Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বুক চাপা কষ্ট

 আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।স্কুল পালিয়ে আমি প্রায়ই অদিতির সাথে দেখা করতে যেতাম। কি অদ্ভুত আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো।গার্লস স্কুলের গেটের সামনে গিয়ে স্কুলের সাদা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করে হাতের মুঠোয় একটা সস্তা গোলাপ নিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতাম আমি।

বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পায়চারী করা সেই দুপুরগুলো ছিলো পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়। ছুটির ঘন্টা বেজে উঠতেই বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠতো। একই ইউনিফর্মের অনেকগুলো মুখের ভীড়ে নিজের প্রিয় মুখটাকে ইতিউতি করে খোঁজার পালা শুরু হতো আমার।
প্রায় ৩ মাস আমি অদিতির পাশাপাশি হেঁটে তাদের বাসা পর্যন্ত গিয়েছি কিন্তু কখনো ওর হাত ধরতে পারিনি।রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রচন্ড ভয়ে একদিন অদিতি যেদিন আমার বাহু খামচে ধরেছিলো, আমার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিলো।কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অদিতির কাছে কোন মোবাইল ফোন ছিল না।মাঝে মাঝে ওর বাবার ফোন থেকে মিসকল দিতো,ফিসফিস করে মিনিট দুয়েকের মত কথা হতো আমাদের।কখনো ভালোভাবে বিদায় নেয়া হতো না,খট করে ফোন কেটে যেতো, মেসেজ আসতোঃ-"বাবা চলে আসছে, আর ফোন বা মেসেজ দিও না খবরদার।


