Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বোবা

 কাঁথা মুড়ি দিয়ে দারুন একটা কমিক্স পড়ছিলাম।আমার পড়ায় ছেদ ঘটায় আমার আপু অবনী। রাগে গজ গজ করতে করতে এসে ধপ করে বসে পড়ে বিছানার উপর।আমি আপুর দিকে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাই।আপু আমার চোখের ভাষা বুঝে আমাকে বলে, “আনিস মামা এসেছে।”


এই লোকটাকে আমার একদম পছন্দ না।আমার আপুর দিকে কেমন করে জানি তাকায়। আমি আপুর বড় ভাই হলে তাকে আর এ বাড়িতে আসতে দিতাম না।আমার আপুর কাছে আসতে দিতাম না। কিন্তু আমি তা পারি না। কারণ আমি তো ছোটবোন। তাও এমন এক ছোট বোন যে কিনা কথা বলতে পারেনা। হ্যাঁ, আমি বোবা।
আমার বাবা একজন সাধারণ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী। আবার উনি একজন কেমিস্টও বটে। আমাদের বাসায় বাবার ছোটখাটো একটা ল্যাব আছে। এই ল্যাবে অনেক পদের কেমিক্যাল আছে।বাবার ল্যাবে এ বাড়ির আমি বাদে কেউ যায় না। আগে আম্মু বেঁচে থাকতে আম্মু যেত। আম্মু মারা যাবার পর আর কেউ যায় না।
বাবা আমাকে হরেক রকম কেমিক্যালের সাথে পরিচয় করায়।
– "দেখ নবনী, এটা হলো এসিড, এটা লাগলে পুড়ে যাবে, ঝলসে যাবে, এটা লবণ তবে খাওয়া যাবে না, এটা হলো বিষ, ইমিডিয়েট কিলার, হার্ট ফেইল করিয়ে মেরে ফেলবে৷ তুই কিন্তু এগুলো ভুলেও মুখে দিবি না!"
বাবার সতর্কবার্তায় আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।
আমাদের যৌথ পরিবার। সবাই আমরা একসাথে থাকি। আনিস মামা হলো মেজচাচীর ভাই। উনাকে বাড়ির সবাই পছন্দ করে।আমরা তিনজন বাদে। আমি, আপু আর আমার দিদা।
মা মারা যাবার পর দিদা আমাদের দুইবোনকে আগলে রেখেছে।
সেবার কোরবানির মাসখানেক আগে বাবা ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যায়। এসুযোগে আমাদের বাড়িতে আনিস মামার আগমন খুব বেড়ে যায়। আমার দিদা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে আপুকে উনার সামনে বেশি একটা যেতে দেয় না। কিন্তু আমি তখন আনিস মামার চরিত্রের ব্যাপারে সবটাই জানতাম।আমি আনিস মামাকে তার বন্ধুর সাথে ফোনে আমার আপুর ব্যাপারে নোংরা কথা বলতে শুনেছি।
কি অবাক হচ্ছেন? আমি বোবা হলেও সব শুনতে পাই।কারণ আমি জন্মগত বোবা ছিলাম না। কিভাবে বোবা হলাম সেটা পরে না হয় বলবো। কিন্তু আমি যে সব শুনতে পাই সেটা বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না।
বাবা দেশের বাইরে।এমন সময় রত্না বুবুর আকদের তারিখ পড়ে। সবাই খুব খুশি।পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা।আমাদের মা নেই।তাই আমাদের চাচিরা আমাদের মা সাজতে গিয়ে আমাদের দিয়ে সংসারের অনেক কাজ করিয়ে নেয়।পার্থক্য শুধু বাবা থাকলে কাজ কম করায় আর না থাকলে একটু বসার সুযোগও দেয় না।
