভালো খবর শুনাতে এসেছ নাকি ভয় দেখাতে!আমার আভা যদি পেছনের দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে!
—আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি তার আগেই ওকে খুঁজে বেড় করব।
—অরুনিকা কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে কথা ঘুরিয়ে নিজের মনের সন্দেহ দূর করতেই প্রশ্ন করে বসল। তুমি কি দিপেশ নামে কাউকে চেনো?
—দিপেশ নাম শুনতেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে অক্ষরার। ঠোঁট ঈষৎ কাঁপতে থাকে। চোখ ছলছল করে উঠে। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চায় না। কত বছর পার হয়ে গেছে এই নামটা মনের ভেতর থাকলেও কানে কখনো শুনতে পারেনি। কেউ এই নামটা মুখে তুলেনি সে শুনবে কি করে! আমতাআমতা করে সে বলল, আপনি নামটা আর একবার বলবেন!
—অরুনিকা স্বাভাবিক ভাবেই আবার বলে ওঠে। বললাম তুমি কি দিপেশ নামে কাউকে চেনো?
—এইবার নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না অক্ষরা। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে জড়িয়ে ধরে অরুনিকাকে আর ব'লে ওঠে, এই নামটা যে আমার কাছের মানুষের। কত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেছি কিন্তু এই নাম আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষের নাম যে দিপেশ।
—অরুনিকা পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে অক্ষরাকে। তারপর অরুনিকা বলল, তুমি এখানে কি করে? আমি তো শুনেছি তোমাকে নাকি ভূমেন্দ্র সেন ধর্ষন করে মেরে ফেলেছিল।
—অক্ষরা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, মিথ্যা। বাবা সমতুল্য মানুষ এই কাজ করবে কি করে! আপনি এতো কিছু জানেন কি করে? দিপেশ আপনার কি হয়? আচ্ছা এমনটা না তো আপনি দিপেশের-
—অক্ষরার ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে অরু বলে ওঠে। আরে না না। তুমি যেমন ভাবছ তেমন কিছুই না।
—তাহলে আপনি দিপেশকে কীভাবে চিনেন! আর যেহেতু দিপেশকে আমি চিনি কি না এই প্রশ্ন করেছেন তার মানে আপনি আমাকেও চিনেন।
— না আমি তোমাকে চিনি না। দিপেশকে চিনি কারণ রণক আমার কাস্টমার ছিল। সেই সূত্রে দিপেশকেও চিনতাম।
—তাহলে আমাকে কীভাবে চিনেন!
—তোমাকে চিনি না। তোমার নামটার সাথে শুধু পরিচিত এই আর কি।
—আর কথার জাল বুনবেন না। আমার হাতে সময় নেই। আমাকে সবটা খুলে বলুন।
—আচ্ছা বলছি শুনো। ঘটনা ক্রমে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রণকদের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে রণকের মুখে তোমার নাম শুনেছি। পড়ে তোমার নামে যে মেয়েটিকে দেখেছিলাম সেই মেয়েটি ছিল আমার পূর্বপরিচিত। আমাকে অপহরণ করা হয়। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে পূর্বপরিচিত ফিরোজাকে সামনে দেখে অবাক হয়ে যাই। ফিরোজা কবে থেকে অক্ষরা হলো। এই প্রশ্ন মনে আসে। তখন উত্তর না পেলেও পড়ে জানতে পারি। ভূমেন্দ্র সেন নাকি তোমাকে ধর্ষন করে মেরে ফেলেছিল। দিপেশ তাই নিজের মায়ের মৃত্যু আর তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই পতিতালয় থেকে ফিরোজাকে অক্ষরা ভূমিকায় অভিনয় করতে নিয়ে আসে ভূমেন্দ্র সেনের অনুপস্থিতিতে।
—তুমি এই সব কি বলছ! দিপেশ কি পাগল হয়ে গেছে? নিজের বাবার সম্পর্কে এত বড় ভুল ধারণা সে মনে আনে কি করে! আমার সাথে যা কিছু হয়েছে তার জন্য দায়ী দিলাত্রী সেন। কারণ আমি জেনে গেছিলাম দিপেশ আর ঊষা ভূমেন্দ্র কাকা আর রমা কাকির সন্তান। রামা কাকিমা'কে হত্যা করেছিল দিলাত্রী। মৃত্যুর সময় আমাকে রমা কাকিমা সব সত্য বলে যায়। এই সত্য দিপেশ অব্দি পৌঁছানোর সময় পাইনি কারণ পথিমধ্যে আমাকে অপহরণ করা হয়।
—অরুনিকা বলল, তার মানে তুমি জানতে ঊষা রণকের বোন না!
