Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বেলা বয়ে যায়

 অবশেষে ফাহাদের সাথে আমার ডিভোর্স টা হয়েই গেলো।সে খুব তাড়া দিচ্ছিলো ডিভোর্সের জন্য শুধু তাই নয় ভয়াল মানুষিক যন্ত্রনায় আমার দিন গুলো কাটছিলো এই সেপারেশন সময়টা।আচ্ছা ডিভোর্সের আগে স্বামী স্ত্রীর আলাদা থাকা সম্পর্ক কে তো সেপারেশন’ই বলা হয় তাইনা?

ফাহাদের সাথে আমার ছোট বেলা থেকেই পরিচয়।একই স্কুলে একই ক্লাসের ছিলাম আমরা।ছোট্ট বেলার বন্ধু ছিলাম।আমাদের পারিবারিক বাসস্থান দূরত্ব ছিলো এপাড়া ও পাড়া।গ্রামেই মানুষ আমরা।
যেদিন মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন ছিলো ফাহাদ আমাকে একটি চিঠি দেয়।বাসায় এসে খুলে দেখি এ একটি ভালোবাসাময় প্রেমপত্র।চিঠিটা মায়ের হাতে কিভাবে জেনো চলে গেলো।বাবা মা আমাকে আর ভরসা করতে পারলেন না।অনেক মেধাবী ছাত্রী হয়েও মাধ্যমিক রেজাল্টের আগেই আমাকে আমার থেকে সতের বছর বড় বয়সী মুহিবের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেন।


বিয়ে স্বামীর সুখ বুঝে ওঠবার আগেই বিয়ের এক বছরের মাথায় আমি মা হয়ে গেলাম।মীর আমার একমাত্র ছেলের জন্ম হলো।মুহিবের সাথে আমার দাম্পত্য সম্পর্ক টা কখনোই ভালো ছিলোনা।বয়সে ছোট হওয়ায় তার কাছে আমি ছিলাম বোধ বুদ্ধিহীন একজন নারী।সব সময় অশিক্ষিত আমি এই খোটা দিয়ে যেতো।বিয়ের পড়ে পড়াশোনা কিন্তু সেই বন্ধ করে দিয়েছিলো।
একটু ভালো করে কথা কবেই বা বলেছে আমার মনে পড়েনা।সবকিছুতে দোষ খুঁজে পেতো আমার।শাশুড়ী ছিলো না আমার শশুর বাবা আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন, বাসায় শিক্ষক রাখলেন।কলেজে যেতে পাড়তাম না শিক্ষক পড়াতেন তিনিই বাসায় এসে পরীক্ষা নিতেন।উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় মুহিব কি ব্যবসার কাজে ইন্ডিয়া গিয়ে আটকে গেছিলো একমাস।সেই সময় তে পরীক্ষা গুলো নির্ভয়ে দিতে পেরেছিলাম।
প্রচন্ড নারী লোভী ছিলো মুহিব।আমি নাকি ব্যার্থ তার চাহিদা পূরণ করতে।অথচ তাকে বুঝতে পাড়ার মতো সময় আমাকে কখনোই দেয়নি মুহিব।আমাদের দাম্পত্য জীবন ছিলো সেই রাতের বেলা বিছানাতেই।এতে আমার সম্মতি থাকুক বা না থাকুক।
ছেলের প্রতি মুহিব ছিলো একজন আদর্শ বাবা।ছেলে একটু ব্যাথা পেলেই আমার উপর চলতো নির্যাতন আমি নাকি খেয়াল রাখতে পারিনা।
বাবা মা কে কিছু বলতে গেলেই মানিয়ে নাও ঐ সেই একই ধাঁচের কথা।মানিয়ে চলতে চলতে বিবাহিত জীবনের নয় বছর পাড় করে দিলাম।এর মাঝেই পড়াশোনা টা ঐ চুরিবিদ্যার মতো পাড় করলাম।আমার বাবা (শশুর) একজন ভালো মানুষ পাশে ছিলো বলেই সম্ভব হয়ছে।চুপে চুপে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরীক্ষা দিলাম।আলহামদুলিল্লাহ চাকরী টা হয়ে গেলো।এই কথা আর গোপন থাকলো না।
