Header Ads Widget

Responsive Advertisement

নিষিদ্ধ নারী - শেষ পর্ব

 অক্ষরার কলকাতার ফেরার ব্যবস্থা করতে গিয়ে এয়ারপোর্টেও যেতে হলো মৃণালকে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় রণকের সাথে। সন্ধ্যাই রণককে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসলে অবাক হয়ে যায় অরুনিকা। তুমি এখানে কি করছ?

—এখানে কি করবো? কথা হয়েছিল কেটিভ থেকে বের হয়ে ফোন করে জানাবে। এতো দিনেও যখন ফোন পাইনি তখন বাধ্য হয়ে আসতে হলো। তাও ভাগ্য ভালো এয়ারপোর্টে মৃণালের সাথে দেখা হলো নয়তো কেটিভে গিয়ে বিপদ ডেকে আনতাম।
—রণককে দেখে আভা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ঠিক যেন বড় দাদার মতো।অরুনিকার ভালো লাগে এই দৃশ্য।
— পাসপোর্ট পেতে দুইদিন লাগলো। এই দুইদিন রণকের সাথে একান্ত কথা বলার সুযোগ পায়নি অরুনিকা। কেটিভের ঘটে যাওয়া সব কাহিনী আভা রণকের সাথে গল্প করে। আর অরুনিকার সময় কাটে মৃধাকে বোঝাতে। মৃধা মৃণালের সাথে বাড়ি ফিরবে না এই জেদ নিয়েই সে বসে ছিল। অরুনিকা ওর সাথে কথা বলে বুঝিয়েছে। এই দেশে কি ঘটেছে তা ওই দেশে কেউ জানবে না। একটা গল্প বানিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছে বললে তারা ওই গল্পই বিশ্বাস করবে। এই সমাজের মানুষের এতো সময় নেই যে তারা গল্পের সত্যতা যাচাই করবে। হয়তো নানান প্রশ্ন উঠবে তা উঠতেই পারে সেই গুলো যদি এক কানে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করা যায় তাহলে সমস্যা ওখানে চুকিয়ে যাবে।



—ফ্লাইটের ভেতর অরুনিকা মনে পড়ে এখনো রণকের সাথে অক্ষরার পরিচয় করানো হয়নি।তাই রণকের সাথে পরিচয় করে দেয় অক্ষরাকে। পরিচয় হবার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই রণক বলল, দিপেশ জীবনে অনকে কিছু হারিয়েছে এবার না হয় কিছু ফিরে পাবে।
—রণকের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অরুনিকা। রণকের এমন নির্লিপ্ত ভাব অরুর চোখ এড়াতে পারেনা। সে তাই প্রশ্ন করল। কি হয়েছে তোমার?
—কিছুই হয়নি।
—তাহলে অক্ষরাকে দেখে অবাক হলে না যে!
—কেন অবাক হওয়ার কথা ছিল বুঝি!
—না, তা বলছি না কিন্তু কোথায় পেলাম তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না?
—রণক মাথা নাড়িয়ে বলল, না।
—অরুনিকা রণকের দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রশ্নের উত্তর শুধু "না" হতে পারে না।
—অরুনিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রণক বলল, আমি আর কোন কিছুতেই কৌতুহল হতে পারছি না। এই এক বছরে জীবনে এত কিছু ঘটেছে যা আমার কল্পনারও বাইরে। অক্ষরার পেছনেও নিশ্চয়ই আমার মায়ের হাত রয়েছে। তাই ওকে দেখে অবাক হয়ে নিজের মায়ের কুকীর্তি শোনার ইচ্ছে আর নেই আমার।
—অরুনিকা আর কিছুই বলে না। মনে মনে সে উশখুশ করছিল কখন নিজের প্রেগনেন্সির খবর টা রণককে শোনাবে। কিন্তু রণকের নির্লিপ্ত ভাব দেখে অরুনিকার বলার ইচ্ছে দমিয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে। তখন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে রণক বলল, আমাকে ক্ষমা করে দাও।
—অরুনিকা চোখ খুলে রণকের দিকে তাকিয়ে বলল, হটাৎ ক্ষমা কেন চাচ্ছ বুঝতে পারলাম না।
—নিজেকে মনে মনে শক্ত করে মাথা নিচু করে রণক আবার বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমাদের রাস্তা আলাদা হ'য়ে গেছে। আর চাইলেও কোনদিন এক হতে পারব না। আমাকে জোর করা হয়েছে বিয়েতে তা না বলে রণক বলল, আমি বিয়ে করেছি। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো রণক। চোখ তুলে তাকল অরুনিকার দিকে।
—এতক্ষণে অরুনিকা পাথরের মতো শক্ত হ'য়ে গেছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না। রণকের চোখে চোখ পড়তেই রণক চোখ সরিয়ে নিল। অরুনিকার তখন বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে কান্না যেন ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চায়। কিছুক্ষণ আগ অব্দি কথার ছলে তাদের ভালোবাসার অংশে যে পৃথিবীতে আসতে চলছে সেই খবর বলার জন্য উশখুশ করছিল অরুনিকা কিন্তু এখন সে শুধু জিজ্ঞেস করলো। তাহলে চীনে এসেছিলে কেন!
—তোমরা বিপদে আছো যেনে স্বস্তিতে থাকতে পারিনি তাই।
—এরপর অরুনিকা আর কিছু বলেনি।
********
রণকের যাওয়ার পর থেকেই অতিক্ষা দিলাত্রী সেনের আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে কিন্তু দিলাত্রী সেন কোন কথা বলেনি।
—আজ বারান্দায় বসেছিলেন দিলাত্রী। রণককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে দৌড়ে এসে শাশুড়ীকে সেই খবর দিল অতিক্ষা। রণকের আসার কথা শুনে নড়েচড়ে বসে দিলাত্রী বললেন, ওকে আমার কাছে আসতে বল।
—অতিক্ষার আর ডাকতে যেতে হয়নি। কারণ রণক বাড়িতে ঢুকে সোজা মায়ের কাছেই এসেছে।
—কথা কি ছিল? নিশ্চয়ই মনে আছে।
—মনে আছে দেখেই ফিরে এসেছি।
—ফিরে এসে কি ভাবছিস কোন অন্যায় তুই করিসনি?
—আমার মনে হয় না অন্যায় করেছি। যাদেরকে বাঁচাতে গিয়ে ছিলাম আমার প্রয়োজন তাদের পড়েনি। নিজেদেরকে আগেই মুক্ত করেছিল।
—কে মুক্ত হলো আর কে মুক্ত হলো না সেই খবর জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। দিপেশকে পালাতে তুই সাহায্য করেছিস কি না এই কথা শুধু জানতে চাই।
—তার আগে তুমি বলো অক্ষরার কাহিনী কি?
—অক্ষরার আবার কিসের কাহিনী? শুনেছি ওই বেশ্যা ওকে নাকি খুন করেছে।
—মিথ্যা বলবে না। আসল অক্ষরার পতিতা হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই তোমার হাত ছিল!
—অনেক ঘটনার পেছনেই আমার হাত ছিল বা আছে। যেমন দিপেশের মৃত্যুর পেছনেও আমার হাত থাকবে যদি তুই সত্যি কথা না বলিস।
—আমি কিছুই করিনি মা। তোমার ইচ্ছেই এই বিয়ে করেছি যখন তখন দিপেশকে কেন পালাতে সাহায্য করব?
—কেন এর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আমার নেই আছে তোর। আমি জানি এই কাজ তুই করেছিস। দিপেশের পালানোর আগ মূহুর্তে তুই ওর সাথে দেখা করেছিলি।
—তুমি যা ভাবছ তা সম্পূর্ণ ভুল। রণক আর কথা বাড়ায় না। মাথাটা ভিষণ ব্যাথা করছে। ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়ে রণক।
********
পেটের উপর হাত দিয়ে অরুনিকা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার জীবনে যে নতুন মোড় এসেছে। নিজের জন্য না হলেও নতুন যে প্রাণ এই পৃথিবীতে আসতে চলছে তার জন্য আশেপাশের জঞ্জাল পরিষ্কার করা উচিত। আজ বাড়িতে পৌঁছেই মৃণালের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা যদি রক্ষা হয় তাহলে একটা টেনশন থেকে সে মুক্ত হতে পারবে।
অক্ষরার জন্য কিছু করা উচিত মেয়েটা এখানকার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। হুটহাট করে যদি দিলাত্রী সেনের সামনে গিয়ে পড়ে তাহলে কপাল পুড়বে মেয়েটার। রণকের সাথে একবার কথা বলা জুরুরি ছিল কারণ কলকাতা থেকে যাওয়ার আগে দিপেশকে ওর দায়িত্বে রেখে যাওয়া
হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। সমাজে মুখোশের সংখ্যা এতো বেড়েছে যে মানুষ চেনার উপায় আর নেই। নিজের জীবন নিয়ে সে চিন্তা করে না। কিন্তু যে অনাগত সন্তান পৃথিবীর বুকে আসতে চলেছে। সে নিজের কি পরিচয় দিবে! সমাজে পরিচয় দেওয়ার মতো কোন পরিচয় তার নেই। নিজের সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনিকা। বাইর থেকে অনেকেই সেই কান্নার আওয়াজ পায় আভা নিজের বোনের কাছে যেতে চাইলে মৃণাল বাঁধা দেয়।
—রাতে মৃণাল তার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। আজকের দিনের মতো দিন হতেই পারেনা। মৃধাকে পেয়ে তার মা যেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে। একটা বারের জন্য জিজ্ঞেস করেনি এতোদিন কোথায় ছিল তার মেয়ে। বরং এমনভাবে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়েছে যেন অতীতে কোন ঘটনায় ঘটেনি। দরজায় নক করার আওয়াজ শুনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল মৃণাল। সামনে অরুনিকা দাঁড়িয়ে।
—মৃণাল বলল,আপনি এখনো ঘুমাননি?
