Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ৫

মুগ্ধকে নিয়ে ছাদের উপরে উঠেই লক্ষ্য করলাম কে যেনো বিড়ি ফুঁকতেছে দেয়ালের কার্ণিশে। বদ্ধ রুম, চারপাশে পুরাতন দেয়াল। মেঝেতে নানা প্রকার ময়লার স্তূপ। বিড়ির শেষাংশ পড়ে রয়েছে কোথাও কোথাও। অতি স্বল্পমূল্যের বিড়ি। এমন একটা জায়গায় কেউ সিগারেট খেতে আসবে বলে আমার মনে হয় না। আমি দরজার সামনে থেকে উনাকে দেখেই মুগ্ধর দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। উনিও গম্ভীর মুখে সেই মানুষটার দিকে চেয়ে আছে। কারো উপস্থিতি বুঝাতে হালকা কাশি দিলাম। তবুও উনি নিশ্চিন্ত মনে বিড়ি ফুঁকছে। এবার আমি সরাসরিই মৃদু কন্ঠে বলে ফেললাম-

- কে আপনি? এখানে কি করছেন।


উনি হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে পেছনের দিকে তাকালেন। আমার দিকে চোখ বড় বড় করে চাইলেন। কিন্তু মুগ্ধকে দেখেও কোনো ভাবান্তর করলেন না। আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ঢিলা ময়লা শার্ট আর প্যান্ট পরেছে৷ মুখে দাঁড়ির স্তুপ। উনি কি পাগল টাগল নাকি? এখানেই বা কি করছেন। অনেক বয়স্ক লাগছে৷ কি করছেন এখানে? উনি এখনো নির্লিপ্ততায় তাকিয়ে আছে। উনাকে আকর্ষণ করার জন্য আবার বললাম -
- কে আপনি? এখানেই বা কি করছেন?
- কেউ না আমি। কেউ না। সড়ে যাও এখান থেকে।
আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে জবাব দিলেন তিনি। অতঃপর আমাকে অতিক্রম করে তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে গেলেন। আমি ভেবেই পেলাম না তিনি এমন কেনো করছেন? মুগ্ধের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম -
- উনাকে চিনেন নাকি?
- হ্যাঁ। পাগল আরকি। আপনি উনার কথায় কান দিবেন না। আসুন পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাই৷
বলেই সেখান থেকে সড়ে গেলেন তিনি। আমি পিছন পিছন চললাম। উনি হয়তো গতকালের সিড়ির নিচে সিগারেট খাওয়া লোকটা হবে। কিন্তু আমাকে দেখে এমন ভয় পাচ্ছেন কেনো? অথচ মুগ্ধকে দেখে তেমন পাত্তাই দিলেন না। আমি মুগ্ধর সাথে সাথে প্রতিটা রুম দেখলাম। উনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোনটা কার রুম ছিলো। কোথায় কোথায় কারা কারা ছিলেন। কোথায় খাওয়ার রুম ছিলো। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছি। উনার গম্ভীর মিষ্টি কন্ঠস্বর শ্রবণ করছি। একটা সাদা শার্ট পড়েছেন আর কালো প্যান্ট। একদম হিরো হিরো লাগছে। সিল্কিচুলগুলো কপালে পড়ে যাচ্ছে বারবার। আশ্চর্যভাবে উনার সৌন্দর্য আর ব্যাক্তিত্য আমাকে তীব্র আকর্ষণ করছে। তাহলে কি দাদিমাও এমনভাবে প্রেমে পড়েছিলো? আমার দুইদিনের পরিচয়েই তো অবস্থা খারাপ। অথচ দাদিমা এখানে বছরের পর বছর ইউসুফের সহচর্য লাভ করেছিলেন। তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যেতে কতটা খারাপ লেগেছিলো দাদিমার। হঠাৎ মনের ভীতর ভীষণ ব্যাথা অনুভব করলাম। এই ব্যাথা যে কতটা ভয়ানক তা আজ কয়েকবছর পর লিখতে বসে বুঝতে পারছি। সবার মতো আমারো একটা ডায়েরী থাকুক। কিছু অনুভূতির সাথে শুধু ডায়েরীর পরিচয় থাকুক। আর কারো নয়৷
আমি উনার সাথে ছাদে উপস্থিত হলাম। এই ছাদেই দাদিমা তার প্রেমিকের সাথে কত আড্ডা দিয়েছে তা বলা মুশকিল। এই কথা দাদিমা আমাকে হাজার বার বলেছে। ছাদ তাঁর জন্য একটা প্রিয় জায়গা ছিলো। সেখানে ইউসুফ সারাদিন পরাশোনা করতো আর দাদিমা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। ইউসুফ বিরক্ত হতেন না। তিনি নাকি একবার দাদিমা'কে নোটখাতায় লিখে বলেছিলেন -
