Header Ads Widget

Responsive Advertisement

রুমকী

 আমার স্বামী রফিক এমন একজন মানুষ, যার কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আমাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। আমাদের কোন সন্তান নাই। আমরা অনেক চিকিৎসা করিয়েছি বাচ্চা নেওয়ার জন্য, এমন কিছু ও না।

আমি কয়েক বার ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার আমাকে বলেছে আপনার কোন সমস্যা নাই। এই সব ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই একসাথে আসতে হয় ডাক্তারের কাছে। আপনার হাসবেন্ডকে নিয়ে আসবেন, ওনারও কিছু টেস্ট করাতে হবে। রফিককে এই কথা বলার পরে রফিক আজ যাবো, কাল যাবো করে শেষ পর্যন্ত একবার ডাক্তারের কাছে গেলো, এবং কিছু পরীক্ষা করালো। তখন ডাক্তার বলল রফিকের ও কোন সমস্যা নাই।
এর পর থেকে রফিককে মনে হলো আরো বেশি নিশ্চিন্ত। সে আনন্দিত মনে ঘুরতে লাগলো। আমাদের যে বাচ্চা হচ্ছে না, এ- নিয়ে ওর আর কোন মাথা ব্যাথা নাই। কিন্তু আমার অনেক মন খারাপ লাগে একটা বাচ্চা'র জন্য।আমি বাসায় একা থাকি। রফিক অফিসে গেলে আমার তেমন কিছু করার থাকে না। আর রফিক বাসায় থাকলেও, আমার কাছ থেকে বিশেষ কোন যত্ন, বা কোন চাওয়া-পাওয়া নাই ওর।