—না চোখে ঘুম আসছিল না। এখন তো আর হাতে সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি আপনার উত্তর পাব ততই তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘুছিয়ে নিতে পারব।
—অরুনিকার কথা শুনে মৃণালের মনে পড়ল অরুনিকার দেওয়া প্রস্তাবের কথা। মাথা নাড়িয়ে মৃণাল বলল, আমি একদম ভুলেই গিয়ে ছিলাম আপনার প্রস্তাবের কথা। আসুন ভেতর আসুন বলে বেলকনির দিকে এগিয়ে গেল।
—মৃণালের পেছনে পেছনে অরুনিকা এগিয়ে যেতে যেতে বলল,ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা আপনার কাছে মূল্যহীন এটাই স্বাভাবিক।
—আপনি কিন্তু আমার কথার ভুল অর্থ বের করছেন।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। সঠিক অর্থ বুঝতে পেরেছি বলেই মনে হয় আমার। আমার প্রস্তাব নিয়ে ভাববার মতো কিছু নেই দেখেই হয়তো ভাবেননি।
—না আপনি সম্পূর্ণ ভুল। আমি প্রস্তাবটা নিয়ে ভাবিনি কারণ আমার বোন এত বছর পর বাড়িতে ফিরেছে। আমার মা যে বিনাবাক্যে মেয়েকে বুকে তুলে নিয়েছে। তাদের দুজনের মুখের হাসি দেখেই অন্য ভাবনা মনে আসেনি।
—এখন তো মনে এসেছে তাহলে উত্তরটা কি এখন দিবেন নাকি আরও অপেক্ষা করব!
— অপেক্ষা করতে হবে না। হাসি মুখে মৃণাল বলল, আপনি প্রস্তাবটা না দিলেও আমি নিজেই দিতাম।
—মানে!আপনি কি প্রস্তাব দিতেন?
—আভাকে আমার ভালো লাগে। কেটিভে এই কয়েকদিন আমরা এক সাথেই ছিলাম। আর মনে প্রাণে একটা জিনিস চেয়েছি। যদি মুক্ত হতে পারি তাহলে আভাকে জীবন সঙ্গী করার প্রস্তাব আপনার কাছে দিব।
—অরুনিকার চোখ ছলছল করে উঠে।ধপাস করে মেঝেতে বসেই মৃণালের পা জড়িয়ে ধরে বলল,তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিব তা বলার ভাষা আমার নেই। একজন দেহ পসারিণীর সাথে কোন মেয়ে থাকলে লোকে তাকেও দেহ পসারিণী ভাববে। এই টেনশনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আভাকে একা রাখার সাহস যেমন আর নেই তেমন নিজের কাছে রাখবারও দুঃসাহস আমার নেই। তুমি আমাকে বাঁচালে।
—মৃণাল কিছুটা সরে গিয়ে বলল, আপনি এ-সব কি করছেন? আমি আপনাকে বাঁচাতে ওকে আপন করছি না। আভাকে ভালোবাসি তাই ওকে আপন করে নিচ্ছি।
*****
হাতে এখনো পাঁচদিন সময় আছে। মৃণালের মা সব কিছু জেনেই সম্মতি দিয়েছে। ভদ্র মহিলা শুধু আড়ালে এসে একটা শর্ত দিয়েছেন যা অরুনিকার খারাপ লাগেনি। নিজের বোনের জন্য এই সামান্য ত্যাগ কোন ব্যাপার না। ভদ্র মহিলা চান বিয়ের আয়োজনে যেন অরুনিকা না থাকে। কারণ পুরুষ মহলে অরুনিকাকে কম বেশি সবাই চেনে। বিয়ের আয়োজনে অনেক আত্মীয়স্বজন আসবে। তাদের ভেতর কোন পুরুষ যদি অরুনিকাকে দেখে চিনতে পারে আর এটা যদি প্রকাশ হয়ে যায় আভা অরুনিকার বোন তাহলে সমাজে তাদের সম্মান থাকবে না।
— অরুনিকা এই শর্তে রাজি। ভদ্র মহিলা খারাপ কিছু বলেনি। এটা সত্য প্রতিরাতে নিত্য নতুন পুরুষের সাথে শুইতে শুইতে এখন দেখা যায় বেশিরভাগই পুরুষ তাকে চেনে। এই তো কিছুদিন আগে রাজিবের ফ্লাটে সামনের ফ্লাটে নতুন ভাড়াটে আসল। ফ্লাট থেকে বের হতে নিয়ে একদিন অরুনিকা মুখোমুখি হলো সেই ভাড়াটের সঙ্গে। অরুনিকাকে দেখেই মুখ শুকিয়ে গেল লোকটির। বেচারা একবার স্ত্রীর দিকে তাকায় একবার অরুনিকার দিকে। এমন কেবলা মুখ দেখে অরুনিকার হাসি পেয়ে যায়। এর পরের ঘটনা দেখা গেল সপ্তাহ না পেরুতে ফ্লাট ছেড়ে দিলেন লোকটি।
—ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছিল অরুনিকা। হটাৎ তার নজর পড়ল ডক্টর অদিতির উপর। ডক্টর অদিতিকে দেখেই মনে পড়লো অপরার কথা।এই মহিলার জন্য মৃত্যুর পরও অপরা অপমানিত হয়েছে। এই মহিলা মিষ্ট ভাষী কিন্তু এই মহিলা যে কতটা ভয়ানক তা এখন অরুনিকা ভালো করেই জানে। অমলের ফোনে যদি অদিতির নাম্বার না দেখত সেদিন তাহলে হয়তো এর ভয়ানক রূপের কথা অজানা থেকে যেত। কিন্তু এখন তো সে জানে কেটিভের ম্যাডাম আর কেউ নয় অদিতি সেই ম্যাডাম। দেশে থেকে যে নারী পাচারকারীর দলের নেত্রীর ভূমিকা পালন করে।
—নিজের মনেই যখন ভাবছিল অরুনিকা তখন ডক্টর অদিতির কথায় ছেদ পড়ল সেই ভাবনায়। শুনলাম ডক্টর মৃণালের সঙ্গে আপনার বোন আভার বিয়ে।
—ডক্টর অদিতির কথা শুনেই চোয়াল শক্ত হলো অরুনিকার। দাঁতে দাঁত রেখে বলল, প্রথম দেখায় আপনাকে খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু এখন আপনার থেকে খারাপ আমি আমার জীবনে দেখিনি।
—অরুনিকার কথা শুনে ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে ডক্টর অদিতি তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, সব যখন জেনেই গেছ তখন মৃণালের সাথে আভার বিয়ে দেওয়ার দুঃসাহস না দেখানোই মঙ্গল।
—ব্যাংক থেকে বেরিয়ে চলে গেল ডক্টর অদিতি। অদিতির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে অরুনিকা যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। অদিতির বলা কথা সে বুঝতে পারল না। অমলের পেছনে অদিতির হাত ছিল এটা স্পষ্ট কিন্তু মৃণাল আর আভার বিয়ের সাথে অদিতির কি সম্পর্ক! ব্যাংক থেকে তার জমানো পুঁজি তুলে সে নিজের ফ্লাটে গিয়ে আগে ফোন দিল মৃণালের কাছে। এখন মৃণালের সাথে দেখা হওয়া খুব জরুরি।
*****
মৃণালদের বাড়ি বিয়ের আলোয় এখন থেকেই সাজাতে শুরু করেছে। চারিদিক থেকে নিকটতম আত্মীয়স্বজনে বাড়িতে আসা শুরু করেছে। মৃণালের বিয়ে নিয়ে তাদের যতটা না আগ্রহ তার চেয়ে বেশি আগ্রহ মৃধা এত বছর কোথায় ছিল? মৃধাকে নিয়ে এতো আলোচনা যদিও মৃণাল আর তার মা পছন্দ করছিল না তারপরও তারা মাথা ঠান্ডা রেখেই একের পর এক আত্মীয়ের কাছে একই গল্প বারবার পুনরাবৃত্তি করছে। গল্পটা অরুনিকা সাজিয়ে দিয়েছে। মৃধার এক্সিডেন্ট হয় তারপর সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলে এত বছর সে একটা পরিবারের কাছে মেয়ের মতোই বড় হয়েছে। কিছুদিন আগে এক বান্ধবীর সাহায্যে এতবছর পর মৃণাল তার বোনের খোঁজ পেয়েছে। ঘটনা শোনার পর একবারে কারো বোধগম্য না হলেও অবিশ্বাস কেউ করেনি। ঘটনা শোনার পরও অনেকে আরও বেশি তলিয়ে জানবার জন্য কিছু প্রশ্ন করেছে। যেমন এখন মৃধার স্মৃতি ফিরেছে কি না? সে যেহেতু একটা পরিবারের কাছে বড় হয়েছে তারা এতবছর পর তাকে ফেরত দিতে রাজি হলো কীভাবে? এতো বড় মেয়েকে কোন পরিবার নিজের কাছে কী ভেবে রাখল ? পুলিশে কেন জানায়নি?