—হ্যা, আমি রমা কাকীমার কাছেই বড় হয়েছি। রমা কাকীমা নিজেও জানত না ঊষা তারই মেয়ে। মারার আগে কাকিমাকে দিলাত্রী এই সত্য বলেছিল।
—আমি তো শুনেছি দিপেশের মা ভূমেন্দ্র সেনের গ্রামের বাড়িতেই থাকত। তাহলে তুমি দিপেশের কাছে খবর দিতে কোথায় যাচ্ছিলে যে পথিমধ্যে অপহরণ হও।
—কে বলেছে কাকিমা ওই বাড়িতে থাকত! কাকিমার মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার খবর শোনার পর থেকে ভূমেন্দ্র কাকা আর কখনো কাকীমার খোঁজ নেননি। তখন দিলাত্রী কাকিমাকে আর আমাকে উনার বাপের বাড়ির গ্রামে নজর বন্দী রাখে।
—অরুনিকা সব শোনার পর বলল, এখন বুঝেছি। এই জন্য রণক তোমার নাম জানালেও তোমাকে চিনত না। তাই দিপেশ খুব চালাকি করেই সময় বুঝে ভূমেন্দ্র আর দিলাত্রী অনুপস্থিতিতে ফিরোজাকে অক্ষরা সাজিয়ে রণক আর ঊষার সামনে নিয়ে আসে। হায় ভগবান আগে যদি রণক দিপেশের চক্রান্ত ধরতে পারত তাহলে হয়ত আজ ঊষা বেঁচে থাকত।
******

বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে অতিক্ষা। আজ তার বাসর রাত কিন্তু নিজের এই প্রথম রাত বিসর্জন দিয়েছে স্বামীকে সাহায্য করতে গিয়ে। চোখ ছলছল করে উঠে। মেহেদী দেওয়া হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে অতিক্ষা। সে পুণ্যের কাজ করেছে এতে দুঃখ পাওয়ার মতো কিছুই নেই। একটা মেয়ের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য সে না হয় তার জীবনের এই প্রথম রাতটা বিসর্জন দিল। সে রণককে বিশ্বাস করে। রণক অরুনিকা আর আভাকে বাঁচাতে গেছে ঠিকই কিন্তু তাকে ছেড়ে যায়নি এই বিশ্বাস অতিক্ষার আছে। তাই তো সে শাশুড়ীর পইপই করে বলা স্বত্বেও রণককে বাসর ঘরে আটকে না রেখে পালাতে সাহায্য করছে।


সকাল থেকেই অমল চিন্তিত। পায়চারি করছে আর দাঁতে নখ কাটছে। এখনো আভার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এইদিকে কলকাতা থেকে ম্যাডাম বারবার ফোন দিচ্ছে। আভার খবরাখবর জানতে চাচ্ছে। কিন্তু অমল কি জবাব দিবে? আভাকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! নাকি নাকি বলবে আভা পালিয়েছে! আচ্ছা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর আভা পালিয়েছে দুটোর মধ্যে কি কোন পার্থক্য আদৌও আছে? নাকি সে পাগল হতে চলছে! মাথায় কেন কিছু আসছে না! আভা কেটিভের বাইরে বের হতে পারেনি এটা শিউর তাহলে কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! উফফ আর এক কথা ভাবতে ভালো লাগছে না।