রফিক অফিস থেকে এসে আমার সাথে একটু চা খাবে। তারপর একটা মোটা বই নিয়ে বসে যাবে। ও কোন গল্পের বই পড়ে না। ওর আগ্রহ ইতিহাস নিয়ে। জীবন চলার জন্য টাকা প্রয়োজন তাই একটা চাকরি করে, আর সংসার চালানোর জন্য একটা বউ লাগে যে তার খেয়াল রাখবে। সেই ব্যবস্হা তার মা করে গেছে, আমাকে বউ করে এনে। তার পর শাশুড়ী মা না ফেরার দেশে চলে গেছে।
রফিকের কাছে কেউ যদি কোন ঐতিহাসিক ঘটনা জানতে চায়? তবে রফিক খুবই খুশি হয়,এবং সেই বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর, ঘন্টা, কথা বলতে তার খারাপ লাগে না। তবে অন্য কোন বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নাই। এমন কি আমাদের যে কোন সন্তান নাই আমার ধারণা রফিক এতে বরং খুশি। আমার এই ধারণার পেছনের কারন হলো- একদিন রফিক তার অফিসের কোন এক কলিগের বাচ্চা'র স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে কথা বলছিলো। তখন ও বলে,
- ভাগ্য ভালো আমাদের কোন বাচ্চা নাই। বাচ্চা স্কুলে ভর্তি করতে এত ঝামেলা যে, তা একজন মানুষকে সিক করে দিতে পারে।
আমি বললাম,
- কেন কি হয়েছে?
তখন ও যা বলল তা হলো,
- সুমন রফিকের অফিসের কলিগ আর তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির সময়কার গল্প।
আমি বললাম,
- সব বাবা-মা'ই তার বাচ্চাকে ভালো স্কুলে দিতে চায়। আর সেইজন্য কষ্ট করাকে কষ্ট মনে করে না। আনন্দ মনে করেই করে।
তখন হাদারাম টা আমাকে বলে,
- এটা কেমন কথা? কষ্টকে, কেন কষ্ট মনে হবে না? একজন বাবা ভোর রাত থেকে একটা স্কুলের ফর্ম তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ আবার ভোর রাত থেকে লাইন ধরে ফর্ম জমা দিবে।এটা তো ভয়াবহ অবস্থা। আর তুমি বলছো এটা কষ্ট না?
আমার আর ভালো লাগছিল না ওর সাথে তর্ক করতে।
আমি শুধু বললাম,
- তুমি এটা বুঝবে না। একজন বাবা-ই শুধু এই বুঝতে পারে, এই কষ্টের মাঝে যে কি আনন্দ আছে।
আমি ঠিক করলাম এই গাছ মার্কা মানুষ' টার সাথে আমাকে থাকতে হলে, আমাকে আমার নিজের ভালো লাগা গুলোর মূল্য আমাকে'ই দিতে হবে, এবং সেই ভালো থাকার চেষ্টা আমাকেই করতে হবে। এখন থেকে আমার সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিবো।
আমি আমার এক বান্ধবীকে বললাম,
- আমি একটা বাচ্চা দত্তক নেবো।
আমাদের ঐ বান্ধবী হলো সব কাজের কাজী। আর কোন কাজের দায়িত্ব পেলে, আর কথা নাই সেটা নিয়ে মেতে থাকে। ও আমার কথা শুনে প্রথমেই বলল।
- তুই সত্যি বাচ্চা দত্তক নিবি?
আমি বললাম
- হু,
তখন ও বলল,
-কোনটা নিবি বল? আমার বড় টাকে না ছোট টাকে?
-আমি বললাম ফাজলামো করিস না আমি সিরিয়াস।
তখন লোপা বলল,
- রফিক ভাই কি বলে? তোদের বিয়ে হয়েছে মাত্র পাঁচ বছর। এখনও অনেক সময় আছে বাচ্চা নেওয়ার।বাচ্চা'র জন্য এত পাগল হয়েছিস কেন?ডাক্তার দেখা চেষ্টা কর, নাকি ডাক্তার তোদের কারো সমস্যার কথা বলেছে?
এক সাথে এত গুলো কথা বলে লোপা থামে।
তখন আমি বললাম,
- শোন লোপা, আমি এমন একজন মানুষের সাথে বাস করি, যে এই জীবনে আমাদের বাচ্চা না হলেও, বাচ্চা নেওয়া নিয়ে কিছু বলবে না।এবং সে বাচ্চা না থাকাটা কে সুবিধা বলে মনে করে।আর এই কারনেই আমি একটা বাচ্চা দত্তক নেবো।
আমি ওকে সেই সাথে এটাও বললাম,
- রফিকের কোন মতামত লাগবে না। আমি একটা বাচ্চা চাই,এটা আমার একার সিদ্ধান্ত। আর রফিক আমার কোন কাজে বাধা দেয় না।
লোপাকে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার কথা বলার সাত মাস পরে, ও একটা মেয়ে বাচ্চা'র খবর নিয়ে আসে।আমি লোপাকে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাটা নিয়ে আসি। আমি যে দিন প্রথম আমার কন্যাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি সেদিন রাতে রফিক শুধু আমাকে বলেছিলো,