—অনেকে মৃণাল আর তার মায়ের কাছে ঘটনা শুনে তা পরীক্ষা করার জন্য মৃধার কাছে গিয়ে প্রশ্নের ডালা খুলে বসছে। মৃধা গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয়। এমন ভাব দেখায় দেখে মনে হত সত্যি স্মৃতি হারিয়েছে। এই পরিবার তার কাছে একেবারে নতুন এতবছর যে পরিবারে বড় হয়েছে সেই পরিবারে ফিরে যেতে চায় সে। দূর থেকে এই সব মৃণাল আর আভা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর ঠোঁট টিপে হাসে।
****
কলিং বেল বাজতেই অরুনিকা গিয়ে দরজা খুলল। মৃণাল বাড়িতে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করেই প্রশ্ন করল অরুনিকা। তোমার সাথে ডক্টর অদিতির কি সম্পর্ক?
—মৃণাল হতভম্ব হয়ে যায়। হটাৎ এই প্রশ্ন কেন করছেন অরুনিকা। আর তার থেকেও বড় প্রশ্ন হলো অরুনিকা কীভাবে জানল এই কথা! মৃণাল মাথা নাড়িয়ে "হ্যা" বলল।
—কথাটা শোনা মাত্র অরুনিকার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। উচ্চ স্বরে সে বলল, আমরা কি এমন ক্ষতি করেছি যে শেষ অব্দি তুমিও ধোঁকা দিলে?
—আমি ধোঁকা দিলাম! আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। ডক্টর অদিতির সাথে আমার সম্পর্ক ছিল কিন্তু তা মেডিকেল পড়ার সময়। অদিতির পরিবার ভালো ছিল না তাই সময় থাকতে আমি ব্রেকআপ করি। আপনি কীভাবে আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন?
—অদিতি কেটিভের ম্যাডাম এটা আমি অমলের ফোন থেকে জানতে পেরেছি। আজকে ব্যাংকে দেখা হয় আমাদের।ওর সাথে কথা বলার সময় অদিতি আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে।
—ওয়েট ওয়েট আপনি বলতে চাচ্ছেন অদিতি সেই যে কেটিভে আমার যত্ন নেওয়ার অর্ডার দিয়েছিল!
—তোমার যত্ন নেওয়ার অর্ডার?
—হ্যা, অমল বলেছিল ওর ম্যাডাম নাকি আমার যত্ন নেওয়ার অর্ডার দিয়েছিল। তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু অদিতি এতো নিচ হতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
—শুধু অদিতি নিচ নাকি সাথে তুমিও!
—আপনি বলতে চাচ্ছেনটা কি বলুন তো! আমি যদি অদিতির পার্টনার হয় তাহলে কেটিভ থেকে বের হতে পারতেন? আর সব থেকে বড় কথা আমার বোন কেটিভে ছিল।
—দেখ মৃণাল আমার এই পৃথিবীতে আভা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার জীবনের পরওয়া আমি করিনা। কিন্তু অদিতি যে ঈঙ্গিত দিয়েছে তাতে যে আমার বোনের সামনে বিপদ এটা বুঝতে পারছ তুমি?
—মৃণালের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তাহলে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? শেষ করে দিন।
—অরুনিকা অবকা করা দৃষ্টিতে মৃণালের দিকে তাকিয়ে বলল, মানে!
—মানে আবার কি! ফিরোজার আর অমলের খুন করতে যখন একবারও ভাবেননি তখন অদিতিকে নিয়ে ভাবছেন কেন! আপনার যা সাপোর্ট প্রয়োজন আমি দিব। যদি সত্যি কেটিভের ম্যাডাম অদিতি হয়ে থাকে তাহলে মৃধার কথা সে জানত। মৃণালের চোখ থেকে এখন আগুন ঝরছে।
—কাউকে খুন করা এত সহজ না। অদিতি যে গভীর জলের মাছ তা আর বুঝতে বাকি নেই অরুনিকার। মৃণালের উপর প্রথম অবিশ্বাস করলেও এখন ওর মনে হচ্ছে মৃণাল যদি অদিতির সঙ্গী হত তাহলে ওরা কেটিভ থেকে সত্যি বের হতে পারত না। এখন তাকেই কিছু একটা করতে হবে।

ফ্লাট থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। ফ্লাটের দরজা থেকে শুরু করে সোসাইটির মেইন দরজা অব্দি মানুষে গিজগিজ করছে। এই মূহুর্তে অরুনিকা বের হওয়া মানে গণধোলাইয়ে পটল তোলা। পুলিশ না আসা পযন্ত কোন ভাবেই দরজা খোলা যাবে না। পুলিশকে ফোন করে জানিয়েছে অরুনিকা। কিন্তু পতিতার বিপদে ওদের হয়তো ছুটে আসতে দ্বিধা হচ্ছে। ওই দিকে মানুষ পারে তো দরজা ভেঙে ঢুকবে এমন তান্ডব চালাচ্ছে দরজার বাইরে। পুরুষদের থেকে মহিলারা বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। তারা মোটামুটি সবাই এক কথায় বলছে। সোসাইটিতে এই সব কুলটা স্থান পায় কি করে? ভদ্রলোকের বসবাসের জায়গায় এখন যদি পতিতা থাকা শুরু করে তাহলে সমাজ আর রইলো কোথায়! কয়েকজন মহিলা কর্কশ স্বরে বলছে হায়রে হায় ভগবান, এতদিন এক পতিতার সাথে সোসাইটিতে থাকছি কিছুই জানতে পারলাম না। শেষ অব্দি এই ভাবে ওই পতিতার জন্য জাত হারালাম! তুমি রক্ষে করো ভগবান।
অরুনিকা ছলছল চোখে অক্ষরার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছ অক্ষরা আমাদের স্থান কোথায়? এই সমাজ আমাদের মানুষ হিসেবে গণ্যই করে না। এই সোসাইটির বিল্ডিংয়ের একটা ফ্লাটে পতিতা থাকে এই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখ বাইরে কত মানুষের সমাবেশ। সবার মুখে একটাই কথা সোসাইটিতে পতিতা কীভাবে থাকতে পারে! আমি আছি তো আমার মতো অথচ বাইরের ভদ্র মহিলাদের নাকি জাত গেছে এই সোসাইটিতে থেকে। অরুনিকা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা পতিতা দেখে কি মানুষ নই অক্ষরা? আমাদের কি মন বা শরীর বলে কিছুই নেই?
অক্ষরা কিছুই বলে না। সকাল থেকে ফ্লাটের বাইরে যা দেখছে তাতে এখন মনে হচ্ছে সে কেটিভেই ভালো ছিল। আর যাইহোক সেখানে তাদের হেয় কেউ করত না। আজ বাইরে যেসব পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে সমাজ থেকে তাদের বের করার জন্য। সেই সব পুরুষই রাতের অন্ধকারে শরীরে ক্ষিদে মিটাতে হিংস্র পশুর মতো খুবলে খুবলে ভোগ করে পতিতা-দের শরীর। কিন্তু দিনের আলোয় ওরা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন পতিতা-দের মুখ দর্শনেও পাপ।
— পুলিশ আসলে তাদের রক্ষে তাছাড়া আজ মৃত্যু তাদের দোরগোড়ায়। প্রায় কয়েক বছর হলো রাজিবের দেওয়া এই ফ্লাটে অরুনিকা আছে। এতদিন কেউ কিছু জানতে পারল না আজ হটাৎ কি এমন ঘটলো যে রাতারাতি সবাই জেনে গেল সে পতিতা! আচ্ছা এমনটা তো নয় যে ডক্টর অদিতি এই সব করেছে। হ্যা, অদিতি ছাড়া এই কাজ আর কেউ করতেই পারে না।অরুনিকা পতিতা হয়ে সোসাইটিতে বসবাস করছে এই খবর অদিতি লিক করেছে এই সোসাইটিতে এসে। ওর প্লান কি এখনো স্পষ্ট না অরুনিকার কাছে। অরুনিকা পতিতা এই খবর সোসাইটিতে লিক করে অদিতির কি এমন লাভ হতে পারে? আভা যে অরুনিকার বোন এটা এখানে তো প্রমাণ করা অসম্ভব তাহলে আর কি হতে পারে? না আর ভাবতে পাচ্ছে না অরুনিকা।
—পুলিশ চলে এসেছে। পুলিশকে দেখে সোসাইটির মানুষজন আস্তে আস্তে সরে দাঁড়ালো। পুলিশ এসে অরুনিকার দরজা নক করতেই অক্ষরা দরজা খুলে দিল। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে পুলিশ বাইরের ভিড় ঠেলে যখন অরুনিকা আর অক্ষরাকে নিয়ে যাচ্ছে তখন হটাৎ ওর নজরে পড়ল ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কর্ণভ। দপ করে জ্বলে ওঠে অরুনিকার চোখ। অপরার মৃত্যুর জন্য ওই লোক দায়ী। সে তো জেলে ছিল বাইরে বের হলো কি করে! অরুনিকার এইভাবে ভিড়ের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে এক পুলিশ বিরক্ত হয়ে বলল, এখান থেকে যাবি না-কি জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরাই চলে যাব?