মুহিব আমাকে দরজা বন্ধ করে বেদম মার মারলো।হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো।আমার বাবা মা কে আমার শশুর অনেক বুঝালেন যে মেয়ে কে নিয়ে যেতে।এটা উপলব্ধি করালেন তিনি শশুর হয়ে আমার পাশে এরকারনেই ছিলেন কেনো না তারা মা বাবা হয়ে আমার পাশে ছিলেন না।বাবা আমাকে নিয়ে এলেন।মীর কে মুহিব আটকে দিলো।দেখা পর্যন্ত করতে দেয়না।আমার আর মুহিবের ডিভোর্স হয়ে গেলো।আমি আমার মন দিয়ে চাকুরী টা করতে লাগলাম।
অনেকদিন পর স্কুল থেকে ফিরতে একই অটোরিক্সায় আমি আর ফাহাদ।কতো বছর পর দেখা পাশাপাশি এলাকা হওয়া সত্বেও বিয়ের পর ফাহাদের সাথে আমার দেখা হয়নি।
অল্প সময় টুকু তে অনেক কথাই হলো।তখনো তেমন কিছুই করছিলো না ফাহাদ।পড়াশোনা শেষ ভালো কোনো চাকুরী তে থিতু হতে পারেনি।বিয়ে ও করেনি।দুলাভাইয়ের রড সিমেন্টের ব্যবসায় সময় দেয় এইভাবেই কাটছে।ফোন নাম্বার টা সেদিন আদান প্রদান করা হয়।
বাসায় ফিরে সেদিন সারারাত কথা হয়।আমার জীবনের এই ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে।সে যদি ঐ প্রেমপত্র না দিতো আমার সাথে এতোসব হতো না।বারবার ক্ষমা চেয়েছে।আমি বুঝিয়েছি এটা আমার সাথে হবারই ছিলো।ঐ যে ভাগ্যের লিখন।
প্রতিনিয়ত আমাদের কথা হতে লাগলো।সারাক্ষণ আমার খোঁজ খবর নিতে লাগলো।একটু অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করতো তার প্রতি।ফাহাদের ফোন কল টেক্সটের অপেক্ষা করতে ভালো লাগতো।কিছুই বুঝতে দিতাম না ভয় পেতাম আমি, বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা নষ্ট হবার।
একদিন রাতে কথা বলার সময় দুম করে ফাহাদ আমাকে বিয়ে প্রস্তাব দিয়ে বসে।আমি পুরোটাই ঘোরের মধ্যে জেনো পড়ে গেলাম এই প্রস্তাব পেয়ে।সে চায় তার সেই এক প্রেমপত্রের জন্য আমার জীবন টা এলোমেলো হয়ে গেছে এজন্য সেই চায় আমার জীবন টা কে গুছিয়ে দিতে।আশ্বাস দেয় অভয় দেয় সে আমাকে ভালো রাখবে।
আমি সম্মতি দিতে পারছিলাম না সামাজিক অবস্থার কারণে।এই সমাজে একজন বাচ্চা সহ ডিভোর্স নারী কে একজন অবিবাহিত পুরুষ বিয়ে করবে অনেক রকমই কথা শুনতে হবে এই ভয়ে।মন পুরোপুরি সায় দিচ্ছিলো না।আমি সামাজিক অবস্থার কথা তাকে বলি।সে এসব শুনতে চায়না সে শুধুই আমাকে নিয়ে ভালো থাকতে চায়।আমার ও লোভ হচ্ছিলো একটু ভালোবাসা পাওয়ার একটা সুন্দর সংসার করার।অত:পর তার কথায় সায় দিয়ে বললাম বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে।
ফাহাদ তার চাচা কে দিয়ে আমার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।বাবা রাজী হচ্ছিলেন না। কেনোনা ফাহাদের আর্থিক অবস্থা অতোটা শক্ত না।অন্যের ব্যবসা দেখাশোনা তো আর নিজের কোনো পরিচয় বা অবস্থান না।এছাড়া বাড়ি ঘরের অবস্থা ভালো না।মা একটু নরম হয়ে বাবাকে বুঝালেন ছেলে এখন কিছু করছে না তার মানে এই না যে কিছু করবে না।এছাড়া আমাদের মেয়ে তো চাকুরী করে।একবার তার জীবন টা নষ্ট করেছি বাসার কাছেই থাকবে বিয়ে টা হলে।যে ছেলে এতো বছর এতো কিছু হবার পরেও আমাদের মেয়ে কে চায়।নিশ্চয়ই ভালো রাখবে।