রত্না বুবুর গায়ে হলুদের দিন বাড়ির সব বৌ-ঝিয়েরা হলুদ শাড়ি পড়েছে।বুবু আমাকে মায়ের একটা লাল শাড়ি পড়িয়ে দেয়। কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু এঁকে দেয়।
আমার বুবুও আলমারী থেকে মায়ের একটা হলুদ শাড়ি পড়েছে। চোখে গাঢ় কাজল আর লাল লিপ্সটিকে বুবুকে একদম স্বর্গের অপ্সরা লাগছে। মায়ের চেহারা আমার মনে নেই।কিন্তু আজকে বুবুকে দেখে মনে হচ্ছে মা বুঝি দেখতে এরকমই ছিলো!বুবুকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ নির্ভীক হয়ে যায় ঠিক তার চেয়েও বেশি।আমার মনে হয় এই মানুষটার জন্য আমি এভারেস্টও জয় করে ফেলতে পারবো।
সবাই সেজেগুজে ঘুরছে, মজা করছে, কণের সাথে বসে ছবি তুলছে। অথচ আমাদের দুইবোনের খোঁজ কেউ নিচ্ছে না। কথায় বলে না যার মা নেই তার কেউ নেই। বুবু কোনমতে শাড়িটা পড়েই রান্নাঘরে ঢুকেছে। বড় চাচী আর বড় ফুফুর সাথে মিলে আজকের খাবারটা বুবু রান্না করেছে।
তারা রান্নার পর চলে গেলেও আপু যেতে পারেনি।তাকে সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে হচ্ছে।আপু একটু সুযোগ পেয়ে আমাকে প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসতে বলে।আমি খাবারটা নিয়ে ঘরে চলে যাই।এখানে সবার সাথে বসলে আমার ভালো লাগবে না।আমি কানে শুনিনা ভেবে তারা আমার দিদার নামে অনেক পঁচা কথা বলবে যা আমার মোটেও ভালো লাগবে না।
এমনিতেও এবাড়ির কেউ আমাকে তেমন একটা আদর করে না। আমি বুবুর মত অত কাজ করতে পারি না তাই কেউ খুব একটা পাত্তাও দেয় না।
আমি আমার পড়ার টেবিলে বসে আবারও কমিক্সের বই খুলে পড়ছি আর খাচ্ছি। খাওয়া শেষে আমি প্লেটটা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যাই। বাড়িতে আমি আর বুবু ছাড়া কেউ নেই। সবাই ছাদে।
ঠিক তখনই দেখি আনিস মামা রান্না ঘরে ঢুকছে।আমিও দ্রুত তার পিছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি যে আপুর হাত পিছনে এনে শক্ত করে ধরে আছে৷ আপু তার হাত ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে কিন্ত পারছে না।চারদিকে গানের শব্দে কেউ আপুর চিৎকারও শুনতে পাচ্ছে না। আমি প্লেট রেখে দৌঁড়ে গিয়ে তার হাতে কামড় বসিয়ে দেই। অসভ্যটা আমাকে খুব জোড়ে একটা ধাক্কা দেয়। আমি গিয়ে পড়ি মিটসেল্ফের উপর। মিটসেল্ফ থেকে মরিচের কৌটাটা নিয়ে তার চোখের উপর ছুড়ে মারি। মুহুর্তের মধ্যেই জানোয়ারের মত সেও চিৎকার করতে থাকে। বিয়ে বাড়িতে গানের শব্দে তার আওয়াজও কেউ শুনতে পায় না।
আমরা দুইবোন দৌড়ে ছাঁদে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর সেই নরপশুটাও এসে হাজির হয়। তার চোখমুখ আগুনের মত লাল হয়ে আছে। সে ভালোমত তাকাতে পারছে না। মেজচাচীকে জানায় সে আর থাকবে না। তার খারাপ লাগছে। মেজচাচী তখন আপুকে তার জন্য টিফিনবাটিতে করে খাবার বেড়ে দিতে বলে।
দিদা এবার চাচিকে জোরে ধমক দেয়,