পুলিশের কথা শুনে অক্ষরা অরুনিকার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, চলুন এখান থেকে ঠিক তখনি ক্ষিপ্ত মহিলাদের ভেতর থেকে একজন পাথর ছুড়ে মারে। পাথর এসে অরুনিকার কপালে লাগে। কপাল কেটে রক্ত গাল বেয়ে টপটপ করে পড়ছে। দু'হাতে কাপাল চেপে ধরে বসে পড়ে অরুনিকা। ভিড়ের মধ্যে থেকে সেই মহিলা চেঁচিয়ে বলল, এই যাত্রায় ছেড়ে দিচ্ছি আর কোন দিন যদি ভদ্র লোকের পাড়ায় দেখছি তো যমের দুয়ারে পাঠাব।
— অরুনিকাকে হসপিটালাইজ করার পর আভাকে নিজ থেকে ফোন করে অক্ষরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় অরুনিকা তাদের দু'জনকে আসতে বারণ করেছে। বলা যায় না অদিতি কখন কি করে! শুধু যে অদিতি জন্য আসন্ন বিপদ তাও না সেই দিন ভিড়ের মাঝে কর্ণভকে সে দেখেছে। যেহেতু বিয়ের আর তিনদিন আছে তাই যাই হয়ে যাক না কেন তারা যেন অরুনিকার সাথে যোগাযোগ না করে। আভা কিছু না বলেই ফোন কেটে দেয়।
হসপিটালে দুইদিন থাকার পর যখন সুস্থ হলো অরুনিকা তখন সামনে বসে ছিল এক ভদ্র মহিলা। অরুনিকা বেডে উঠে বসতে বসতে বলল, আপনাকে তো চিনলাম না।
—চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মহিলাটি বলল, নমস্কার। আমি অতিক্ষা সেন।
—অতিক্ষা সেন! নামটা অচেনা কিন্তু পদবী তার খুব পরিচিত। সেন পদবী তার মানে কি মহিলাটি রণকের স্ত্রী? অতিক্ষার মুখের দিকে তাকাল অরুনিকা। দেখতে বেশ সুন্দরী মাথার সিঁথিতে টানা সিঁদুর যেন রূপকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সিঁদুর অরুনিকার পাওনা ছিল। বুকের ভেতর মুচড়ে এক ছিটকে জল চোখে চলে আসে অরুনিকার। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওহ আপনি মিস্টার রণক সেনের স্ত্রী।
— অতিক্ষা বলল, হ্যা। আপনি অনেকক্ষণ হলো ঘুমচ্ছিলেন। আপনার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।
—অরুনিকা স্বাভাবিক হয়ে কথা বলার চেষ্টা করল। হুম আসলে ডাক্তারের দেওয়া ঔষধের কারণে ঘুমিয়ে ছিলাম। তা আপনি এখানে হটাৎ? আপনার হাসবেন্ডের সাথে এসেছেন?
—অতিক্ষার চোখ ছলছল করে উঠে। অরুনিকার কাছে এগিয়ে গিয়ে দুহাত সাপটে ধরে বলল, আপনি ওকে বাঁচান। ব'লেই হু হু করে কেঁদে উঠলো অতিক্ষা।
—অরুনিকা কি বলবে বুঝতে পারছে না। রণকের হটাৎ এমন কি হলো যে ওর স্ত্রী এসেছে সাহায্য চাইতে তার কাছে। রণকের মা থাকতে অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ার কথা না আর একটা পতিতার প্রয়োজন তো কখনোই পড়ার কথা না। অরুনিকা বলল, দেখুন আপনি কাঁদবেন না। কি হয়েছে তা খুলে বলুন। আর দিলাত্রী সেন থাকতে আপনার এখানে কেন আসতে হলো বুঝতে পারছি না।
—হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে অতিক্ষা বলল, মা তো দিপেশের ব্যবস্থা করতেই মগ্ন। আমি যে উনার নিখোঁজ হওয়ার কথা বলছি তা কানেই তুলছে না।
—দরজায় জলের বোতল নিয়ে এসে দাঁড়াতেই দিপেশের নাম শুনে থমকে দাঁড়ায় অক্ষরা। পেছন থেকেই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করে অক্ষরা। কি হয়েছে দিপেশের? কিসের ব্যবস্থা?
—অতিক্ষা পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, দিপেশ দাদার অন্তিম সময় নিকটে। উনি জেল থেকে পালিয়ে ছিল। ভাগ্যের করুন পরিণতি এমন যে পালিয়ে আর বেশি দূর যেতে পারল না। ধরা পড়েছে মায়ের হাতে।
—অক্ষরা দৌঁড়ে অরুনিকার কাছে এসে বলল, আপনি কিছু করেন দিদি। আমার দিপেশকে বাঁচান। ওই মহিলা খুব ভয়ানক মেরে ফেলবে আমার দিপেশকে।
—অতিক্ষা বলল, আপনি আমার উনাকেও বাঁচান। আপনাকে বাঁচাতে উনি চীনে গেছিল এখন আপনি উনার জন্য কিছু করেন।
—অরুনিকা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার স্বামীকে চীনে যেতে আমি বলিনি। আর ও চীনে গিয়ে আমাদের কোন সাহায্যেই আসেনি তার আগেই আমরা কেটিভ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
—অতিক্ষা জড়োসড়ো হয়ে বলল, না মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে উনি আপনার সব সময় মঙ্গল চেয়েছে এখন নিজেই বিপদে আছে আপনি উনাকে সাহায্য করুন।
—রণক নিখোঁজ এটা আপনি কীভাবে জানলেন? হতেই তো পারে নিজেই কোথাও গেছে।
—না-না নিজে কোথাও যায়নি। একটা কল এসেছিল। ফোনে কথা শেষ করে সেই যে উনি রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন আর ফিরে আসেননি। মা'কে অনেকবার বলেছি। মা আমার কথা কানেই নিচ্ছে না। শুধু একবার বলল, যে ছেলের জন্য এত কিছু করেছি সে যখন চোর বলে তখন তার জন্য আর কিছুই করব না।
—দিপেশের জন্য অক্ষরাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে অরুনিকা বলল, কান্না বন্ধ কর। ভদ্র সমাজের মেয়েরা ছিঁচকাঁদুনী হয়,তোমার আমার মতো মেয়েরা হয় না।

অরুনিকা হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করছে। সে কি করতে পারে রণকের জন্য। একজন পতিতা হয়ে নিশ্চয়ই পুলিশের কাজ সে করতে পারবে না। রণকের শত্রু কে তা অরুনিকা কীভাবে জানতে পারে! নিজেই যেখানে বিপদে ডুবে আছে সেখানে অন্যের বিপদে কি করে সাহায্য করতে পারে!
—অরুনিকার চিন্তার ছেদ পড়ে অক্ষরার ডাকে। দিদি আমরা কোথায় যাচ্ছি?
—আসলেই তো আমরা কোথায় যাচ্ছি অক্ষরা? পাল্টা প্রশ্ন শুনে অক্ষরা বলল, আপনি নিজেই যদি এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন তাহলে আমার কি হবে দিদি?
—অরুনিকা কথার উত্তর না দিয়ে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকল। ট্যাক্সিতে উঠে বসে মৃণালের কাছে কল দেয় অরুনিকা।
—ফোন রিসিভ করেই মৃণাল বলল, একটু ব্যস্ত ছিলাম। পড়ে কথা বলি আর এখন কেমন আছেন?
— বেশি সময় নিব না।কেমন আছি তার উত্তর তোমার না শুনলেও হবে। তুমি আমাদের থাকার জন্য একটা বাড়ির ব্যবস্থা কর।
—মৃণাল আমতা আমতা করে বলল, এখন এটা কি করে করব?
—অরুনিকা রাগিত স্বরে বলল, কি করে করবে মানে?
