ফোনের শব্দে ঘোর কা'টে আদিয়ার। বিরক্ত হয়েই রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে আকাশ ফোন করেছে।
- কি হয়েছে সমস্যা কী? ডিস্টার্ব করলি কেন?
- কেন আদু ভাই কি এমন জরুরি কাজে ব্যাস্ত ছিলি যে আমি ডিস্টার্ব করে ফেললাম।
- আমি তো গিটার...... না কিছুনা তুই কি বলবি বল।
- তোর জবের জন্য কালকেই সিভি জমা দিতে হবে।
- ওকে।
- কিসের ওকে সিভি তৈরি কর। কাগজ পত্র গোছা সব।
- যাহা বলিলেন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিব।আর কোন আদেশ আছে কি যাহাপনা।
- হা আছে।
- কি?
- আদেশ না একটা কথা বলার ছিল।
- মাহি তোকে দেখা করতে বলেছে। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।
- কিসের?
- আমি কি জানি। তুই গিয়ে দেখিস।
- হুম। আচ্ছা গুড নাইট।
- এই কাল কিন্তু ঠিক নয়টায় থাকতে হবে ওখানে।
- ওকে ওকে।
- কাল আবার ঘুমিয়ে থাকিস না তাহলে চাকরি এটাও কিন্তু কপালে জুটবে না।
- মনে থাকবে।
।
।
।
।
।
।
রাতে একটু লেট করে ঘুমানোর ফলে যা হবার তাই হলো। বেলা আটটা বেজে গেছে তাও মহারানীর ঘুম থেকে ওঠার কোনো নামই নেই। এলার্ম বেজে চলেছে আর সে কানে আঙুল গুজে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতেছে। আদিয়ার রুম থেকে এতবার এলার্ম বাজার শব্দে জায়েদা বেগম বিরক্ত হয়ে ওর রুমে আসেন। তারপর টেনে তুলেন বিছানা থেকে।
- উফফ আম্মু কি হয়েছে। আরেকটু ঘুমাই না প্লিজ।
- ঘুমাবি যখন তাহলে এতবার এলার্ম দিয়ে রেখেছিস কেন। কোনো কাজ ছিল কি।
মায়ের কথায় ফট করে চোখ খোলে আদিয়া। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমাই আবার ঘুমাই করছিল। এখন মনে পড়ে যে নয়টায় তো সেখানে থাকার কথা ছিল। ফোনটা তুলে সময় দেখে নেয়। আটটা চার বাজে। দৌড়ে ওয়াশরুমে যায়। দুই মিনিটে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। আলমারিটা খুলে সামনে যে জামাটা পায় ওটাই পড়ে নেয়। চুল আচড়ানোর এত সময় নেই তাই একটা হিজাব নিয়ে তাড়াহুরো করে আটকে নেয় মাথায়। এরপর ফাইলটা নিয়েই দৌড় লাগায়।
জায়েদা বেগম এতক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে মেয়ের কান্ড কারখানা দেখছিল। এবার ডাক দেন।
- কিরে তুই না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস।
- আম্মু খাওয়ার সময় নেই। খেতে বসলে চাকরি এটাও যাবে।
জায়েদা বেগমকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বেরিয়ে যায় আদিয়া। রাস্তায় বের হয়ে পড়ে আরেক বিপাকে। একটা রিক্সাও নেই। এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করে যাচ্ছে। এমন সময় সায়ন গাড়ি নিয়ে বের হয় অফিসের উদ্দেশ্যে। আদিয়াকে দেখে সায়ন গাড়ি দাড় করায় তার সামনে।
- হ্যালো মিস। তুমি চাইলে আমি তোমাকে ড্রপ করে দিতে পারি।
পরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনে পেছন ঘুরে তাকায় আদিয়া। পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে গাড়ির ভেতরে নজর দেয়। ভিতরে তাকিয়ে এক প্রকার থমকে যায় আদিয়া। এত বছর পর সায়নের সাথে দেখা হয়ে যাবে এভাবে বুজতে পারেনি।
- আপনি এখানে?
- অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুজি।
- না সেরকম কিছু না। হঠাৎ এভাবে দেখা হবে ভাবিনি।
- তোমার আশে পাশেই ছিলাম। তখন চোখে পর্দা পরেছিল তাই দেখনি (বিড়বিড়িয়ে)
- কিছু বললেন।
- না কিছু বলিনি। বলছি আগে আশপাশে ছিলে না তাই দেখনি এখন আমিও এই বাসায়ই আছি। মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যাবে নে। বাই দা রাস্তা দেরী হয়ে যাচ্ছে। গেলে চলো।
- আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারব।
এরমধ্যে একটা খালি রিকশা দেখতে পায় আদিয়া। রিকশা ডেকে উঠে পড়ে তাতে। আদিয়া এভাবে চলে যাওয়ায় অপমান বোধ করে সায়ন। । এই মেয়েকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। এ ক বছরে কম তো জ্বা'লায় নাই। এখনো কি ভাব মেয়ের পাত্তাই দিল না। হুহ। বিড়বিড় করতে করতে গাড়ি স্টার্ট দেয় সায়ন। হঠাৎ মাথায় বদ বুদ্ধি চেপে বসে সায়নের। সে অফিসের উদ্দেশ্য না গিয়ে আদিয়ার পিছু নেয়। আদিয়ার রিকশার পিছন পিছন গাড়ি নিয়ে যেতে থাকে। কিছুদূর যেতেই ট্রাফিক লাইট জ্বলে ওঠে। সব গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। বেশ বিরক্ত হয় আদিয়া। এ চাকরিটা বোধ হয় আর করা হবে না। তাই হতাশার শ্বাস ছেড়ে চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে আদিয়া। আর ভাবতে থাকে একটু আগের ঘটনা। কত গুলো বছর পর সায়নকে দেখছে৷ সায়ন যেন আগের থেকে আরো সুন্দর হয়ে গেছে। ফর্মাল ড্রেসআপে কত সুন্দর লাগছে। আগের মতো মুখ ভর্তি দাড়ি গোফ নেই। হাত ভর্তি সেই হাবিজাবি ব্রেসলেট এর পরিবর্তে একটা ওয়াচ আছে এখন। আগের উল্টো করে বেধে রাখা বড় চুলগুলোও এখন ছোট করে কাটা। সায়নের এমন পরিবর্তন বেশ ভালো লাগে আদিয়ার। এই পরিবর্তন যে ওর জন্যই হয়েছিল তা আর ওর মোটা মাথায় ঢোকে না। হঠাৎই সায়নের কথা ভেবে আনমনে হেসে ওঠে আদিয়া। এদিকে তার হাসি যে কেউ মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে। একজন নিজের ভাবনায় অন্য জন তার পাশের গাড়িতে বসে প্রেয়সীকে দেখায় মগ্ন। এমন সময় পেছন থেকে কালো রঙ এর একটা গাড়ি আদিয়াাদের রিকশায় ধাক্কা মে'রে দেয়। টাল সামলাতে পারে না আদিয়া। সাথে সাথে রিকশা থেকে পড়ে যায়। পড়ে হাত পা ছিলে যায়। জ্বলে ওঠে কাটা জায়গা। ব্যাথায় আহ শব্দে কুকড়ে ওঠে আদিয়া।
সায়ন হঠাৎ এমন কিছু দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। ওহ শিট বলে গাড়ির স্টিয়ারিং এ বাড়ি মা'রে। এরপর গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে নেয়। কিন্তু পেছনের গাড়ি থেকে আয়ানকে বেড়োতে দেখে দমে যায় সায়ন। তার মানে ধাক্কাটা আর কেউ নয় তার নিজেরই ভাই দিয়েছে। এখন সেখানে যদি সে যায় ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যাবে। সে যদি ভাইয়ের হয়ে সাপোর্ট করতে যায় সেখানে আদিয়া ব্যাপারটা কীভাবে নিবে কে যানে। আবার আদিয়ার হয়ে বড় ভাইকে কিছু বলতেও পারবে না। তাই আপাতত গাড়িতেই বসে থাকে সায়ন।
আয়ান এগিয়ে যায় সামনে। তখনো আদিয়ার মুখ দেখেনি। তাই জিজ্ঞেস করে আপনি ঠিক আছেন তো?
