Header Ads Widget

Responsive Advertisement

অ্যানিভার্সারি

জানিস, জানিস আমার কাল অ্যানিভার্সারি। বিয়ের জন্মদিন। হেহেহেহে। তোরা আসবি তো? কাল তোরা সব্বাই আসিস। কেমন? আমি সুন্দর করে সাজব। খুব সুন্দর করে সাজব। পাঞ্জাবি পরব। ধুতি পাঞ্জাবি। আরে হৈমন্তী খুব পছন্দ করে যে। আমাকে ধুতি পাঞ্জাবি ও'ই তো কিনে দিয়েছিল। আমার ভাল লাগত না। বিশেষ করে ওই ধুতি পরতে আমার একদম ভাল লাগত না। পারতাম না তো। কিন্তু ও আমাকে বলেছিল, ধুতি পরলে আমাকে খুব সুন্দর লাগে। একবার পরলাম। তারপর আমরা একসাথে ফটো তুলেছিলাম। ওই যে। ওই যে আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে যে ফটোটা লাগানো আছে, সেই ফটোটা। দেখলাম যে সত্যি সত্যি আমাকে খুব সুন্দর লাগছে। তারপর থেকে প্রত্যেক অ্যানিভার্সারিতে আমি ধুতি পাঞ্জাবি পরি। হৈমন্তীকে আমি গিফ্ট ও দেব। কাল তো আমি নিজের হাতে সব রান্না করব। চিকেন কষা, খাসির কালা ভুনা, পনির মনপসন্দা, পোলাও। হৈমন্তী মিষ্টি দই আর পায়েস রান্না করবে। আমি ওইদুটো খরান্না করতেই পারি। কিন্তু হৈমন্তী আমার থেকেও ভাল করে ওই দুটো। আর, আর তারপরে তোরা সবাই এলেই, আমরা অনুষ্ঠান শুরু করব। আরে বলাই হয় নি তো। এই বছর আমাদের বিয়ের পনেরো বছর বয়স হবে। আমি আর হৈমন্তী আমরা দুজনেই ভেবে রেখেছি, যখন আমাদের বিয়ের কুড়ি বছর বয়স হবে, তখন আমরা আবার নতুন করে বিয়ে করব। হাহাহাহা। নতুন করে ছাদনা তলায় যাব। মালাবদল হবে। কিন্তু, কাল তোদের সবার আসা চাই। কেমন?