— না মানে সেই দিনের ঘটনা লাইভ টিভি চ্যানেলে দেখিয়েছে।পেপারে লেখালেখি হয়েছে। যদিও লেখালেখি আপনার পক্ষ নিয়েই হয়েছে কিন্তু কাগজের লেখা আর বাস্তব সমাজের মানুষের চিন্তাধারা আলাদা। সমাজের সবাই এখন আপনার পরিচয় জানে। এই মূহুর্তে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে অনেক কঠিন।
—অরুনিকা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, পরিচয় জেনেছে মানেটা কি! আমি আগেও পতিতা ছিলাম এখনো পতিতাই আছি। পুরুষ জাতি এতদিন রাতের অন্ধকারে আমাকে দেখেছে এখন পুরো সমাজ দিনের আলোয় দেখছে এর থেকে বেশি আর কিছুই ঘটেনি। টাকা দিলে সব পাওয়া যায়। আমি টাকা দিব তুমি আমার হয়ে একটা বাড়ি কিনে দাও।
—মৃণাল বিরক্ত স্বরে বলল,এত তাড়াতাড়ি কি বাড়ি কেনা সহজ ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে আপনার কাছে? এই সবের জন্য সময় লাগবে।
—তে আমি আবার কখন বললাম এখুনি কিনতে হবে! সময় লাগবে সময় নাও। এর মাঝে আমার কিছু কাজ আছে। মৃণালের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিল অরুনিকা। বিপদের সময় সবাই আমতা আমতা করে। ফিরোজার খুনের ব্যাপার ছিল রাতের অন্ধকারে তাই হয়ত মৃণাল সাহায্য করেছিল তাকে কিন্তু এখন অরুনিকা বিপদে আছে দিনের আলোয় এই জন্য মৃণালও পিছপা হয়েছে। কিন্তু আভাকে আশীর্বাদ করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অরুনিকার। একমাত্র বোনের আজ বিয়ে।
****
—ট্যাক্সির ড্রাইভার বারবার পেছন দিকে তাকাচ্ছিল। অরুনিকা চেঁচিয়ে বলল, মাগী কখনো দেখিসনি নাকি? বারবার পেছনে না তাকিয়ে গাড়ি চালা ঠিকঠাক হারামজাদা।
—অরুনিকার দিকে তাকিয়ে অক্ষরা অবাক হয়ে গেল। অরুনিকা এখন পতিতা-দের মতোই কথা বলছে। কলকাতায় ফেরার পর অরুনিকাকে দেখে একবারের জন্যেও পতিতা বলে মনে হয়নি তার। বরং ভদ্র সমাজের একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে মনে হয়েছে অক্ষরার কাছে। পতিতা-দের চলনবলনের ভাব অরুনিকার মাঝে ছিল না কিন্তু সেই দিনের ঘটনার পর থেকে পতিতালয়ের নারীদের মতোই তার চালচলনে প্রকাশ পাচ্ছে।
—ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথায় অক্ষরার চিন্তায় ছেদ পড়ল। দিদি যদি অভয় দিতেন তো একটা কথা বলতাম।
—অরুনিকা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার যে রেট তা তোর সামথ্যের বাইরে। এখন ঢুকি চিপে নিজের কাজে মন দে।
—ট্যাক্সি ড্রাইভার নিচু স্বরে বলল, আপনাক দেখতে ওই লাইনের মনে হয় না। শুধু ভাষাটা ঠিক যদি রাখেন তাহলে আমার বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
—জানালা থেকে মুখ সরিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
—জি পারব। কিন্তু বাড়িতে আমার মা থাকেন আপনি যদি একটু ভাষার পরিবর্তন করতেন তাহলেই দুচারদিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম।
—ভাষার টেনশন একদম নিবেন না। আমি গিরগিটির মতো নিজের আচরণ পালটাতে পারি বলেই অট্ট হাসি হাসে অরুনিকা। অরুনিকার হাসি দেখে অক্ষরা হেসে বলল, আমার মনে হয় আপনার মাথায় পাথর লাগার জন্য মস্তিষ্কের সমস্যা হয়েছে।
—অরুনিকা হাসতে হাসতে বলল, হতেও পারে। তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, কত টাকা নিবি?
—আপনি তো বললেন আপনার রেট আমার সামর্থ্যের বাইরে। আপনাক থাকতে দিলে আমার সামর্থ্য অর্জন হবে তখন তাহলে-
—অরুনিকা বলল, তোর সামর্থ্য হতেই পারে কিন্তু আমি প্রেগনেন্ট। এখন এই সব আমার পক্ষে সম্ভব না। তোর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে না।
—অক্ষরা ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে যদি পছন্দ হয় তাহলে আমি রাজি।
—ড্রাইভার হেসে বলল,আমার কোন সমস্যা নেই। আমি পেলেই হলো। আপনি দেন আর উনি দিক তাতে সমস্যা নেই কোন।
—ট্যাক্সি এসে শ্যাম বাজারের একটু আগেই এক গলির মুখে একতলা বাড়ি সামনে দাঁড়ালো। ট্যাক্সি থেকে নেমে অক্ষরা বলল, এটা কার বাড়ি?
—অক্ষরার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে অরুনিকা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ভাড়া দিল।
—ট্যাক্সি থেকে ড্রাইভার বেরিয়ে এসে বলল,আপনি ভাড়া দিচ্ছেন কেন! ভাড়া দিতে হবে না। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। কাজ সেরে আসেন।
—অরুনিকা এবার খপ করে ড্রাইভারের শিন্ন চেপে ধরে বলল, ধান্দা বাজির জায়গা পাস না তাইনা। আমার ফোনের কথা শুনে আমাকে টপ দেওয়ার ধান্দা। এখান থেকে ভালোই ভালোই কেটে পড়,নইত তোর ডিম কলকাতার কাকের খাদ্যতে পরিণত হবে। এই বলে ছেড়ে দেয় ড্রাইভারকে।
—কোন মতো ড্রাইভার ট্যাক্সিতে উঠে স্ট্রাট দিয়ে ফাস্ট গেয়ারে চলে যায়। অরুনিকার এমন কান্ড দেখে অক্ষরা বলল, কি হলো বুঝলাম না কিছু।
—কি আর হবে কাকের খাদ্য প্রস্তুত হলো না তার আগেই খাদ্য ফাস্ট গেয়ারে পালালো। অক্ষরাকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরুনিকা হেসে বলল, বোকা মেয়ে কলকাতায় যাকে তাকে বিশ্বাস করে সাথে গিয়ে প্রাণ হারাতে চাও নাকি?
—অক্ষরা এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারে। অরুনিকা যে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য ট্যাক্সি ওয়ালার গল্পে তাল মিলিয়েছে তা বুঝতে পারেনি অক্ষরা। কলকাতা শহরে সবাই ধান্দাই চলাফেরা করে। যাই বলবে আয় রে তার সাথে যাই রে মানেই সামনে নির্ঘাত বিপদ ফাঁদ পেতে আছে।
—সব বুঝলাম কিন্তু এটা কার বাড়ি?
—অরুনিকা হাটতে হাটতে বলল, দিলাত্রী সেনের বাড়ি।
—অক্ষরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। অরুনিকা আসলে কি করতে চাচ্ছে?
—শ্যাম বাজারের বাড়িতে দিলাত্রী আছে এই কথা অতিক্ষা অরুনিকাকে বলেছিল। তাই হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হয়ে সোজা এই বাড়িতে এসেছে অরুনিকা। যা হয় হবে সামনাসামনি না হলে দিপেশকে বাঁচানোর আর কোন পথ অরুনিকার ছিল না। আশপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে ব্যাগ থেকে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার বেড় করে শাড়ির আঁচলে আড়াল করে কলিং বেল বাজালো অরুনিকা।
—কলিং বেল বাজতেই অতিক্ষা দরজা খুলল। এতো তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে দেখে অরুনিকা বলল, দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মনে হয়। কাঁপতে কাঁপতে অতিক্ষা বলল, জীবন যা করিনি আপনার কথা মতো আজ তাই করেছি। তাই ভয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আপনার অপেক্ষা করছিলাম।
—অক্ষরার যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। কি এমন করছে অতিক্ষা যে ভয়ে এমন থরথর করে কাঁপছে।
অরুনিকা এই বাড়িতে এর আগেও একবার এসেছিল রণকের সাথে। রণক এই বাড়িটায় তাকে থাকতে দিতে চেয়েছিল। অরুনিকা ভেতর দিকে যেতে যেতে বলল, দিলাত্রী কোথায়?
—অতিক্ষা হাতের ঈশারায় দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই ঘরে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে।
—রিভলবার উঁচিয়ে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল অরুনিকা। বলা যায় না নিজের শাশুড়ীর সাথে পরিকল্পনা করে অরুনিকাকে ফাঁদেও তো ফেলতে পারে অতিক্ষা। কেউ অ্যাটাক করার আগেই যেন অরুনিকা গুলি করতে পারে সেই পজিশনে ঘরের ভেতর ঘুরে ঘুরে দেখল। না বিছানায় অচেতন দিলাত্রী ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই। অতিক্ষরার দিকে তাকিয়ে বলল, দিপেশ কোথায়?
—দিপেশ দাদা অচেতন হয়ে পড়ে আছে ও ঘরে বাকী লোকদের সাথে।
—বাকী লোক মানে?
—মায়ের সাথে তিন জন দেহরক্ষী ছিল। ওদের মারের চোটে দাদা জ্ঞান হারিয়েছে। আর ওরা আমার চা খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। অরুনিকার দিকে তাকিয়ে অতিক্ষা বলল আপনি এখন কি করবেন?
—কি আর করব যে কাজ করতে এসেছি তাই করব। এই কাজ আমি করছি শুধু অক্ষরার জন্য। দিপেশ যদি বেঁচে যায় তাহলে এই মেয়ে সমাজের বাকী মেয়েদের মতো ঘর সংসার করতে পারবে। নয়তো দিপেশকে বাঁচানোর কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। দিলাত্রী ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো অরুনিকা। পেছনে পেছনে অতিক্ষা আর অক্ষরাও ঢুকলো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অচেতন তিন দেহরক্ষীর ভেতর দুজনের বুকে গুলি করল অরুনিকা।
—অরুনিকার গুলি করা দেখে অক্ষরা আর অতিক্ষা দুজনেই কেঁপে উঠল। অরুনিকা পেছন দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, দিলাত্রী সেনের পুত্রবধূ এতো ভীতু কি করে হলো?
