স্টেশনের পাশের ছোট ঝুপড়ি চায়ের দোকানটায় এসে ধপ করে বসলো মৃন্ময় রোজকার মতোই l ঘামে ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে গায়ের সস্তার শার্টটাl উফফ কি গরম ! এর মধ্যে রোজ লোকাল ট্রেনের ভীড় ঠেলে অফিস করা কি চাট্টিখানি কথা !
' ওরে মদনা , দে রে এক কাপ চা ' ۔۔ হাঁকটা ছুঁড়ে দিয়ে রুমাল বের করে ঘাড়ে গলার ঘাম মুছতে শুরু করলো মৃন্ময় l চায়ের দোকানে বসে রোজকার মতোই চায়ের অপেক্ষা করছে l অফিস থেকে ফিরতি পথে রোজ এই এক পেয়ালা চা টা না হলে শরীরটা একেবারে নুয়ে পড়ে যেন l তাই এই টুকু নিজের জন্য ব্যয় করতেই হয় l বাড়িতে তো চা করে দেবার কেউ নেই l বউ টা প্যারালাইসিস হয়ে বিছানা বন্দি তা বছর দুয়েক হল l আর ছেলেকে রান্নাঘরে ঘেঁষতে দেয় না মৃন্ময় l ও পড়াশুনাটাই মন দিয়ে করুক l তাই অফিস বেরোনোর আগে রান্না বান্না , ছেলের টিফিন সবই সেরে রেখে বেরোয় ও l সেদিন অফিসের গৌতম বলছিলো
' মৃন্ময় দা একটা রান্নার লোক রাখতে পার তো ' l মৃন্ময় জবাব দেয়নি l শুধু শুকনো হেসেছিলো l
কুড়ি হাজার টাকা মাইনে তে বউয়ের ওষুধ , ছেলেটার পড়া আর সংসারের খাই খরচ চালাতেই নাভিশ্বাস উঠার যোগাড় ؛ সেখানে ও রাখবে রান্নার লোক !
পরনের গেঞ্জিগুলো ছিঁড়ে ফর্দাফাই হয়ে গেছে , শার্টগুলোও রং চটা , তাই কেনার অবস্থা নেই l
চায়ের অপেক্ষা করতে করতে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো মৃন্ময় l সস্তার স্মার্ট ফোনের পর্দা ঠেলছে এলোমেলো l ফেসবুকে আজকাল অনেকে গল্প লেখে l মাঝে মাঝে পড়ে মৃন্ময় l বেশ লাগে l বই কেনার সামর্থ্য তো আর নেই l
একটা গল্প পড়তে শুরু করলো মৃন্ময় l গল্পটার নাম ভালোবাসা l একজন গৃহবধূর গল্প l মেয়েটা সংসারের সবার কথা ভাবে l সবার জন্য ভাবে l কিন্তু তার কথা কেউ ভাবে না l তাকে কেউ ভালোবাসে না l তাই মেয়েটা ঠিক করলো এবার থেকে সে নিজেই নিজেকে ভালোবাসবে l আগে যে জমানো টাকা দিয়ে সে বাড়ির লোকদের জন্য উপহার কিনত , এবার সে আর তা করলো না l নিজের পছন্দের শাড়ি কিনে এনে সাজলো l
মৃন্ময় বন্ধ করলো ফোনটা l ধুর ! সবাই একই রকম লেখে যেন l মেয়েদের স্যাক্রিফাইস এর গল্প l কেন মেয়েরাই কি শুধু স্যাক্রিফাইস করে ? ছেলেরা কি কখনো করে না ? লেখকদের চোখে কি সে উদাহরণ কখনোই পড়ে না ?
' ও দাদা শুধু চা তো ' ? রোজকার মতোই হাঁক দিলো ছেলেটা l
' হ্যাঁ রে ' l রোজকার মতোই বললো মৃন্ময় l
আবার ফেসবুক খুললো ও l আর একটা গল্পের গ্রূপ খুললো l আর একটা গল্প পড়তে শুরু করলোl এই গল্পের নাম অধিকার l এখানেও সেই একই গল্প l একটা মেয়ে l তার খুব কষ্টl বাড়ির সবাই নিজের দুনিয়ায় মগ্ন l গল্পের শেষে লেখিকা বলেছেন মেয়েদেরও অধিকার আছে নিজেদের ভাল মন্দ ভাবার , নিজেদের শখ পূরণ করার , নিজেকে ভালোবাসার l
আবার ফেসবুক বন্ধ করে দিল মৃন্ময় l শুধু মেয়েদেরই অধিকার আছে নিজেদের নিয়ে ভাবার ? আর যে পুরুষরা নিজেদের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত উজাড় করে শুধু পরিবারকে ভালো রাখতে তাদের অধিকার নেই নিজেদের নিয়ে ভাবার ? তাদের গল্প লেখার কি কেউ নেই ? নাকি পুরুষদের নিয়ে লেখা গল্প কারোর ভালো লাগে না বলে লাইক কমেন্ট কম আসার ভয়ে লেখকরা সে গল্প লেখেননা ? ছেলেদের যেমন নাকি কাঁদতে নেই , তেমন কি তাদের কষ্টের কথা নিয়ে দু কলম লিখতেও নেই ? নাকি তাদের নিজেদের শখ আল্হাদ পূরণের কোন অধিকারই নেই ? কে জানে !
ফোন পকেটে ঢুকিয়ে দিলো মৃন্ময় lশরীরটা বড্ডো ক্লান্ত লাগছে আজ l একটা আড়মোড়া ভাঙলো হালকা করে l গলা তুলে বললো
' আর কত দেরি রে ' ?
' এই তো হয়ে গেছে দাদা lদুটো অমলেটের অর্ডার আছে ভেজে নিই ' l
মৃন্ময়ীর নাকে ঝাপ্টা মারলো গরম ডিম ভাজার গন্ধ l মনটা চনমন করে উঠলো ওর l ছোটবেলায় এই ওমলেট ওর কি প্রিয়ই না ছিল l ডিম্ যে চিরকালই ওর বড্ডো পছন্দের l কতদিন হয়ে গেলো ডিম খাওয়া হয়নি l রোজ ওই একই সবজির ঘ্যাঁট আর ভাত l কখনও মাছ বা ডিম আনলেও সেটা ও বউ ছেলের জন্যই রাখে l বৌটার শরীরে প্রোটিন দরকার , আর ছেলেটারও তো উঠতি বয়স l মৃন্ময়র ওসব লাগে না l
কি যেন একটু ভাবলো মৃন্ময় l হঠাৎ হাঁক দিলো গলা তুলে
' আমার জন্যও ডবল ডিমের ওমলেট রেডি কর তো একটা ' l
' হ্যাঁ '? চমকে গেছে দোকানের ছেলেটা l
' হ্যাঁ রে কর l জলদি দে ' l হাসিমুখে বললো মৃন্ময় l শুধু মেয়েদের নয় , সংসারে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেওয়া পুরুষদেরও মাঝে মাঝে অধিকার থাকে নিজেদের ভালোবাসা , নিজের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করার , সে তাদের নিয়ে গল্প লেখা হোক বা না হোক l তেমনই মৃন্ময়এরও আজ ইচ্ছা হচ্ছে নিজেকে একটু ভালোবাসার l নিজেকে যে বহুদিন ভালোবাসা হয়নি l
----- সমাপ্ত -----
ছোট গল্প: মৃন্ময়ের_ভালোবাসা
লেখনীতে: পল্লবী সেনগুপ্ত
.jpg)
0 Comments