স্যার, স্যার...আজ অমলেশবাবু সারাটা দিন ধরে সবাইকে এই একই কথা বলছেন। যাকে পাচ্ছে, তাকেই ধরে ধরে একই কথা বলে যাচ্ছেন। সিস্টার রিতা ডক্টর অর্জুনকে দিকে বললেন।
ওহ। মনে হচ্ছে অমলেশবাবু আজ আবার ক্ষেপেছেন। আচ্ছা, আজ কত তারিখ? আজ তো ডিসেম্বরের সতেরো। ওহ, হ্যাঁ। এর পরের দিনেই তো...চুপ করে গেলেন ডক্টর। একটু পরেই জিজ্ঞেস করলেন, সিস্টার, ওনাকে ওষুধ দিয়েছেন তো?
হ্যাঁ স্যার। ওনাকে সময়মত ওষুধ দিয়ে দিয়েছি।
মনে হচ্ছে ডোজটা বাড়াতে হবে। ঠিক আছে। আমি প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছি। কাল থেকে এই নতুন ওষুধ শুরু করবেন। বলে ওঠেন ডক্টর।
ঠিক আছে স্যার। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ওনার কী হয়েছিল? ওনাকে তো সবসময়েই দেখেছি খুব নিজের মধ্যে থাকেন। সবার সাথেই ভাল ভাবে কথা বলেন। আজেবাজে কোনও বায়নাক্কা নেই। কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার ও করেন না। দেখে তো মনে হয় উনি খুব ভাল আছেন। ওনাকে কেন এখানে রাখা হয়েছে? ওনাকে দেখে সুস্থ বলেই তো মনে হয় আমার।
সেটা ঠিক। উনি এমনিতে খুব ভাল। দেখে মনে হবে না যে ওনার কোনও রোগ আছে। কিন্তু, কিন্তু অনেকদিন আগে উনি এই ডিসেম্বরের আঠেরো তারিখে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন। আঠেরোই ডিসেম্বর ওনার অ্যানিভার্সারি ছিল। সেই দিনটার কথা উনি আজ ও ভুলতে পারেন নি।
সিস্টার রিতা ভয়ে আঁতকে ওঠেন। নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করেন, স্যার, আপনি কি এখন বাড়িতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ সিস্টার। পরের কয়েকটা দিন আমি ছুটিতে আছি। কাল ডক্টর শুভঙ্কর রায় এসে চার্জ নেবেন। ওনাকে আপনি নতুন পেশেন্টদের ফাইলগুলো দিয়ে দেবেন। পুরনো পেশেন্টদের ব্যাপারে উনি সব জানেন। গুড নাইট সিস্টার।
গুড নাইট ডক্টর।
বাড়ি ফিরে আসেন ডক্টর অর্জুন। ওনার মনে আজ খুব আনন্দ। শরীরেও। আজ যে ওনার তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। অন্যদিন ওনার ফিরতে রাত হয়ে যায়। সেটা নীলিমা ভাল করেই জানে। আজ ও ফোন করে ও নীলিমাকে বলেছিল ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আটটা বেজে যাবে।
নীলিমা রাগারাগি করেছিল প্রথমে। কিন্তু নীলিমা নিজেও যেহেতু একটা কর্পোরেট হসপিটালের ডক্টর, ও জানে একজন ডাক্তারের কাজের গুরুত্ব। পরে ফোন করে ও সরি বলেছিল। আর বলেছিল রাতে একসাথে বাইরে খেতে যাবে। সেখানে অর্জুনকে আদ্যপান্ত বাঙালি সাজতে হবে। ধুতি পাঞ্জাবি পরে। সেই ধুতি পাঞ্জাবি ও নীলিমা নিজে পছন্দ করে কিনেছে। এছাড়া ও নীলিমা আর ও বলল যে ও একটা বিশেষ সারপ্রাইজ দেবে।
অর্জুন সারাটা দিন ধরে ভেবে এসেছে কী সেই সারপ্রাইজ। নীলিমা এমনিতে খুব শান্ত স্নিগ্ধ স্বভাবের মেয়ে হলেও, বিছানায় ও বাঘিনী হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝেই ও ভীষণ সাহসী পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে তুলে অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন অর্জুন নিজেকে সামলাতে পারে না কিছুতেই।
নিজের মনে হেসে ওঠে অর্জুন।