—অতিক্ষা বলল, কাউকে খুন করার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই যে সাহসী আর ভীতুর প্রশ্ন উঠবে।
—অরুনিকা পাল্টা আর কিছু না বলে। তৃতীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে অতিক্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলল। আপনার শাশুড়ীর কাছে নিশ্চয়ই ক্লোরোফরম আছে।
—অতিক্ষা বলল, হ্যা আছে।
—ক্লোরোফরম নিয়ে এসে এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। লোকটির জ্ঞান ফিরতে দেখলেই কাপড় দিয়ে নাকে চেপে ধরবেন। আবার যেন বেশি পরিমাণে ক্লোরোফরম কাপড়ে ঢালবেন না। তাহলে লোকটি অচেতন না হয়ে সোজা পটল তুলবে।
—হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অরুনিকা। অক্ষরা দিপেশের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কতদিন পর ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ পযন্ত কাছে পেয়েছে অক্ষরা এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে!
—দিলাত্রী সেনের জ্ঞান ফিরছে। অরুনিকা উনাকে চেয়ারে ইতিমধ্যে বেঁধেছে। অরুনিকাকে সামনে দেখে গর্জে উঠে বলল, তুই এখানে কি করে! আমার বাড়িতে একটা বেশ্যা কি করে ঢুকতে পারে?
—অরুনিকা বিরক্ত হয়ে বলল, কথায় কথায় বেশ্যা বলে কি আরাম পান বুঝিনা। রণকের মুখে শুনেছি আমাকে আপনি বেশ্যা বলেই ডাকেন। আচ্ছা মানুষকে মানুষ বলে যদি গালি দেওয়া না যায় তাহলে বেশ্যাকে বেশ্যা বলে কীভাবে গালি দেওয়া যায়? আপনার উচিত নতুন কিছু গালি বেড় করা যেটা শুনে আমার খারাপ লাগবে। কারণ বেশ্যা শুনে আমার মোটেই খারাপ লাগে না।
—দিলাত্রী সেন ছটফট করছিল। মনে হচ্ছে যদি হাত খোলা পেত তাহলে অরুনিকাকে মারতে দু'মিনিট সময় নষ্ট করত না।
—অরুনিকা হাসতে হাসতে বলল, আপনার মনোভাব বুঝি কিন্তু কি আর করার আপনার অন্তিম সময় নিকটে। এক দিক থেকে দেখতে গেলে আমার কোন ক্ষতি আপনি করেননি কিন্তু আবার অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি আপনি করেছেন। কি ক্ষতি জানতে চান? আমার সন্তানের বাবাকে আপনি তার থেকে দূরে সরে দিয়েছেন। এর থেকে বড় ক্ষতি আর কি হতে পারে?
—অরুনিকার কথা শুনেই এক দলা থুতু মেঝেতে ফেলে দিলাত্রী বললেন। বেশ্যার পেটের বাচ্চার আবার বা- কথা সম্পূর্ণ করতে পারেনা দিলাত্রী তার আগেই অরুনিকা দিলাত্রীর কপাল বরাবর গুলি করে। গুলি করেই অরুনিকা বলে ওঠে, বেশ্যার পেটের বাচ্চারো বাবা থাকে।
—পেছনে এসে বিড়বিড়িয়ে অতিক্ষা বলল, ক্লোরোফরম দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি জ্ঞান ফিরতেই মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছি আবার জ্ঞান হারিয়েছে। অতিক্ষার দৃষ্টি নিজের শাশুড়ীর প্রাণ শূন্য দেহের দিকে। ওই মহিলার জন্য সে তার ভালোবাসাকে হারিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসাকে হারিয়ে রণকের মতো স্বামীও সে ওই মহিলার জন্যেই পেয়েছিল। ভালো খারাপ মিলে শাশুড়ীর উপর একটু হলেও সম্মান তার ছিল। কিন্তু যখন স্বামীর প্রাণ বিপন্ন তখন ওই মহিলার কোন কথায় আর সহ্য করার মতো ছিল না।
******
—তৃতীয় লোকটির জ্ঞান ফেরার পূর্বেই রিভলবার লোকটির হাতে রেখে অরুনিকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে পেছন পেছন দিপেশ আর অক্ষরা।
—অরুনিকার কথা মতোই নিজেকে আহত করে নিজেদের পরিচিত পুলিশ কমিশনারের কাছে ফোন দিয়ে অতিক্ষা ব'লে, কর্ণভ নামের একজনের হুকুমে এক লোক বাড়ির সবাইকে ঘুমের ঔষধে অচেতন করে। কর্ণভ রণককে তুলে নিয়ে যায় এবং অন্য লোকটি তার শাশুড়ী এবং দুই দেহরক্ষীকে হত্যা করেছে। তাকেও হত্যা করতে ধরছিল কিন্তু প্রাণপন লড়াই করে লোকটির মাথা লাঠির বাড়ি দিয়েছে সে। এখন লোকটির ঘরে বন্দী অবস্থায় রয়েছে।
—অতিক্ষার মনে ভয় ছিল। পুলিশ হয়তো তাকেই ধরবে। কিন্তু কর্ণভের নাম শুনে পুলিশ কেন তাকে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ করল না তা নিয়ে অতিক্ষা সত্যি অবাক হয়েছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই কর্ণভের বাড়ি থেকে রণককে পুলিশ উদ্ধার করেছে। পুলিশ যখন রণকের কাছে তার মায়ের মৃত্যু ঘটনা বলে তখন আশ্চর্য হলেও মুখে তা প্রকাশ করে না।
*******
—দিপেশ অক্ষরা আর অরুনিকাকে নিয়ে তার মায়ের ছোট্ট বাড়িতে এসে উঠে। অরুনিকার এই উপকারের জন্য সে এতটাই কৃতজ্ঞ যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। অক্ষরা কে পেয়ে যেন নিমিষেই সব দুঃখ ভুলে গেছে দিপেশ।
—অরুনিকা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। অক্ষরা এসে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আমি আপনার সাথে সব সময়ের জন্য ছিলাম। কিন্তু আপনি এই সব পরিকল্পনা কখন করলেন তা বুঝতে কেন পারলাম না? আর কর্ণভ টা কে?
—অরুনিকা মৃদু হেসে বলল, পরিকল্পনা কখনো হইহই করে কেউ করে না। ঠান্ডা মাথায় সব করতে হয়। কর্ণভ হলো আমার খুব কাছের একজন মানুষের খুনি।
—আপনার কাছের মানুষের খুনি কিন্তু সে রণককে কেন তাহলে অপহরণ করেছিল?
—কারণ রণকের জন্য সে ধরা পড়েছিল। আমি নিজেও জানতাম না রণকের অপহরণ কর্ণভ করেছে। যখন কর্ণভ ফোন দিয়ে আমাকে বলল, রণককে বাঁচাতে পারলে যেন বাঁচিয়ে দেখায়। তখন আমি চিন্তা করলাম এক ঢিলে দুই পাখি মারব। পতিতার মৃত্যুতে কর্ণভ শাস্তি পায়নি কিন্তু একজন প্রধানের স্ত্রী এবং অস্থায়ী প্রধানের মৃত্যুতে কর্ণভের যাবজ্জীবন অথবা ফাঁসি শিউর।
—আপনার কি একবারের জন্য ভয় লাগছে না। রণক যদি সত্যিটা বলে দেয় পুলিশকে। পেছন থেকে তখন দিপেশ বলল, এই ঘটনা জানার পর রণক বুঝতেই পারবে এই সব অরুনিকা করেছে। জীবন থাকতে রণকের মুখে অরুনিকার নাম উঠবে না নিশ্চিন্তে থাক তুমি অক্ষরা। অক্ষরা আর দিপেশ নিজেদের মাঝে কথা বলা শুরু করল।
—সকালের কনভারসেশন পর মৃণালের সাথে আর কোন কথায় হয়নি। ফোন ব্যাগ থেকে বের করে ফোন দিল অরুনিকা। মৃণালের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে তাই অরুনিকা আভাকে ফোন দিল। ফোন কান থেকে নামিয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে হাসল অরুনিকা। লগ্ন ছিল সন্ধ্যার। নিশ্চয়ই বিয়ে হ'য়ে গেছে এখন। কিন্তু একবারে জন্য আভা ফোন দেয়নি। দুজনের ফোন এখন বন্ধ অথবা হতে পারে সকালে মৃণালের সাথে কথা বলার পর থেকেই বন্ধ। আভা হয়তো এখন লজ্জাবোধ করছে দিদি হিসেবে পরিচয় দিতে তাকে। অরুনিকার চোখের কোণ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

মাঝে কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। রণক এখন অতিক্ষার সাথে নতুন সংসার শুরু করেছে। তাদেরকে দেখে বোঝার উপায় নেই এক সময় জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের। রান্না ঘরে চা বানাচ্ছিল অতিক্ষা। পেছন থেকে রণক এসে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুমু খায়।
—আহ! কি করছ বলত তুমি? জলখাবার তৈরি করতে দাওতো দুষ্টুমি করোনা।
—উঁহু! আজ আর ছাড়ছি না। ছুটির এই একটা দিনে বউয়ের সাথে যদি দুষ্টুমি না করতে পারি তাহলে জীবনে কি আর আছে! অতিক্ষার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট দিতেই নিয়েছে তখন কলিং বেল বাজলো।
—এই সাতসকালে কে আসতে পারে! রণক বিরক্ত হয়ে বলল, যেই আসুক এখন দেখবার প্রয়োজন নেই। এই বলেই অতিক্ষার ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে গভীর চুম্বনে ডুব দিতেই নিয়েছে তখন আবার কানে দরজা ধাক্কানোর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসল।
—রণকের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অতিক্ষা বলল, দেখ গিয়ে দরজায় কে! আমি জলখাবার টা ততক্ষনে বানিয়ে নেই।
—রণক বিরক্ত হয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায় রণক। দরজায় একা দাঁড়িয়ে আছে ফুটফুটে এক মেয়ে। বছর চারেক বয়স হবে।
—রণককে হটাৎ চুপ হয়ে যেতে দেখে ভেতর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে অতিক্ষা বেরিয়ে আসে। কি হলো তুমি চুপ কেন! কে এসেছে গো? দরজার কাছে আসতেই অতিক্ষা অবাক হলো। এই সাতসকালে একটা বাচ্চা মেয়ে তাদের দরজায় একা কেন দাঁড়িয়ে! রণক একবার অতিক্ষার দিকে তাকায় অতিক্ষা একবার রণকের দিকে।
—রণক মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল। তুমি এখানে কার সাথে এসেছ মা?