নিজের উপর একগাদা বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে সে বের হলো মৃণালের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যাকে দিয়ে ব্যবসা হবে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর এই দিকে অকাজের পুরুষের যত্ন নিতে হচ্ছে। মৃণালের সাথে ম্যাডামের সম্পর্কটা কি অমল তা হাজার চিন্তা করেও কোন কূলকিনারা পায়নি।
ডক্টর মৃণাল এখন বেশ সুস্থ। আভা তার ভালো যত্ন নিচ্ছে। কেটিভে এইভাবে সে লুকিয়ে থাকতে পারবে সত্যি ভাবা যায় না। মৃণালের সাথে আভার গল্প করেই সময় কেটে যায়। যখন বাইরে কারো উপস্থিতি টের পায় তখন বাক্সে লুকিয়ে পড়ে। আভার এমন লুকোচুরি মৃণাল উপভোগ করে। মেয়েটা যে এমন পরিস্থিতিতেও স্বাভাবিক আছে এটাই বেশি অবাক করে মৃণালকে। যে কোন মেয়ে এমন পরিস্থিতিতে ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকবার কথা কিন্তু সেই যে প্রথম রাতে শুধু তাকে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে দেখেছে মৃণাল তারপর থেকে মেয়েটি একদম স্বাভাবিক।
—বাইরে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরেই চটজলদি আভা বাক্সে উঠে নিজকে কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল। অমল ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল। কি ডাক্তার তলে তলে এতো দূর? আমাদের ম্যাডামকে কী জাদু করে রেখেছিস তোর এতো যত্নআত্তি করছে।
—অমলের কথার অর্থ মৃণাল বুঝতে পারে না। সে কথা ঘুরিয়ে বলে আমাকে তুই একবারে জন্য মৃধার সাথে দেখা করা প্লিজ।
—এটা সম্ভব না দোস্ত। তুই অন্য কিছু চাইতে পারিস।কারণ হুকুম আছে তোর যাবতীয় প্রয়োজন যেন মেটানো হয়। অমলের কথার মাঝে একজন এসে কানে কিছু একটা বলতেই সে চলে গেল।
— আভা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা এমনটা না তো কেটিভের ম্যাডাম আপনার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কথা শেষ করেই হাসলো আভা। আর ঠিক তখনি ঘরে ঢুকলো অক্ষরা।
—অক্ষরাকে দেখে ভয়ে চুপসে যায় আভা। মৃণালের সাথে ঠাট্টা করতে নিয়ে আভা দরজার দিকে একদম লক্ষ রাখেনি। ধরা পড়েছে মনে করে চোখ ছলছল করে উঠে আভার। মৃণাল বা আভা কিছু বলার আগেই অক্ষরা বলে ওঠে। এতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। মৃণালের উদ্দেশ্যে অক্ষরা বলল, আমি এসেছিলাম অরুনিকার হয়ে আপনার কাছে কিন্তু এখানে এসে আভাকে পেয়ে সত্যি ভালো লাগছে। তা তোমাকে চারিদিকে এই জানোয়ারেরা হন্যে হয়ে খুঁজছে আর তুমি এখানে! আমি নিজেও তোমাকে খুঁজছিলাম।
—অক্ষরার কথা শুনে মৃণাল জিজ্ঞেস করল। অরুনিকা আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে?
