Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ঋণী

শ্যাওড়াফুলির ঘাটে অমিতের ঠিক সামনেই টিকিটটা কেটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো মেয়েটা।কাউন্টার থেকে দু তিনবার ভদ্র লোকটির সারা-

-'শুনছেন..আপনার রিটার্নটা নিয়ে যান।শুনছেন..।'



পিছুডাক কানে পৌছালোনা মেয়েটার।কাউন্টারের ভদ্রলোকটি তখন অমিতকে টিকিট দিয়ে বলল-
-'আপনি প্লিজ ওনাকে এই টাকাটা একটু দিয়ে দিন না।আপনি যাচ্ছেন যখন।'
আমি ভদ্রলোকটির কাছ থেকে খুচরো চুয়াল্লিশটা টাকা হাতে নিয়ে জলদি সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলাম মেয়েটাকে তার রিটার্নের টাকাটা ফিরিয়ে দিতে।
ঘাটে তখন সবে মাত্র লঞ্চ এসে দাঁড়িয়েছে।যথারীতি যাত্রীদের ভিড়ে আশপাশটা পরিপূর্ণ।আমায় সামান্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হলো।আশ্চর্য ব্যাপার এই যে,এ পাড়ের সবাই এমনকি আমিও উঠে যাওয়ার পর জায়গাটা খালি হতে তারপর মেয়েটা ধীরেসুস্থে লঞ্চের দিকে পা বাড়ালো।লঞ্চের ধার এবং ঘাটের শেষ সিঁড়িটার মাঝে কিছুটা ফাঁক ছিলো।বুঝলাম,মেয়েটা সেটা দেখেই সাহস করে পা বাড়িয়ে আসতে পারছেনা।এদিকে লঞ্চ ছাড়বো ছাড়বো করছে,তাই আমি সামনেই ছিলাম, অতশত না ভেবে মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।আর দিলাম তো দিলাম,যে হাতে মেয়েটারই টাকাগুলো ছিলো।মেয়েটাও যেন নির্দিধায় আমার হাতটা শক্তভাবে খামচে ধরে উঠে এলো।ওঠবার সময় ওর চোখ দুটো আশঙ্কায় প্রায় বুজেই গিয়েছিলো।কিন্তু,যেটা ঘটলো, সেটা হলো যে ওর খামচানোয় আমার হাতের মধ্যে থেকে সবটাকা মা গঙ্গার বুকে তলিয়ে গেলো।মাত্র ওই চার টাকার খুচরোটা বাদে।মেয়েটা লঞ্চে উঠেই আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দেখলো-আমার হাতে খুচরো চার টাকা।সে আমায় ইতস্ততভাবে বলল-
-'আপনার হাতে কী টাকা ছিলো?'
আমি আলতুভাবে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম।মেয়েটা বলল-
-'ইসস...আমার জন্য আপনার..কত টাকা ছিলো বলুন।আমি দিয়ে দিতে চাই।আমার জন্য আপনার..'
আমি তখন বললাম-
-আরে..ওটা আপনারই টাকা ছিলো ম্যাডাম।আপনি ঘাট পাড়া পাড়ের টাকা দিয়ে চেঞ্জটা আর আনেননি।আমার হাত দিয়ে কাউন্টারের ভদ্রলোকটি ফেরত পাঠিয়েছিলেন।'
লঞ্চটা তখন নদীর ঢেউয়ে সামান্য হেলতেই মেয়েটা ফের ভয় পেয়ে অমিতকে বলল-
-'একটু ভেতর দিকে চলুন না।'
বলে মেয়েটা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলো ও তার পিছু নিলো অমিত।যেতে যেতে অমিত খাটো গলায় মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো-
-'আপনি কী আজ প্রথম লঞ্চে উঠছেন?'
মেয়েটা ক্ষীন অবাক দৃষ্টিতে বলল-
-'কীকরে বুঝলেন?'
অমিত বলল-
-'কী জানেন তো, মানুষের চোখটাই হলো মানুষের মন।ভয় যে পাচ্ছিলেন,তা নিশ্চই অস্বীকার করবেন না?'