- একটা বাচ্চা শুধু আনলেই হয় না সেই বাচ্চা'র সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে হয়।
আমি তখন অবাক হই ওর কথায়। আমি বলি,
-এই শিশুটি আমার মেয়ে, আর আমার মেয়ের দায়িত্ব আমি আমার জীবন দিয়ে পালন করবো।
রফিক হেসে বলে,
- জীবন দিয়ে দিও না, তখন বাচ্চা' টা আবার এতিম হবে। তার চাইতে সুস্থ থেকে ওর দায়িত্ব পালন করো।
আমার মেয়ের নাম আমি রেখেছি রুমকী। আর ভালো নাম রুবাইয়া ইসলাম। কারন রফিকের নাম রফিকুল ইসলাম। নামের বিষয় রফিক জানেও না।
শুরু হলো আমার নতুন জীবন। আমি মেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত। রফিকের সাথে আমার এখন কথা হয় শুধু মেয়ে নিয়ে। আমি মেয়ের জন্য যা লাগে বলি, রফিক তা এনে দেয়। আমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি,আমি এখন আর রফিকের জন্য বিশেষ কিছু রান্না করি না। রফিকের সাথে ভালো করে কথাও বলি না। এখন আমার জীবন শুধু মাত্র আমার কন্যাময়,আমার মেয়ের বাহিরে আমার জীবন বলে আর কিছু নাই। আমার ভেতরে এখনই একটা ভয় ঢুকে গিয়েছে। আমার সারাক্ষণ শুধু মনে হয়, লোকজন এক সময় আমার মেয়েকে বলে দিবে আমি ওর আসল মা না।আমি রুমকীকে দত্তক এনেছি।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আচ্ছা আমরা যদি রুমকীকে নিয়ে অন্য কোন দেশে গিয়ে থাকি, তা হলে তো আর কেউ জানবে না যে রুমকী আমার নিজের পেটের সন্তান না। ওকে পালক এনেছি।
আমার সব চাইতে বেশি ভয় রফিককে নিয়ে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, ও রুমকীকে নিয়ে কি ভাবে। তবে ইদানীং খেয়াল করছি, আমি যখন ঘরে থাকি না ও রুমকীকে নিয়ে একটু-আকটু আদর করে। আমাকে দেখলে লজ্জা পায় সরে যায়।
রুমকী একটু-একটু করে বড় হচ্ছে, আর কেমন যেন রফিকের ভক্ত হয়ে যাচ্ছে। রফিক অফিস থেকে আসলেই রফিকের কোলে যাওয়ার জন্য অস্হির হয়ে যায়।রুমকী এখন একটু-একটু হাটতে পারে।
আজ ঘটেছে এমন একটা ঘটনা যা না ঘটলে আমি রফিককে সত্যিকার অর্থে চিনতে পারতাম না।
রফিক অফিস থেকে আসার পর আমি চা বানাতে গিয়েছি। রুমকী ঘুমাচ্ছিল বিছানায়। এর মধ্যে রুমকীর ঘুম ভেঙে যায়। আর মেয়ে একা-একা খাট থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। রুমকীর কান্না শুনে আমি দৌড়ে এসে দেখি রফিক আমার আগেই রুমকীকে কোলে তুলে নিয়েছে। আর আমাকে বলছে রাফিয়া জামালকে গাড়ি বের করতে বলো।
আমরা দু'জন পাশাপাশি বসে আছি রুমকী রফিকের কোলে রফিক রুমকী'র কান্না থামাবার চেষ্টা করছে।
আমরা যখন ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম তখনও রুমকী রফিকের কোলে।
ডাক্তার যখন বলল রুমকীর ঠোঁটে একটা সেলাই লাগবে। তখন রফিক বলল,
- আমার মেয়েটা এমনিতেই অনেক ব্যাথা পেয়েছে। আবার সেলাই করলে আরো ব্যাথা পাবে। অন্য কোন উপায় নাই ডাক্তার সাহেব?
তখন ডাক্তার বলল,
-সেলাই না করলেও সমস্যা নাই, ছোট বাচ্চা তো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে একটু ফুলে থাকতে পারে।
রফিক তার পরেও মেয়ের ঠোঁটের নিচে সেলাই করতে দিলো না। যখন বাসায় আসলাম রখন রফিকের আরেক রুপ দেখলাম। রফিক তো তার মেয়েকে ছাড়া এক মিনিট ও থাকে না।এ যেন অন্য রফিক! সারাদিন মেয়েকে নিয়ে কথা। আর সারাক্ষণ মেয়েকে কথা শেখাচ্ছে বাবা-বাবা।
এখন আর আমার কোন চিন্তা নাই রুমকীকে নিয়ে। রুমকী আমি না থাকলেও তার বাবার কাছে ভালো থাকবে।

গল্প: রুমকী
লেখনীতে: সুরাইয়া শারমিন
এই রকম আরো নতুন নতুন গল্প পড়তে জয়েন হয়ে থাকেন পাবেন।

Post a Comment

0 Comments