- ব্যাটা খচ্চর চোখে দেখিস না। চোখে দেখিস না যখন গাড়ি চালাস কেন। এখন আমার কী হবে। এখন আমি কীভাবে যাব। আমার চাকরিটাও তো হবে না৷ এত বড় একটা কোম্পানি গেল তো হাতছাড়া হয়ে। সব তোর জন্য হয়েছে।
- এই মেয়ে তুই তোকারি করছ কেন। তুমি
আর কিছু বলতে পারেনা আয়ান। চোখ যায় আদিয়ার মুখের দিক। আদিয়াকে দেখে চমকে যায় আয়ান। যাকে এত বছর যাবত খুজতেছে খুজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে সে এভাবে সামনে আসছে। আয়ান যেন খুশিতে আকাশের চাদ হাতে পেয়েছে। এক নজরে তাকিয়েই আছে আদিয়ার দিকে।
আদিয়া তুড়ি বাজায় আয়ানের সামনে। চোখের সামনে তুড়ি বাজানোতে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে আয়ান। তোতলাতে তোতলাতে বলে
- সি সিরাত তু তু তুমি এখানে। আমি কি সত্যি দেখছি এটা নাকি সপ্ন। সপ্ন না সত্যি পরীক্ষা করার জন্য আদিয়ার হাত ধরে। আদিয়া ঝারা মে'রে হাত ছাড়িয়ে নেয়। আর বলে আমি তো ভেবেছিলাম আপনি শুধু চোখেই দেখেন না। এখন দেখতেছি লুচুও বটে। রাস্তা ঘাটে মেয়েদের গায়ে হাত দেন। আচ্ছা খারাপ মানুষ তো আপনি।
- সিরাত তুমি কি বলছ এগুলা। তুমি সত্যি আমাকে চিনতে পারোনি। তুমি আর তোমার পরিবার সেদিন ওভাবে পালিয়ে কেন গিয়েছিলে জবাব দাও সিরাত। সেদিন পালিয়ে না গেলে আজ দিনগুলো হয়ত অন্যরকম হতো।
আায়ন বার বার সিরাত সিরাত করায় নামটা কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগতেছিল আদিয়ার কাছে। কোথায় যেন শুনেছে ঠিক মনে করতে পারতেছে না। হঠাৎ আদিয়ার মনে পড়ে মায়ের মুখে অনেক বার সিরাত নামটা শুনেছে। কেউ সিরাত এর নাম নিলেই জায়েদা বেগম কেমন যেন চুপসে যান।সেখান থেকে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর যখন বের হন চোখমুখ থাকে ফোলাফোলা। দেখেই বোঝা যায় যে তিনি কান্না করছেন। তারপর গম্ভীর হয়ে থাকেন। কারো সাথে কথা বলেন না। জায়েদা বেগমের এমন আচরনে এখন আর বাসায় কেউ কখনো সিরাত এর নাম নেয়না। তবে এই সিরাত কে আদিয়ার সাথে সিরাতের কি সম্পর্ক সে সম্পর্কে আদিয়া কিছুই জানেনা।
আয়ানকে সে বলে সে সিরাত না। কিন্তু আয়ান ও নাছোর বান্দা তার পুরো বিশ্বাস আছে যে আদিয়াই সিরাত। এটা বোঝানোর চেষ্টা করতেছে। তাই কিছু মনে করানোর জন্য সিরাতের সাথে ঘটা কিছু ঘটনা বলতে লাগল। কিন্তু আদিয়ার তাতে কিছুই মনে পড়ল না।
সবুজ বাতি জ্বলে ওঠায় সব গাড়ি ছেড়ে দিল। আদিয়াও রিকশায় উঠে বসল। এরপর আয়ান গেল সেখান থেকে। আয়ান গাড়ি স্টার্ট দিতেই মনে পড়ল আজতো ওদের অফিসে নতুন লোক নেয়ার কথা। আর ও এত দেরী করে ফেলল। তাই তাড়াহুরো করে অফিসের উদ্দেশ্য গেল। কিন্তু যত যাই হোক সিরাতের চিন্তা মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরাতে পারল না। আজ যাকে দেখল এটা যে সিরাত না তা বিশ্বাস করতে পারছে না আয়ান।ওর ধারণা সিরাত হয়ত সব ভুলে গেছে নয়ত ওকে না চিনার অভিনয় করছে।