—হ্যা, আমাকে অরুনিকা পাঠিয়েছে। এখানে বলতে এসে ছিলাম আভাকে খুঁজে না পাওয়া পযন্ত অপেক্ষা করুন। কিন্তু যখন উনাকে পাওয়া গেছে তখন আপনারা তৈরি থাকবেন ভোরের দিকে আপনাদের নিতে আসব। এই বলেই অক্ষরা চলে গেল। মৃণাল বা আভা দুজনের কেউই এই অক্ষরার কথা বিশ্বাস করল না। তাদের কেবলই মনে হলো এটা নতুন কোন ষড়যন্ত্র।
*****
দিলাত্রী সেনের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতিক্ষা। দিলাত্রীর চোখে দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। উনি বললেন, বিয়ের পড়ে সব কিছু স্বাভাবিক হয়েছে মনে করে পাহারাদার সরানো ভুল হয়েছে। রণক পালিয়েছে এই খবরটা বেকুব মেয়ে তুমি যদি রাতেই দিতে তাও হয়ত কিছু একটা করা যেত কিন্তু এখন তা আর সম্ভব না। অতিক্ষার দিকে আবারও তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, তোমার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? ফুলসজ্জা ছেড়ে স্বামী কই যাচ্ছে এটার খোঁজ রাখতে পার না? গেছে তা না হয় বুঝলাম রাতারাতি আমার কাছে খবরটা না নিয়ে এসে এতক্ষণে তোমার সময় হলো!
যখন অতিক্ষার উপর চেঁচাচ্ছিল দিলাত্রী তখন থানা থেকে এক কনস্টেবল এসে খবর দিয়ে গেল গত রাতে দিপেশ পালিয়েছে। খবরটা শোনা মাত্র ধপাস করে উনি বসে পড়লেন। বিড়বিড় করে বললেন, না এটা হতে পারো না। আমার এত দিনের প্লানে জল পড়তে পারে না। রণক আমাকে ঠকাতে পারেনা। সে কি নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন নয়? ভূমেন্দ্র পাপ হলো দিপেশ। সব কিছু জেনে শুনে সে কীভাবে ভূমেন্দ্র চলা পথেই চলতে পারে! অতিক্ষা দৌড়ে যায় তার শাশুড়ী মায়ের কাছে। মা কি হয়েছে আপনি ঠিক আছেন? দিলাত্রী সেন চিৎকার করে অতিক্ষাকে বেরিয়ে যেতে বলে একদম চুপ হয়ে গেল। এ যেন ঝড় উঠবার আগ মূহুর্তের পরিবেশে। অতিক্ষা দিলাত্রী সেনের এমন ধমক দিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া দেখে ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর তার কিছুক্ষণ পরেই দরজা বন্ধ করে দেয় দিলাত্রী।
******
আভা আর মৃণাল ভালো আছে। মৃণালকে যে ঘরে রাখা হয়েছে আভা যে সেই ঘরে লুকিয়ে আছে এই খবর পেয়ে অরুনিকার মন এখন শান্ত। তাই আজ সে নিজের নতুন প্লান অনুযায়ী অমলের সাথে শুতে চেয়েছে। শুতে চাওয়ার কথা শুনে অক্ষরা বেশ অবাক হয়ে যায় সেই সাথে বিরক্তি প্রকাশ করে। একটু গোলমেলে হয়ে গেলে এখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
—অরুনিকা তখন বলল,তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার। এখান থেকে আমারা বের হব। তুমি সবাইকে নিয়ে ভোরবেলা যাবার সময় অমলের ঘরে তিনবার টোকা দিবে।আমি আমার কাজ শেষ করে অপেক্ষা করব ওখানেই।
—অক্ষরার আপত্তি থাকা স্বত্বেও অরুনিকার কথা মতো সে যা চেয়েছিল সেটা নিয়ে এসেছে অরুনিকার চুল সযত্নে বেঁধে দিতে দিতে বলল, আমি এখান থেকে বের হতে চাই। আপনি আমার আশায় জল ঢালবেন না আশা করি। অক্ষরার সাথে কথা শেষ করে নিজেকে অমলের কাছে নিবেদন করতে সে তৈরি হয়ে অমলের ঘরের এসেছে।
—অরুনিকাকে দেখে অমল বলল, হটাৎ তোমার কি হল যে তুমি নিজের থেকেই আমার কাছে আসলে?