—মিষ্টি কন্ঠে ভাঙা ভাঙা শব্দে উত্তর দিল ছোট্ট মেয়েটি। মা-য়ে-র সা-থে এ-সেছি।
—কন্ঠ শুনেই যেন ভালো লাগলো অতিক্ষার। কি মিষ্টি মেয়ে গো বলেই সে নিজেও হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল। তোমার মা কোথায়?
—মেয়েটি বলল, মা- তো চ-লে গে-ছে।
—অতিক্ষা অবাক দৃষ্টিতে রণকের দিকে তাকাল। রণক ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মায়ের নাম কি?
—ভাঙা ভাঙা শব্দে মেয়েটি এবার যে নাম উচ্চারণ করল তাতে যেন রণক আর অতিক্ষা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছিল না। রণক বলল, কি বললে! আর একবার বলতো।
—ছোট্ট মেয়েটি বলল, শ্রী অরুনিকা গাঙ্গুলী।
দ্বিতীয় বার নাম শুনেই রণক জিজ্ঞেস করল মা কোনদিকে গেছে?
—ছোট্ট মেয়েটি হাত দিয়ে রাস্তার দিকে দেখিয়ে দেয়। রণক দৌঁড়ে বেরিয়ে যায়। অতিক্ষা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের মনের অবস্থা অতিক্ষা নিজেই বুঝতে পারে না।
—অনেক খোঁজাখুঁজি করেও অরুনিকাকে খুঁজে পায় না রণক।ছলছল চোখে বাড়িতে ফিরে দরজায় অতিক্ষার কোল থেকে বাচ্চাটিকে যখন কোলে নিচ্ছে রণক তখন অতিক্ষা বলল, ওর নাম রেহা সেন।
—রণকের চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গেল। টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তখন রেহা ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল, বা-বা তু-মি কাঁ-দ-ছ কেন?
—রণক অবাক হয়ে যায় সেই সাথে আর নিজেকে আটকাতেও পারে না। রেহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অতিক্ষাও নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারে না।
********
—বাড়ির দরজার সামনে একটা চিঠি কুড়ে পায় কাজের মেয়ে। চিঠি নিয়ে এসে আভার হাতে দিতে দিতে বলল, মাজি দো ওরাত আয়্যি থি। হাম খিড়কি ছে দেখা থা লেকিন দাড়ওয়াজা খোলকে দেখ্যা তো ওরাত ন্যাহি থি এ্যা চিটঠি প্যারি থি।
—চিঠি হাতে নিয়ে আভা দেখল উপরে সুন্দর হাতের লেখায় নাম লেখা অরুনিকা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসল আভার। বিয়ের দু'দিন আগে নিউজ চ্যানেল দেখে শাশুড়ী মা তাকে বলেছিল যদি কখনো অরুনিকার সাথে যোগাযোগ কর তাহলে আমার ছেলের সংসারে তোমার ওই দিনি শেষ হবে। তারপর নিজের জীবনের জন্য সে দিদির খোঁজ নেওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়ে ছিল। কাউচে বসে চিঠিটা খুলল। কয়েক লাইনের চিঠি।
প্রিয় আভা,
আমার ভালোবাসা আর আশীর্বাদ দিলাম। তোর করা ব্যবহারে প্রথমে কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু এখন শেষ মূহুর্তে এসে মনে হলো তোকে ক্ষমা করে আশীর্বাদ করে যাই। জীবন অনেক সুখী হ আমার আশীর্বাদ রইলো।
ইতি,
অরুনিকা
****
সূচনা পুরো বাড়ি চিৎকার চেঁচামেচি করে মাথায় তুলে রেখেছে। তার হুকুম ছাড়া এই শরীরে কে অরুনিকাকে বাইরে নিয়ে গেছে? অসুস্থ শরীরে ডাক্তার হাঁটাহাঁটি পযন্ত মানা করেছে সেখানে গাড়ি জার্নি করতে নিয়ে যাওয়ার সাহস কার হলো! একটা মেয়ে এসে বলল, অক্ষরা ম্যাডাম এসেছিল। অরুনিকা দিদি তার সাথেই বেরিয়েছে। সকালে উনি অনেক চেঁচামেচি করছিল আমরা উনাকে বের হতে দেইনা সেই-
—মেয়েটির কথা শেষ না হতেই বাড়ির ভেতর অরুনিকা ঢুকল কাশতে কাশতে। পেছন পেছন অক্ষরা। অরুনিকাকে দেখেই সূচনা দৌঁড়ে গিয়ে বলল, তুমি কবে থেকে কান্ডজ্ঞানহীন হলে বলো তো দিদি?
—অরুনিকা হাসতে হাসতে বলল, কেনরে কি হয়েছে?
—অরুনিকার হাসি দেখে সূচনা আর কিছু বলতে পারে না জড়িয়ে ধরে হু হু করে কান্না শুরু করে দেয়। সূচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অরুনিকা বলল, পাগলি একটা। এমন ভাবে কাঁদছে যেন আমি মরে গেছি।
—অক্ষরা বলল, আমি গেলাম অরুনিকা। বাড়িতে দিপেশ একা ছেলেকে সামলাতে পারছে না।
—অরুনিকা সূচনা কে সরিয়ে দিয়ে অক্ষরাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হটাৎ করেই বলল, হয়তো আর দেখা হবে না। আমার মেয়েটার মাঝেমধ্যে খোঁজ নিও। জানি রণকের কাছে অযত্নে থাকবে না কিন্তু হটাৎ করে রণক জানতে পেরেছে তার একটা মেয়ে আছে। সে এটা কে প্রথম অবস্থায় কীভাবে নিবে তা তো বোঝা যাচ্ছে না। বিশ্বাস না করলেও মেয়ের অযত্ন করবে না সে তারপরও তুমি একটু মাঝেমধ্যে খোঁজ নিও।
—অরুনিকার থেকে বিদায় নিয়ে অক্ষরা ট্যাক্সিতে উঠে বসে। জানালায় মাথা রেখে গত কয়েক বছরের অরুনিকার জীবনের কথা ভাবে অক্ষরা।
******
— কর্ণভ গ্রেফতার হওয়ার পর রাজিব পাগলের মতো অরুনিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অন্যদিকে আভা আর মৃণালের বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়ার কারণে অদিতিও প্রতিশোধ নিতে অরুনিকাকে খুঁজছিল। যেদিন দিলাত্রী সেনের খুন হলো তার পরের দিন অরনিকার খোঁজে রণক এসেছিল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে অরুনিকা কোথায় চলে গিয়েছিল তা না জানত অক্ষরা আর না জানত দিপেশ। কিছুদিন অক্ষরার কথা শুনে দিপেশ অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় অরুনিকার খোঁজ বের করতে।
কয়েকমাস পর হটাৎ একদিন গভীর রাতে অরুনিকা দিপেশের বাড়িতে আসে। অক্ষরাকে জড়িয়ে ধরে সেই দিন অরুনিকা বলেছিল আমাকে আশ্রয় দিবে অক্ষরা?