বড় বড় রেস্টুরেন্ট কিংবা ফাস্টফুডের মত বিলাসী প্রেম ছিল না আমাদের।ফুচকার প্লেটের টক ঝাল প্রেম ছিল আমাদের। সেই প্রেমে যেমন বসন্ত ছিল তেমনি কালবৈশাখী ঝড় ও ছিল। ভার্সিটি পাস করে বের হওয়ার পর একদিন সব ভেঙ্গেচুড়ে শেষ হয়ে গেলো।
অদিতির বাসা থেকে জানানো হলো, এক মাসের মাঝে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।আমি তখন বেকার , দিনের বেলা ঘুরে ঘুরে ইন্টারভিউ দিই, রাতের বেলা বিডিজবস এ শুধু চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করে যাই।রাত ফুরিয়ে দিন হয়, দিন ফুরিয়ে রাত হয় সবই হয়,শুধু আমার চাকরিটাই হয় না।
রূপকথার গল্পের মত কিছু একটা ঘটে গেলো একদিন।আমার চাকরি হয়ে গেলো, শুধু অদিতিকে 'বেলা বোস' এর মত খবরটা দিতে পারলাম না।2441139 ডায়াল করলেও অদিতির কাছে ফোন যায় না।অদিতি তখন নিউ ইয়র্কে থাকে।স্বামীকে নিয়ে বিয়ের পরই চলে গেছে।আমার স্পষ্ট মনে আছে,অদিতির বাবার নাম্বারে ফোন দিয়ে আমি একশোবার চিৎকার করে বলেছিলামঃ-"আমি অদিতির সাথে ১ মিনিট একটু কথা বলবো, প্লিজ"।সেই ১ মিনিট আমি পাই নি।
অদিতিকে ছাড়া আমি বাঁচবো না - বিষয়টা এমন ছিল না।এমন থাকলেও আমার মরে যাওয়ার অপশন ছিল না।বাস্তবতা অনেক কঠিন।উপন্যাসে কিংবা সিনেমায় হয় পালিয়ে বিয়ে করা যায়, অথবা মরে যাওয়া যায়।বাস্তবে এগুলার কিছুই করা যায় না।শুধু সহ্য করা যায়,দাঁতে দাত চেপে কষ্ট সহ্য করা যায়।
জীবনটা অদ্ভুত।ওর বিয়ের ২ বছরের মাথায় রোড অ্যাক্সিডেন্টে ওর স্বামী মারা যায়।অদিতি দেশে চলে আসে।আমি এসবের কিছুই জানতাম না।একদিন এই ব্যস্ত শহরটাতে হুট করে অদিতির সাথে দেখা হয়ে যায়।তারপর অনেক অনেক ঘটনা।মাঝে মাঝে জীবনের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। আগষ্ট মাসের ২৩ তারিখে সন্ধ্যায় আমার সাথে অদিতির বিয়ে হয়। প্রথমবার যখন অদিতির বিয়ে হয়ে যায় তখন আমি একটুও কাঁদিনি কিন্তু আমার সাথে বিয়ে হওয়ার সময় কাবিননামায় সই করতে গিয়ে আমি বোকা ছেলের মত ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলি।আনন্দের কান্নার ব্যাপারটা অন্যরকম। কেমন যেন স্বর্গীয় রকমের সুন্দর।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। কৈশোরের সেই প্রেমের সময়টাতে অদিতি দুষ্টুমি করে আমাকে বলতো, বিয়ের পর অদিতি আর আমি মিলে একগাদা বাচ্চা নিয়ে একটা ফুটবল টিম বানাবো। আমি হাসতাম।গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফুটবল টিমের প্রথম সদস্য ওর পেটে এলো। আমার পৃথিবীটা হুট করে যেন স্বর্গ হয়ে গেলো।প্রতিদিন অফিস থেকে এসে ক্যালেন্ডারে দাগ কাটতাম।কবে পৃথিবীতে আসবে আমাদের ফুটবল টিমের প্রথম সদস্য।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকের এক সন্ধ্যায় আমি হাসপাতালের করিডোরে পায়চারী করছি।ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার সাহেব এলেন।সাদা রঙের তোয়ালে পেচানো ফুটফুটে এক পরীকে আমার কোলে তুলে দিলেন।ঐ মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত ছিল।
পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত।ঠিক পরের মুহূর্তে ডাক্তার জানালেন, আমার কোলে যে ফুটফুটে পরীটা কাঁদছে, তার মা আমাদের দুইজনকে এই পৃথিবীতে রেখে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।আমার স্পষ্ট মনে আছে, অদিতির লাশ কাধে নিয়ে আমি উন্মাদের মত হাসপাতালের এক করিডোর থেকে অন্য করিডোরে ঘুরেছি। আমি শুধু ১ মিনিট চেয়েছিলাম।১ মিনিটের জন্য হলেও অদিতি যেনো ঘুম থেকে জেগে উঠে।আমার জীবনে অনেক মিরাকল ঘটনা ঘটেছে, শুধু মিরাকল ভাবে অদিতিকে ঘুম ভেঙ্গে উঠানো হলো না।হাসপাতালের, কোন ডাক্তার পারেনি অদিতির ঘুম ভাঙ্গাতে।
জীবন থেমে থাকে না।আস্তে আস্তে সবকিছুই একদিন স্বাভাবিকের মত হয়ে গেলো।ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে আমি বেঁচে আছি।আমি খুব শক্ত একটা মানুষ।আমি কক্ষনো কাঁদি না,শুধু মাঝে মাঝে কাঁধের উপর আমার পরীর মত মেয়েটা যখন ঘুমিয়ে পড়ে,ঘুমের মাঝে ও যখন আধো আধো কন্ঠে 'মা মা' বলে ডাকে, তখন আমি নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি।
মাঝে মাঝে আমার কাঁধ দুটো ভীষণ ব্যথা করে।এক কাঁধে অদিতির লাশের ভার, অন্য কাঁধে ওর রেখে যাওয়া ছোট্ট সন্তানের 'মা কোথায়?' প্রশ্নের ভার।এত বেশি ভার আমি নিতে পারি না।আমার কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট হয়।

------------------------
ছোট গল্প: বুক_চাপা_কষ্ট
লেখনীতে: টুটুল
------------------------
এই রকম আরো নতুন নতুন গল্প পড়তে এই জয়েন হয়ে থাকেন।

Post a Comment

0 Comments