তারা দুজন একটা জায়গায় যেয়ে দাঁড়ালো।তারপর মেয়েটা জবাব দিলো-
-'হুম..প্রথম..আসার সময়ও ভয় লাগছিলো।আসলে আজই আমার ক্লাস শুরু হয়েছে।আমি ব্যারাকপুরে থাকি। শ্যাওড়াফুলি বি.এড কলেজে ভর্তি হয়েছি,আর আজই ক্লাস স্টার্ট হয়েছে।কিন্তু ভাবছি পরের দিনও তো আমার ভয় লাগবে।দু দুটো বছর এখন আমায় এই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।'
মেয়েটার কথাগুলো শুনে অমিত এবার কৌতুকের ছলেই হেসে বলল-
-'দেখে তো মনে হয় বছর একুশ বাইশ।এখনো এত ভয় জলকে?'
মেয়েটা বলল-
-'সাঁতার জানিনা তো।'
অমিত বলল-
-'মজা করছেন,আমি করলাম বলে?'
মেয়েটা বলল-
-'জলে ওপরে দাঁড়িয়ে মজা।মাথা খারাপ।'
লঞ্চ ঘাটে চলে এলো।এবার নামার সময় মেয়েটার নামতে আর অমিতের সাহায্য লাগলোনা।সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অমিত পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেখলো-খুচরো চল্লিশ টাকা তাতে নেই।
তাহলে মেয়েটাকে ফেরত দেবে কীকরে?সে তখন মেয়েটাকে বলল-
-'এই রে..আমার কাছে যে খুচরো নেই।আপনার ওই টাকাটা দেবো কীকরে?'
মেয়েটা বলল-
-'ওটা তো আমার দোষেই জলে গেছে।দিতে হবে না।তবে ভাগ্যিস টাকাকটাই ছেড়ে ছিলেন,আমার হাতটা ছেড়ে দেননি।'
বলে হা হা হা..হাসতে লাগলো।অমিত বলল-
-'এবার তো মজা করছেন? '
মেয়েটা বলল-
-'বললাম না জলের ওপরে করিনা।কিন্তু, আড়াতেও যে করিনা সেটা কে বলল?'
অমিত বলল-
-'আপনাকে টাকাটা নিতেই হবে।আপনার ফোন পে বা গুগুল পে আছে?'
মেয়েটা বলল-
-'ফোন নাম্বারটা নেওয়ার জন্য এত কিছু?'
অমিত তখন বলতে যাবে যে...মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল-
-'আরে আবার মজা করছি।নিন নিন.. লিখুন।বলছি।'
অমিত নাম্বারটা নিজের ফোনে লিখলো।তারপর জানতে চাইলো-
-'নামটা?'
মেয়েটা বলল-
-'জিয়া?'
অমিত বলল-
-'জিয়া কী?মানে টাইটেলটা কী?'
মেয়েটা বলল-
-'জিয়া ধড়ক ধড়ক জায়ে..।'
অমিত বলল-
-'আবার ইয়ার্কি?ওকে,আমি শুধু জিয়াই লিখলাম।'
অতঃপর ফোন পে,গুগুল পে সবেতেই সার্চ করতে বুঝলো জিয়ার কোনো একাউন্টই নেই।অমিত বলল-
-'কী ব্যাপার নাম্বারটা ভুল টোকা হয়ে গেলো নাকি?'
জিয়া বলল-
-'না মশাই।আপনি নাম্বারটা ঠিক টুকেছেন।আমার কোনো একাউন্ট নেই ওসবে।'
অমিত বিষ্ময়ভরা ঠোঁটে প্রশ্ন করলো-
-'তাহলে?'
জিয়া বলল-
-'তাহলে আর কিছুই নয়।আমায় একটা মিসডকল করুন।আপনার নাম্বারটা নিয়ে রাখি।আবার কখনও যদি লঞ্চে উঠতে ভয় লাগে তো ফোন করবো প্রথম আপনাকে।আসবেন তো?'
অমিত বলল-
-'আবার ইয়ার্কি?এই নিয়ে তিন তিন বার।'
জিয়া বলল-
-'মোটেই না।এটা তিন সত্যি।দু বছরের ব্যাপার এটা।চেনা শোনা একজন না থাকলে যদি কোনোদিন এই নদীতে ডুবেও যাই।সঙ্গে সঙ্গে আর বাড়িতে খবরটা দেবে কে?'
অমিত বলল-
-'অনেক হয়েছে।আর না।'
জিয়া বলল-
-'আপনার নাম পরিচয়ই তো নেওয়া হলো না।'