অত:পর খুবই সল্প পরিসরে আমার আর ফাহাদের বিয়ে টা হয়ে গেলো।সুন্দর দাম্পত্য জীবন যাচ্ছিলো আমাদের।বিয়ের পরেই আমি নিজ উদ্যোগে ফাহাদদের বাড়ির কাজ করাতে শুরু করলাম অনেককিছু মেরামতের দরকার ছিলো।নতুন ঘরের প্রয়োজন ছিলো।দুইটা নতুন ঘর বানালাম।কেনোনা এটা তো আমারই সংসার একটু সুন্দর করে গুছিয়ে নেবার দায়িত্ব তো আমারই।কয়েকমাস পরেই ফাহাদ দুলাভাইয়ের দোকানে আর যায়না।ঝামেলা হয়েছে কি সব।বাসাতেই থাকে কোনো কর্মসংস্থানের চেষ্টা নেই।আর্থিক ভাবে পুরোপুরি আমার উপর নির্ভর।ব্যবসা করতে চায় টাকা নেই।অত:পর টাকা দিলাম ব্যবসার জন্য।ব্যবসা শুরু করলে ও ব্যবসায় মনোযোগ নেই।ব্যাবসায় লস করে আবার ঘরে বসা।এ নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলেই আমাকে যা না তা কথা শোনাতে লাগলো।আমি টাকা দেওয়া টা প্রায়ই বন্ধ করে দিলাম।ফাহাদের মা মানে আমার শাশুড়ী তিনি কথায় কথায় আমাকে আমার প্রথম বিয়ে সংসার নিয়ে খোটা দেয়।আমি অবাক হয়ে যাই এই মহিলা কয়েকদিন আগে আমাকে মাথায় করে রাখতো।টাকা না দিলে ফাহাদের ব্যবহার আরো খারাপ হতে লাগলো।না কোনো প্রকার নেশা সে করে না।বন্ধুদের আড্ডায় প্রথম সারিতে থাকতে চাইতো।অন্যের কাছে শোঅফ করে বেড়াতো ডিভোর্স এক বাচ্চার মা কে বিয়ে করেছে।সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগল ছবি,রোমান্টিক ক্যাপশন দিতো।সমাজে নিজের ভালো মানুষী খেতাব আর সুনাম কুরাতে লাগলো।ফাহাদ কে আমার বাবা একটা বাইক কিনে দিয়েছিলো।অনেকদিন হলো এখন সেটা ভালো লাগেনা নতুন আপডেট ভার্সন তার চাই।
আমি অপারগতা জানালে সেই ফাহাদ ও আমাকে এবার গায়ে হাত তোলে।সে আমাকে বিয়ে করে নাকি উদ্ধার করেছে নইলে আমার মতো বাচ্চাওয়ালা ডিভোর্স মেয়ে বাপের বাড়িতে পঁচে মরতাম।বাবা মা কে কিছুই বলতে পারিনা।নামাজে বসে কান্না করতাম।
ফাহাদের মা প্রায়ই একই আলাপ জপতেন তার ফুলপাত্র ছেলের জন্য কতো ভালো ভালো বিয়ের ঘর আসতো।উনার ভাই নাকি তার মেয়ের জন্য ফাহাদের নতুন করে প্রস্তাব দিয়েছেন আমাকে ছেড়ে দিয়ে মামাতো বোন কে বিয়ে করলে ফাহাদ কে ইতালি পাঠাবেন।
ফাহাদ জেনো আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেলো এমন অবস্থা। অশান্তির শেষ নেই।ফাহাদ একদিন বলেই দিলো তার সাথে সংসার করতে চাইলে,বাবার বাড়ির মার্কেট থেকে যে চার টা দোকান আমি পেয়েছি সেগুলো বিক্রি করে টাকা তাকে দিতে সে ইতালি যাবে।আমি না করে দেই।নিত্য নতুন অত্যাচার শুরু হলো।অফিসের আমাদের শিক্ষকদের একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ আছে সেখানে ক্লাস আপডেট, প্রক্সি দেওয়া,খাতা দেখা এসব নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়।