—অক্ষরার চোখে জল চলে আসে। এই সামান্য কথা জিজ্ঞেস করার কি আছে! অরুনিকার জন্য সে সমাজের স্বাভাবিক জীবন পেয়েছে। দিপেশের প্রাণ রক্ষাও তো অরুনিকা করেছে তাহলে গভীর রাতে এসে এমন বাচ্চা সুলভ আবদার করে অক্ষরাকে পর করে দেওয়ার কোন মানে হয় না। নিজের দিদির মতোই যদি আদেশ করত তোর এখানে থাকব এখন থেকে তাহলে অক্ষরা বেশি খুশি হতো।
—পরের দিন সকালে সব নিউজ চ্যালেন গুলোয় দেখাচ্ছিল ডক্টর অদিতির লাশ তার নিজের কেবিন থেকে উদ্ধার হয়েছে। সিসি ক্যামেরাই এক অজ্ঞাত নারীকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে কিন্তু মুখ ঢাকা থাকার জন্য তাকে চিহ্নিত করা যায়নি। হসপিটালের বাইরে অন্য কোন সিসি ক্যামেরা না থাকার কারণে অন্য কোন তথ্যও আর পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে শহরের নামীদামী বিজনেস ম্যান রাজিবের লাশ উদ্ধার হয়েছে তারই হোটেলের গুপ্ত এক রুম থেকে। যেখানে অনেক নারীকেই বন্দী অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে খুন কে করেছে সেই তথ্য এখনো জানা যায়নি। সবারই দাবী তারা এখানে বন্দী অবস্থায় আছে কয়েক বছর হলো। তাদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হতো। রাতে তাদের তৈরি হতে বলতে এসেছিল রাজিব তারপর কি হয়েছে তারা জানে না কারণ তারা সবাই জ্ঞান হারায়। মেডিকেল টেস্টে ওদের জবানবন্দি সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নিউজ শোনার পর অরুনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে অক্ষরা অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে। দিপেশ এগিয়ে এসে বলে দেওয়ালের কান আছে হাসি পযন্তই চেপে যাও। তারপ তারা তিনজনই এক সাথে হেসে উঠে।
—অক্ষরার বাড়িতেই অরুনিকা সন্তান জন্ম দেয়। ফুটে ফুটে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুনিকা ব'লে ওঠে একদম ওর বাবার মতোই দেখতে হয়েছে। সেইদিন অরুনিকার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
— অরুনিকা নিজেকে শক্ত করে মেয়েকে মানুষ করার জন্য নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিল তা যেন একদিন এক নিমেষেই ভেঙে গেল যখন অরুনিকার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। এরপর ডাক্তার যখন জরায়ুমুখে ক্যান্সারের কথা বলে তারপর একেবারে ভেঙে পড়ে অরুনিকা।
কিছুদিন অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে নিজেকে নতুন এক দৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ করে। আর তারপর থেকেই অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করা শুরু করে অরুনিকা। নিজের চিকিৎসায় টাকা ব্যায় না করে জামানো পুঁজি তে সে আশ্রম তৈরি করছে অবহেলিত নারীদের জন্য। দিপেশের থেকে ওয়াদা নিয়েছে ওই আশ্রমের নারীদের কখনো যেন অযত্ন না হয়। যে সব নারী পতিতালয় থেকে বেরিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় তারাই অপরা আশ্রমে স্থান পায়। নিজের কাছের বান্ধবীর নামে শুরু করেছে এই আশ্রম অরুনিকা।
*****
প্রায় এক সপ্তাহ খোঁজ খুঁজি করে রণক দিপেশর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। বাড়িতে দিপেশ ছেলেকে নিয়ে খেলছিল তখন রণক উপস্থিত হয় ওর সামনে। প্রায় পাঁচ বছর পর দিপেশ আর রণকের দেখা হলো। প্রথমে রণক কিছুই বলতে পারছিল না। লজ্জায় যেন মাথা তুলেই তাকাতে পারছিল না রণক।
— দিপেশ বলল, এতদিন পর হটাৎ কি মনে করে?
—রণক তখন আড়ষ্টভাব কাটিয়ে বলল, ঠিকানা বদল করেছিস তো তুই।
—ওহ তাহলে বলতে চাচ্ছিস ঠিকানা খুঁজে বেড় করতে পাঁচ বছর লাগলো?
—রণক আর কিছু বলতে পারে না। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, তুই কি অরুনিকার খোঁজ জানিস? আমি সব রেড লাইট এরিয়া খুঁজেছি কিন্তু ওর খোঁজ পায়নি।
—রেডলাইট এরিয়াতে খুঁজলে ওর মতো সংগ্রামী নারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে তুই ভাবলি কি করে? ভালোবাসা চিহ্ন নিয়ে কোন নারী পতিতাবৃত্তি করতে পারে না রণক।
—রণক যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। এই কথা সত্যি তার মাথায় আসেনি। আজ সাতদিন হলো রেহা তার কাছে আছে। রেহা যদি সত্যি অরুনিকার মেয়ে হয় তাহলে এত সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে কেউ রেডলাইট এরিয়াতে থাকবে না। এই কথা তার মাথায় কেন এলো না! দিপেশের দিকে তাকিয়ে রেহার কথা মুখে না বলে সে বলল, ভালোবাসার চিহ্ন মানে?
—দিপেশ হেসে উঠে বলল, তার মানে রেহা কে নিয়ে এই সাতদিন কাটানোর পরেও এখনো বুঝতে পারিসনি ওটা তোর মেয়ে।
—রণক আর কিছু বলতে পারে না তার মানে দিপেশ সব কিছু জানে। রেহা যে ওর নিজের সন্তান হতে পারে এই বিষয়ে মনের কোথাও না কোথাও সন্দেহ পোষণ করছিল রণক। কিন্তু দিপেশের কথায় পরিষ্কার হয়ে গেল রেহা ওর নিজের সন্তান।
—রণক ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। অরুনিকার সাথে সে সত্যি অনেক বড় অন্যায় করেছে। দিপেশের কাছ থেকে যাবতীয় ঘটনা শোনার পর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রণক। দিপেশের কাছে রিকুয়েষ্ট করে তাকে যেন একবারের জন্য অরুনিকার কাছে নিয়ে যায়।
—নিজের ছোট্ট বেলার একমাত্র বন্ধু আর ছোট ভাইয়ের আবদার মিটাতে দিপেশ যখন ছেলেকে কোলে তুলে রণককে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি তখন অক্ষরার কল আসে।
অরুনিকা নেই।
*****
অবহেলিত এক দল নারী শ্মশানের সামনে জড়ো হয়েছে। তারা জোরপূর্বক হলেও শ্মশানেই অরুনিকার লাশ দাহ করবে। কিন্তু শ্মশানের পুরোহিত একজন পতিতার লাশ কোন ভাবেই শ্মশানে ঢুকতে দিবে না। অনেক জোড়াজুড়ির পরে যখন দাঙ্গা হাঙ্গামা করে শ্মশানে ঢুকতে নেয় তারা তখন পুলিশ এসে তাদের উপর লাঠিচার্জ করে।
— মেয়েরা বাধ্য হয়ে অরুনিকার লাশ কাঁধে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল কাঁদতে কাঁদতে বল হরি হরি বল। তখন মৃণাল আসে আভাকে সাথে নিয়ে। অরুনিকা মৃত্যুর আগে বলেছিল, তার মৃত্যুর খবর যেন না দেওয়া হয় আভাকে কিন্তু সূচনা সেই কথা রাখেনি।
—অক্ষরা অনেক হাঁটাহাঁটি করে এসেছে পুলিশ সুপারের অর্ডার নিয়ে। অরুনিকা যেসব মানবাধিকার সংগঠনের সাথে জড়িত হয়েছিল এই কয়েকবছরে সেখান থেকে কিছু উচ্চ মনের নারী-পুরুষ এসেছে।
তারা পুরোহিতের উপর গর্জে উঠে বলল, পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ।তারপর ওই সব নারীরা সমাজে আজও গ্রহণযোগ্য না তোমাদের মতো সমাজের একগুঁয়ে কিছু মানুষের জন্য। আর যে নারী পতিতাবৃত্তি ছেড়ে সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য এত উন্নয়ন কাজ করেছে তার লাশ এইভাবে অবহেলিত হতে পারেনা। এই বলে সবাই মিলে লাশ নিয়ে শ্মশানে ঢুকে। মৃণাল আর আভা আসলেও অক্ষরা তাদের লাশের কাছে যেতে দেয় না।
আভা হাউমাউ করে মৃণালের বুক কাঁদে। মৃণালের চোখেও জল। একদিন সে নিজে সমাজের বিরোধিতা করেছিল। অপরার লাশ নিয়ে গিয়ে দাহ করেছিল অরুনিকার সঙ্গে কিন্তু এখন তার নিজের ছোট্ট মন মানসিকতার জন্য দাহ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারল না।
—রণক আর দিপেশ যতক্ষণে এসে পৌঁছে ততক্ষণে অরুনিকার লাশ দাউদাউ করে জ্বলছে। রণক নিজেকে সামলাতে পারে না। অরুনিকার ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। যে ভালোবাসার চিহ্ন যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে তার জন্য সেই রকম কাজ সে করে গেছে জীবনে কিন্তু রণক অরুনিকাকে ভুলে গেছিল। ভালোবাসার মানুষকে ভুলে সে দিব্যি ঘরসংসার করছিল। নিজেকে ধিক্কার দেয় রণক।
—অরুনিকা পতিতা ছিল কিন্তু জীবনে সে শুধু সংগ্রাম করে গেছে তাই পতিতা হওয়া স্বত্বেও তার মৃত্যু ছিল সম্মানজনক।
******
রেহা সেন স্কুলে পড়ে। রেহার বাথ সার্টিফিকেটে মায়ের নাম অরুনিকা গাঙ্গুলি। সে নিজের মায়ের পরিচয় দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। মেয়েকে দেখে রণক মনে মনে ব'লে, অরু আমি তোমার আমার প্রেম সারাজীবন জীবন্ত রাখব আমাদের রেহার ভেতর।


সমাপ্ত...........



গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)

পার্ট:-১৪ (শেষ পর্ব)
লেখনীতে: সামিনা সামি

Post a Comment

0 Comments