—কিছুই হয়নি। আমি তোমার কাছে মিনতি করতে এসেছি। আমার বোন তো তোমার বোনের মতোই। ওকে তুমি ছেড়ে দাও। আমি সারাজীবন তোমার ইচ্ছেই চলব।
—অমল বিড়বিড় করে বলল, যার কোন খোঁজ পাচ্ছি না তাকে আবার ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! তারপর অরুনিকার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, কাকুতি মিনতি পরেও শোনা যাবে এই মধ্যে রাতে আগে আমাকে তৃপ্ত কর। অমল অরুনিকার শরীর থেকে এক টানে কাপড় খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। অরুনিকার উলঙ্গ শরীরে দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলল, আমি ভেবেছিলাম মারতে এসেছ।
অরুনিকা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, মারতেই তো এসেছি আমার শরীরে আগুন তুমি এমনি জ্বলে যাবে।
—অট্ট হাসি দিয়ে নিজের বুকে অরুনিকাকে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গভীর চুম্বনে ডুবে যায় অমল। ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে অমল হাতের ঈশারায় ঘরের ভেতর থাকা দুই পাহারাদারকেরকে চলে যেতে বলে। কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে অরুর সুডৌল স্তনের মুখ গুঁজে অমল।
— অমলের শরীর থেকে সুখ প্রাপ্তির ঘাম ঝরে পড়ার পর বিছানায় যখন সে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে আছে ঠিক তখনি অরুনিকা তার চুলের সুরু কাটা বেড় করে অমলের শিশ্নে বসিয়ে দেয়।

—অমলের আর্তনাদ করার পূর্বেই বিছানায় পড়ে থাকা তার ফোমের অন্তর্বাস মুখে গুঁজে দেয়।


অমল ব্যথাই কুঁকড়ে যায়। নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়েও অরুনিকাকে ধাক্কা দিয়ে বেশি দূরে সরিয়ে দিতে পারে না অমল। অরুনিকা এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে অমলের শার্ট দিয়ে ওর হাত বেঁধে দেয়। তারপর অমলের সামনে শান্ত হয়ে বসে দম টেনে বলল, এখন চল কথা বলি। সুখ প্রাপ্তির কথা। কেমন লাগছে এই সুখ? এই শিশ্ন আর কখনো দাঁড়াবে না। কোন নারী আর এর শিকার হবে না। অরুনিকার চাহনিতে অদ্ভুত এক মাদকতা।
—অমল চোখে তখন অন্ধকার দেখছিল। তার শিশ্ন থেকে তখন গলগল করে রক্ত পড়ছে বিছানায়। অরুনিকা আশেপাশে তাকাতেই চোখে পড়লো বেড সাইড টেবিলে একটা রিভলবার রাখা। হাতে তুলে নিতে নিতে বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোকে পড়ে থাকতে দেখে। তোর পুরুষত্ব কাহিনী তো শেষ এখন আছে জীবন ওটাও কিছুক্ষণের ভেতর থাকবে না।
—অমলের মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরুলো না। অরুনিকা তখন বলেই চলছে। আমার দোষটা কোথায় ছিল বলতে পারিস তুই ? আমার জীবন শেষ হয়েছে সেই সাথে পরিবার। রাতের অন্ধকারে যে আমি কি না পরিবারের কথা চিন্তা না করে ভালোবেসে তোর সাথে বেরিয়ে এসেছিলাম । সেই তুই কি না আমাকে বিক্রি করে দিলি? জানিস প্রথম প্রথম আমার কত কষ্ট হচ্ছিল? ওরা আমার শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছিল। একজন যেতে আরও একজন তারপর আরও একজন আবার আবার আবার চলছে তো চলছেই যেন এ কোন শরীর নই।