– " তোমার ভাইরে তুমি খাবার দাও।আমার নাতিনে সেই সকাল থেইকা ন কাজ করতাছে।অয় এখন আর যাইবো না।অবনী তুই যা রত্নার লগে গিয়া বস।একেবারে হলুদ শেষ হইলে তারপর নিচে যায়া ঘুম দিবি।এর আগেনা।"
দিদার এমন কঠোর প্রতিবাদে মেজচাচী রাগে কটমট করতে করতে নিচে গিয়ে খাবার বাড়তে থাকে।আমিও তার পিছপিছু যাই।তবে আমি যাই বাবার ল্যাবে।শাড়ির আঁচলের নিচে ছোট একটা শিশিতে করে কিছুটা হাইড্রোজেন সায়ানাইড নিয়ে আসি।বিয়ে বাড়িতে কেউ কারোও দিকে খেয়াল করে না।তাই আমি এই সুযোগ টা কাজে লাগাই।
এবার আমি চাচীর কাছে গিয়ে দাঁড়াই।চাচী তখনও দিদাকে বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছিলো। আমাকে দেখে আমাকেও দুটো কটু কথা শুনিয়ে বলে আমি যেন এটা গিয়ে মেজচাচাকে দিয়ে আসি। কারন মেজচাচা আনিস মামাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে আসবে।আমি টিফিন বাটিটা নিয়ে কৌশলে ঢাকনা খুলে পুরো বোতলের সবটা সায়ানাইড ঢেলে মিশিয়ে দেই।তারপর নাচতে নাচতে চাচাকে দিয়ে আসি।
আপু আমার চোখের ভাষা বুঝে।কিন্তু আনিস মামার ঘটনার পর আপু খুব মনমরা হয়ে আছে। তবে আমি খুব খুশি যেন আমি সত্যি সত্যি এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি।
আমি সেদিনকারমত প্রথমবার মাকে স্বপ্নে দেখি।মা আমাকে বলছে, – " সাব্বাশ নবনী, সাব্বাশ"
এত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে গরম একটা খবর পাই।সেটা হলো আনিস মামা আর নেই।গতকাল রাতে খাবার খাওয়ার পরপরই তিনি হার্ট এট্যাক করে মারা যান।এদিকে রত্না বুবুর বিয়ে ওদিকে আনিস মামার মৃত্যু।দিনের বেলা সবাই জানাজা পড়ে রাতের বেলা রত্না বুবুর বিয়েতে সবাই আসে।শুধুমাত্র মেজচাচার পরিবার বাদে।
আজকেও আমার আপু সকাল থেকে রান্না ঘরে।কিন্তু আজকে আর তার মুখে কোন ভয় নেই।একটা চাপা শান্তির ভাব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়।ঠিক যেমনটা দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দী পাখি মুক্তি পেলে হয়।
আমিও খুব খুশি।কারণ আপুর জন্য এভারেস্ট আমি ঠিকই জয় করে ফেলেছি।
বাবা ফিরে এসেছেন।আমি আর বাবা অনেকদিন পর ল্যাবে।
– "কিরে সায়ানাইড কমলো কিভাবে? "
আমি মাথা নিচু করে বাবার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলাম। বাবা কাগজটা হাতে নিয়ে তাতে হালকা তাপ দিতেই অনেকগুলো লেখা ভেসে উঠলো।বাবা লেখা গুলো পড়ে চোখ মুছে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ❝ তুই পুরোটা সায়ানাইড ঢেলে দিলেও কিছু বলতাম না তোকে। ❞
কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরি অনেকদিন পর।অনেকদিন পর আবার ভরসার স্থল পাই।
.

(সমাপ্ত)
-------------------
#ছোটগল্প
গল্প: বোবা
লেখনীতে: সুমাইয়া
-------------------
(গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না এবং নিয়মিত গল্প পেতে ফলো করে সাথে থাকার অনুরোধ রইলো)

Post a Comment

0 Comments