আয়ান অফিসে ঢুকতে যাবে তখন দেখে সিরাত নামের মেয়েটা দৌড়ে এই অফিসের দিকেই আসছে। অবাক হয় আয়ান। এই মেয়ে কি তাহলে এই অফিসেই আসছিল। আদিয়া আসলে গেট এ দাড়োয়ান তাকে আটকে দেয়। ঢুকতে দেয় না। আদিয়া বলে যে সে এই অফিসে জব নিবে তাই সিভি জমা দিতে আসছে। কিন্তু দাড়োয়ান ওকে ঢুকতে দেয়না বলে সময় অলরেডি শেষ।
আদিয়া আর রিকোয়েস্ট করে না। চাকরি না হলে নাই করবে না। তাই হাটা ধরে। তখন পিছন থেকে দাড়োয়ান আবার ডাক দেয়।
- ম্যাম উপর থেকে ফোন আসছে। আপনাকে যেতে বলেছে। আদিয়া বুজে না কে এমন আছে ঢ়ে ফোন দিয়ে যেতে বলল। এত ভাবনা না ভেবে উপরে যায় আদিয়া। সেখানে একটা রুমে সিভি গুলো জমা নেয়া হচ্ছে। সেখানে গিয়ে সিভি জমা দেয়। ওকে বলা হয় পরে ফোন করে জানাবে।
।
।
।
।
।
।
আজ রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে বসে থাকে আদিয়া। সেই গিটারের সুরটা শুনতে খুব মনে চাচ্ছে তাই বেলকনির দরজা খোলা রেখে বসে বসে অপেক্ষা করছে। দরজা খোলা রেখেছে যাতে ভালোভাবে শুনতে পায়। কিন্তু আজ আর গিটারের সুর বাজে না। অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে যায় আদিয়া।
এদিকে সায়নে মাথায় গভীর চিন্তা ঢুকে গেছে। কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠেছে। আদিয়া আর আয়ানের সব কথাই সে শুনেছে গাড়িতে বসে। আর এটা নিয়েই চিন্তা সায়নের। তবে কি আদিয়াই সিরাত। তাহলে কি আবারো হারিয়ে ফেলবে আদিয়াকে এই চিন্তা ঝেকে বসে সায়নকে। আদিয়াকে এক নজর দেখতে মনটা কেমন আকু পাকু করছে। এক সময় অবাধ্য মনের ডাকে সায় দিয়েই দেয়। বেলকনি টপকে চলে আসে আদিয়ার বেলকনিতে। বেলকনির দরজা খোলা রেখেই ঘুমাচ্ছে আদিয়া। সায়নের ভিতরে ঢোকার কাজ আরো সহজ হয়ে যায়।
আদিয়া ঘুমের মধ্যেই টের পায় মাথার কাছে কেউ বসে আছে৷ ঘাড়ের কাছে তার গরম নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে। ঠান্ডা হাতটা গলার খালি জায়গায় চেপে ধরেছে কেউ। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে অনেক অপেক্ষা করিয়েছ মায়াপরি। অপেক্ষার অবসানের সময় এসেছে। এখন আর কোন ঝামেলা আমি চাইনা। আর নিজেকে নিজে রক্ষা করতে শিখ। অন্য কেউ কেন তোমার হাত ধরবে। অন্য কেউ হাত ধরলে সেটা যে আমার সহ্য হয়না মায়াপরী। নিজেকে নিজে সেফ রাখতে না পারলে আমিই রাখব সমস্যা নেই। তবে আজ শুধু হাত মুছে দিয়ে গেলাম পরেরবার এই হাতই সাথে রাখব না তাইলে। ইউ আর অনলি মাইন। কেউ বাধা দিতে আসলে তাকে সরিয়ে দিতে দু মিনিট ভাবব না।
ফট করে চোখ খোলে আদিয়া। হাতরে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো বাজে। বেলকনির দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা খোলাই আছে। ভয় পেয়ে যায় আদিয়া। দৌড়ে বেলকনির কাছে যায়।
গল্প: তোর মায়ায় আসক্ত
লেখনীতে: নীহারিকা নুর
#পর্ব_১০

0 Comments