এখন আমি তোর শরীর নিয়ে খেলব এই বলেই শিশ্ন থেকে এক টানে সুরু কাটা বেড় করে নিয়েই এবার বসিয়ে দেয় চোখে। সঙ্গে সঙ্গে অমলের চোখের মণি থেকে ফিনিক দিয়ে রক্তের সাথে কালো তরল ছিটকে আসে অরুনিকার মুখে। চোখ বন্ধ করে নিজের মুখ মুছে তৃপ্তির হাসি হাসে অরুনিকা। তারপর অরুনিকা পাগলের মতো সুরু কাটা তুলে আর শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায় অমল। বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত অমলের নিস্তেজ শরীর দেখে এবার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে অরুনিকা। এই অশ্রু তার প্রতিশোধের জয় প্রাপ্তির কিন্তু বেশিক্ষণ এই সুখের অশ্রু থাকল না। গা গুলিয়ে বমি আসে অরুনিকার। কোন মতো সামলে মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড় পড়ে দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকালো। ভোর হতে আরও আধাঘন্টা। বাইরে গানের উচ্চ ভলিউমের সুযোগ নিয়ে সে রিভল দিয়ে অমলের নিস্তেজ শরীরে গুলি করে। সে জানত বড়জোর এই গুলির আওয়াজ দরজার বাইরে থাকা ওই দুই পাহারাদার শুনতে পারবে। ওরা ছাড়া আর কেউ শুনতে পারবে না। গুলি করেই সে দরজার পেছনে এসে দাঁড়ায় অরুনিকা।
—গুলির আওয়াজে বাইরে থাকা পাহারাদার হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে ভেতরে আসতেই দরজা বন্ধ করে পেছন থেকে অরুনিকা আরও দুটি গুলি চালায়। পাহারাদার এর শরীর মেঝেতে লুটে পড়তেই সে দরজা একটু খুলে বাইরে দেখেনিল। না আর কেউ এইদিকটাই এখন আসবে বলে মনে হচ্ছে না। সে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ঘরের ভেতর এখন তিনটে লাশ পড়ে আছে। ভগবান যে এইভাবে অরুনিকার প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করবে সে কখনো কল্পনাও করেনি।
—ঘড়ির দিকে আবারও তাকালো। এখনো খানিকটা সময় আছে। অস্থির অস্থির লাগছে অক্ষরা সবাইকে নিয়ে আসতে পারবে তো! সে যদি গোপন পথটা চিনত তাহলে সে নিজেই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু অক্ষরা সবকিছু বললেও গোপন পথ আসলে কোথায় তা বলেনি। হয়তো সে ভেবেছে গোপন পথের কথা জানলে ওকে না নিয়েই আমরা পালিয়ে যাব। অরুনিকার হটাৎ মনে পড়ে আচ্ছা মৃধার কথাতো শোনায় হয়নি। অক্ষরা কি তাহলে মৃধার খোঁজ নেয়নি! মৃধাকে ছাড়া এখান থেকে যাওয়া অনুচিত হবে। ডক্টর মৃণাল তাকে পদে পদে সহয়তা করেছে। অরুনিকার আবার গা গুলিয়ে বমি আসে।
—দরজায় তিনবার টোকা পড়তেই সে উঠে দাঁড়ায়। দরজা অল্প খুলে সে দেখল অক্ষরা তার পাশেই দাঁড়িয়ে আভা। আভাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় অরুনিকা। দরজা পুরোপুরি খুলে জড়িয়ে ধরে আভাকে। আভার সারা মুখে চুমু খেয়ে অরুনিকা জিজ্ঞেস করে তুই ঠিক আছিস?। পেছন থেকে অক্ষরা চাপা কন্ঠে বলল, এখানে এই সব করা ঠিক হবে না। যেকোনো মূহুর্তে ছোট স্যারের খোঁজে এখানে লোক আসতে পারে। অরুনিকা মাথা নাড়িয়ে ডক্টর মৃণালের দিকে তাকায়। মৃণালকে জড়িয়ে ধরে ব'লে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ডক্টর মৃণালের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল মৃধা। অক্ষরা যে মৃধাকেও সাথে এনেছে তা দেখে অরুনিকা কৃতজ্ঞতা নজরে তাকায় তার দিকে।
—আভা ঘরের ভেতর উঁকি দিতে নিলে অরুনিকা আটকায় দরজা লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, অক্ষরা পথ দেখাও তুমি।
অক্ষরা সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অমলের ঘরের এক ঘর বাদেই স্টোর রুমে ঢুকে। পেছন থেকে ডক্টর মৃণাল বলল, আমরা এখানে কেন আসলাম। স্টোর রুমে কি এখন লুকিয়ে থাকব নাকি?