অমিত নিজের নাম জিয়াকে জানালো এবং এটাও জানালো যে তার বাড়ি সোদপুর।ওদিকে সিঙ্গুর যায় কাজের জন্য।মেয়েটা এই শুনে বলল-
-'কখন যান আর কখন ফেরেন?'
অমিত বলল-
-'যাই সকাল আটটার মধ্যে।তবে ফিরি এমন সময়ই।নাম্বার তো রইলোই।কাল কলেজ আসবেন নিশ্চই।কাল যোগাযোগ করে টাকাটা দিয়ে দেবো।আজকে বরং খুচরো চার টাকাটা রাখুন।'
জিয়া বলল-
-'একবারে দিও।হিসেব রাখতে পারবোনা।'
বলে ফের হাসলো।এবার অমিতও না হেসে থাকতে পারলোনা।
পরদিন ফোনে যোগাযোগ করে ফেরার পথে লঞ্চে তাদের সাক্ষাৎ হলো।অমিত প্রথমেই জিয়াকে তার চুয়াল্লিশ টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলো।জিয়া বলল-
-'আজ আমার রাশিফল দেখেছি।আজ আমার কিছু প্রাপ্তি নেই।অতএব,নিলে যদি হারিয়ে যায়।নেবোনা।'
অমিত বলল-
-'আপনি আবার এসব রাশিফলটল মানেন নাকি?'
জিয়া বলল-
-'জলে যাত্রা করছি।সাবধানতা না নিয়ে বেরোই বা কীকরে?যদি বিপদের ইঙ্গিত থাকে তো আগাম জেনে যাব।তাই রাশিফল দেখছি ইদানীং।'
জিয়া টাকাটা নিলোনা।এভাবে না না করে দিন দশ হয়ে গেলো।নানা অছিলায় জিয়া অমিতের থেক সেই টাকাটা আর নিলোনা।এগারো দিনের দিন অমিত জিয়াকে বলল-
-'আজ আর কোনো অজুহাত নয়।টাকাটা নিতেই হবে।আমার এবার কেমন যেন ঋণী বলে মনে হচ্ছে নিজেকে।'
জিয়া বলল-
-'কিন্তু আপনি আপনার ঋণ শোধ করে দিলে আর তো আমার সাথে ফিরবেনা না।তাই নিচ্ছিলাম না।'
জিয়া তার এই কথার মধ্যে দিয়ে কী ইশারা করতে চাইছে অমিত ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা।তাই সে জিয়াকে জিজ্ঞেস করলো-
-'মানে?'
জিয়া বলল-
-'যে হাতটা টাকা ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা হাত শক্ত ভাবে ধরতে জানে,তার সাথে জল পথে গেলে কী জানেন তো সাহসটা পাওয়া যায়।'
অমিত তখন বলল-
-'ঠিক আছে।ফেরার পথে নয় আমরা এক সঙ্গে যাবো।কিন্তু,ঋণী থাকতে চাইনা আমি।'
জিয়া বলল-
-'আচ্ছা বেশ।ঋণ শোধ করতে চান তো?তাহলে অন্য একটা উপায় আছে।আপনি এই চুয়াল্লিশ টাকাটার বদলে আপনাকে আমায় 'তুমি' বলতে দিন।তাহলেই শোধ হয়ে যাবে।'
অমিত বলল-
-'চুয়াল্লিশ টাকার পরিবর্তে তুমি?একটা 'তুমি'র দাম এর চেয়ে অনেক কম।আপনি এমনিই আমাকে তুমি বলতে পারেন।'
জিয়া বলল-
-'আমি এমনি তো কিছু নিইনা।তাহলে এক কাজ করো।তুমি আমার কাছে চুয়াল্লিশ টাকার জন্য ঋণী হয়ে থাকো।আর আমি এই 'তুমি'টার জন্য তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকি আজ থেকে।'
অমিত বলল-
-'তাতে করে তো এসব আর কোনোদিনও শোধ করা হবেনা।আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো একে অপরের কাছে?'
জিয়া বলল-
-'ঋণী না থাকলে কাছে আসবো কীকরে?'
অমিত বলল-
-'তাহলে তোমার আর কোনোদিন জলের ভয়টা ভাঙবেনা।'
জিয়া বলল-
-'ভয় না ভাঙুক।সাহস জোগানোর মত এক জনকে তো পাশে পাবো।'
-শুভঙ্কর সাউ


#গল্প: ঋণী
লেখকঃ Jesmin Akter Neha
অনুগল্প

Post a Comment

0 Comments