বাড়ির সামনে এসে দরজায় দাঁড়ায় ও। হাতঘড়িতে সময় তখন সন্ধে ছটা। পকেট থেকে চাবিটা বের করে। ঘরের ভেতরে ঢুকে ও দেখে বাইরের ঘরে সোফার ওপরে রাখা আছে একটা ধুতি পাঞ্জাবির সেট। খুব সুন্দর রং ধুতি পাঞ্জাবির। পাঞ্জাবিটা ঘন নীল রঙের। তার ওপরে সোনালি সুতোর কাজ করা। আর ধুতিটা সাদা রঙের, সাথে পাড়গুলো ঘন নীল রঙের। খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু নীলিমা কোথায়? ও। নিশ্চয়ই রান্নাঘরে। ধীরে - সন্তর্পণে - পায়ে আওয়াজ না করে অর্জুন ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। হাতে ধরে ছিল ধুতি পাঞ্জাবিটা।
হঠাৎ কথা বলার আওয়াজে, খিলখিল হাসির শব্দে ও চমকে যায়। নীলিমা কারোর সাথে কথা বলছে মনে হয়। কিন্তু এভাবে ফিসফিস করে কথা বলছে কেন?
বেডরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় অর্জুন। ও শুনতে পায়। নীলিমা আদুরে স্বরে কাউকে বলছে, বিনয়, আজ না। আজ দেখা করা যাবে না বিনয়। প্লিজ। লক্ষীটি। শোনো, আজ আমার অ্যানিভার্সারি। আমি আজ অর্জুনকে সারপ্রাইজ দেব। ও একটু পরে চলে আসবে। স্পেশাল খাওয়াদাওয়া হবে। সাজগোজ করে বেরোব আমরা। কী? না না। স্পেশাল সারপ্রাইজ শুধু ওর জন্য। তোমাকে...আরে না...না। তোমাকে বলা যাবে না...আচ্ছা। আচ্ছা বাবা। তুমি পারোও সত্যি। আরে তুমি আমাকে সেই যে সেই ড্রেসটা দিয়েছিলে...না না। ওটা আমি শুধু আমার অর্জুনকেই দেখাব...না না। ওটা পরে আমি তোমাকে...কী? ভিডিও কল? এখন? না না....না সোনা। এখন...আচ্ছা। ওয়েট করো। না না। এখনই তোমাকে কীভাবে ভিডিও করে...তোমার সামনে আমি সবকিছু খুলে চেঞ্জ করব? পাগল নাকি? আমি পারব না। তবে ওটা পরে আমি ভিডিও কল করছি। কিন্তু জাস্ট দু মিনিট। তারপরে আবার পরে কথা হবে।
অর্জুন চমকে যায়। রাগে ওর সারাটা শরীর রি রি করে ওঠে। মাথাটা দপদপ করে কাঁপতে থাকে ওর। বিনয়? বিয়ের আগে একটা ভালবাসার সম্পর্ক ছিল নীলিমা আর বিনয়ের মধ্যে। বিনয় নিজেও এখন বিবাহিত। কিন্তু এখনও নীলিমা আর বিনয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে? নীলিমা বলেছিল বটে যে বিনয় ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নীলিমা এটাও বলেছিল যে ও বিনয়কে পাত্তা দেয় নি। তাছাড়া আজকাল এই হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের জগতে কতজনকে অস্বীকার করা যায়? পৃথিবীটা এত ছোট হয়ে গেছে যে সবাই সবাইকে দেখছে। কথা বলার চেষ্টা করছে। সবাইকে কি সরিয়ে রাখা যায়? নীলিমা আর ও বলেছিল যে বিনয় ছিল ওর অতীত। আর অর্জুন ওর বর্তমান। অতীত কখনও ওর জীবনে আসবে না। তাছাড়া অর্জুনের নিজের ও তো অতীত ছিল। সবার জীবনেই থাকে। সেটাকে কি অস্বীকার করা যায়?
কিন্তু, কিন্তু বিনয়ের সাথে এটা ও কী করছে? এটাই কি ওর অতীতকে অস্বীকার করার নমুনা? এটা তো পাত্তা দেওয়াই শুধু না, তার থেকে আর ও অনেক বেশি। আমার ও আগে, আর একজন বাইরের কেউ আমার নীলিমাকে দেখবে? ওই বিশেষ রকমের পোশাকে? যে সারপ্রাইজটা শুধুই আমার জন্য ছিল, সেটা আসলে ভুয়ো? আমাকে বোকা বানানো হচ্ছে?
ভাবতে ভাবতে অর্জুনের হাত থেকে পাঞ্জাবিটা পড়ে যায় মেঝেতে। ও ধুতিটা দু হাতে ধরে পাকাতে থাকে। যেন ফাঁসের দড়ি। এভাবেই তো অমলেশবাবু ওনার স্ত্রী হৈমন্তীর গলায়...


সমাপ্ত
----------- 
গল্প: অ্যানিভার্সারি
লেখনীতেঃ জয়ন্ত অধিকারি

Post a Comment

0 Comments