—অক্ষরা মাথা নাড়িয়ে না বলল। মেঝের উপর ভাজ করে রাখা এক ময়লা কার্পেট সরাতেই দেখা গেল। নিচে সরু সিঁড়ি নেমে গেছে। তখনি মৃণাল বলল, এটা কেমন জায়গা! যেদিন প্রথম আসলাম সেইদিন কিচেনের ভেতর সিঁড়ি নিচে নেমে গেছিল। মানে আমরা অলরেডি মাটির নিচেই আছি। আর এখানে দেখছি আরও একটা সিঁড়ি। তখন মৃধা বলল, আসলে এখানে মাটির উপর স্বাভাবিক হোটেল আর পুলিশের নজর এড়িয়ে নিচে করা হয়েছে অন্ধকার রাজ্য। সব গুলো হোটেলের নিচেই এমন পতিতালয় আছে। আর পালাতে হলে এই রাস্তা কেটিভে শহরের একেবারে বাইরে নিয়ে যায়। এই দিক দিয়ে পাচারকারী চক্র মেয়ে নিয়ে আসে। মৃধার কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।
—বাইর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি আওয়াজ ভেসে আসছে। অমলের মৃত্যুর খবর তার মানে ছড়িয়ে পড়েছে। অক্ষরা সবাইকে চোখের ঈশারায় আওয়াজ করতে মানা করে। তারা সবাই একে একে নিচে নেমে যায়। অক্ষরা নামার সময় কার্পেট আবার ঠিক মতো জায়গায় বসে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে চার-পাঁচ ধাপ নিচে নামতেই মাটির সুরু রাস্তা পাওয়া গেল। মাটির নিচে দীর্ঘ সেই পথ তারা পারি দিয়ে যখন উপরে আসল তখন দেখল একটা খোলা ছোট্ট মাঠ। চারিদিকে যা জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গল ভেদ করে সামনে লেক আর তার পড়েই রাস্তা। রাস্তা দেখেই অরুনিকার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। চীনে এসে প্রথমে তারা যে হোটেলে উঠেছিল গাড়ি নিয়ে তারা সেই হোটেলে ফিরে আসে।
—হোটেলে ফিরেই আভা তার দি-ভাইকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, আমি কল্পনাও করিনি আমরা ওই কেটিভ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অরুনিকা অক্ষরার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি না থাকলে ভাই আমরা হয়তো কোনদিন বের হতেই পারতাম না। কারণ আমার যে লোকেরা ছিল তারা ওই গোপন পথের কথা জানত না।
—মৃণাল তাকিয়ে আছে মৃধার দিকে। কারণ মৃধার সাথে তার এখনো কথা হয়নি। অক্ষরা যখন মৃধাকে নিয়ে তার সামনে আসে তখন সে জড়িয়ে ধরতে নিলে মৃধা সরে গিয়ে অক্ষরাকে তাড়া দেয়। মৃণাল নিজেকে এখন আর ধরে রাখতে পারে না। সে মৃধার হাত ধরে হেঁচকা টানে বুকে নিয়ে কেঁদে ওঠে। অরুনিকা তখন বলল, মৃণাল তুমি মৃধার সাথে কথা বল। আমরা পাশের রুমে যাচ্ছি। অরুনিকার পেছন পেছন আভা আর অক্ষরা বেরিয়ে যায়।

—মৃণালের কান্না দেখে মৃধাও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে মৃধা।এতগুলি বছর বাদে সে তার দাদাকে এতো কাছে পেয়েছে।   


To be continued.....


গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)

পার্ট:-১৩
লেখনীতে: সামিনা সামি

Post a Comment

0 Comments