একটু ফোন হাতে দেখলেই সন্দেহ কোন পুরুষের সাথে আমি চ্যাটিং করছি।ফোনে কথা বলতে দেখলেই নোংরা কথা।একদিন আমার সন্তান মীর কে নিয়ে নোংরা কথা শুনিয়ে দেয়।সেদিন আর থাকতে পারিনি।চলে আসি ফাহাদের বাসা ছেড়ে।বাবার পরিবারে একমাত্র মেয়ে হওয়া স্বত্বেও পারিবারিক সম্মান ক্ষুন্ন হবে ভেবে স্কুলের আশেপাশে বাসা নিলাম।সবাই জানলো আমার যাতায়াতের সুবিধার জন্য আমি বাসা নিয়েছি।প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ডিভোর্সের জন্য ফাহাদ চাপ দিতে লাগলো।সে ডিভোর্স দিবেনা কেনোনা কাবিনের টাকা দিতে হবে তাই।যদিও অল্প টাকা কাবিন ছিলো বিয়েতে সেটা দেওয়ার ক্ষমতা ও ফাহাদের নেই।ফাহাদ আমাকে বিয়েটা করেছিলো আমার চাকরি আর বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পদ দেখে।বিয়ের পর ফাহাদের বাড়িতে প্রায়ই আমার মা বাজার পাঠাতেন।এমন কি চাল পর্যন্ত কিনে খেতে হয়নি দুই বছর বিবাহিত জীবনে।
এই অতিষ্ট বর্বর জীবন আর ভালো লাগছিলো না।মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছি।সমাজ একটা মেয়ের দুইবার ডিভোর্স নিয়ে অনেক কথা বলে বেড়াবে কিন্তু জানতে চাইবে না কি হয়েছিলো সংসারে।দুইবার ডিভোর্স মানেই মেয়ের সকল দোষ,মেয়ে টাই খারাপ।একটা অসুস্থ সম্পর্ক নিয়ে মৃত প্রায় হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্পর্ক টা শেষ করে দেওয়াই শ্রেয়।ফাহাদ আশেপাশে সবাই কে বলে বেড়িয়েছে আমার চরিত্র খারাপ,কিন্তু বিয়ে না হয়ে প্রেমিক দ্বারা গর্ভধারণ করে বাচ্চা এবরশন করানো মামাতো বোন ফুলের মতো পবিত্র।আমি তো আগেই ভালো ছিলাম মুহিবের সাথে ডিভোর্সের পর সেই একাকিত্ব জীবনে।আমার কি আসলেই ভুল ছিলো একটু ভালো থাকতে চাওয়া?একটা গুছিয়ে সংসার করার বাসনা করার?অতি ঘরণী না পায় ঘর,অতি সুন্দরী রমনী না পায় বর তাই হলো আমার জীবনে।
এখন আছি ফাহাদের বাড়ির সামনে।ফাহাদ তার সেই মামাতো বোন কে বিয়ে করেছে আজকে।আমার খালাতো ভাই একজন ওসি।না না কোনো আইনি ঝামেলা করতে আসিনি।বুলডোজার ভাড়া করে এনেছি।ফাহাদের বাড়ি যেভাবে আমি মেরামত করিয়েছিলাম,নতুন ঘর,বাথরুম, বাড়ির প্রধান গেট যেগুলো আমার টাকা দিয়ে বানানো হয়েছিলো সেগুলো গুড়িয়ে দিয়েছি।ফাহাদ ভাবতেই পাড়েনি আমি এতো বড় ধাক্কা দিবো।ফাহাদের মা ভাঙ্গা ঘর বাড়ি দেখে বিলাপ বকছে।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রস্থান করলাম গুড়িয়ে যাওয়া বাড়ি টা দেখে এখন শান্তি লাগছে।আর হেরে যাওয়া নয়।বেলাশেষে নিজেকে নিজের ঢাল হয়ে থাকতে হবে।নতুন সকাল হবে, বেলা বয়ে যাবে।নিজেকে নিজের জন্য বাঁচতে হবে।

গল্প: বেলা বয়ে যায়
লেখনীতে : ঊম্মে লিজা
এই রকম আরো নতুন নতুন গল্প পড়তে জয়েন হয়ে থাকেন।

Post a Comment

0 Comments