-' আল্লাহ আমাকে একবার কথা বলার সুযোগ প্রদান করলে শরৎচন্দ্রের একটা কবিতা পাঠ করে শুনাতাম তোমাকে। আমার কবিতা আবৃতি করার অনেক ইচ্ছা '
সেই ইচ্ছা উনার পূরণ হয়নি। না, দাদিমা কখনো তার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। দাদিমা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে বলেছিলেন -' আমি সত্যি বোধহয় কাউকে ভালোবাসতাম। নাহলে জীবনের এই অন্তিম মহুর্তেও তাকে অনুভব করছি কেনো? কি স্বার্থে? তিনি কি একবারও আমাকে খুঁজতে আসেনি এই কলকাতা শহরে। সৃষ্টিকর্তা কেনো আরেকবার তার সাথে আমার দেখা করালেন না। আমি কি এমন পাপ করেছিলাম যার জন্য একটা অপূর্ণতা থেকেই গেলো জীবনে। তাঁর কাছে রয়ে গেলাম বিদেশিনী হয়ে। '
- এইযে মেয়ে এভাবে উদাস হয়ে কি ভাবছেন? কোন জগতে আছেন বিদেশিনী?
হঠাৎ মুগ্ধের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে পরলাম। আশ্চর্য! উনিও আমাকে বিদেশিনী সম্মোধন করলো কেনো? আমার চোখ ভীষণ জ্বলছে। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানিটুকু ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে বললাম-
- আমার ভালোলাগছে । আপনি চলে যান এখান থেকে। পরে আপনার প্রয়োজন হলে ডাকবো।
কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে নিলাম। সাথে সাথেই চোখদুটো দিয়ে দু'ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো কপলবেয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি দাদিমা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই ইউসুফ। দুজন আগের মতোই হেসে হেসে কথা বলছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আজ তাদের মিলনের দিন। বোধহয় হাজারবছর পেরিয়ে তাঁদের দেখা হলো সেই পুরোনা যায়গায়। উম্মুক্ত ছাদের কৃঞ্চচুড়ার ছায়াতলে। আমি দেখছি আমার দাদিমা বারবার ইউসুফকে বলছে ' এখানেই থাকো। টেবিলটা এখানেই রেখে সারাদিনরাত পড়াশোনা করো। দরকার হলে বইয়ের ভীতর ঢুকে যাও। তবুও রোদে বসে বই পড়িও না। '
প্রতুত্তরে ইউসুফ আগের মতোই হেসেছে। কৃষ্ণচুড়ার ছায়া থেকে সড়ে গিয়ে রোদে নিজের সুদর্শন মুখমণ্ডল প্রকাশ করেছে। দাদিমা রাগে, দুঃখে, হতাশায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবারো ইউসুফের হাসিতে সম্মহিত হয়ে নিজেও হেসেছে।
আমি আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা ধরে যাচ্ছে বারবার। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মুগ্ধ নেই। সত্যি চলে গেলেন তাহলে!
পুরাতন ছাদের দেয়ালে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলাম। দাদিমার বলা একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। একদিন আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল স্কুল ছুটি দেয়ার পর বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছিলাম বলে। মা আমাকে এমন অবস্থায় দেখে রেগেমেগে মারলেন দুটো চড়। বৃষ্টিতে ভিজা আর থাপ্পরের ব্যাথায় জ্বর আসলো হু হু করে। আমি তখন ক্লাস নাইনে। তখন দাদিমা আসলেন আমার কাছে। আমি জ্বরের ঘোরে কথা বলতেই পারছি না। সেদিন মা রাগ করেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। আর আমাকে দেখতে আসেনি। দাদিমা তখন আমার ঘরে এসে বালতি বালতি পানি ঢাললেন মাথায়। চুল মুছিয়ে দিয়ে মাথায় তেল দিতে দিতে বললেন -
- ' একটা ঘটনা তোকে বলবো । তোকে ছাড়া তো এসব কাউকে বলতে পারি নাই । আজকে আরো একটা ঘটনা বলি। '
আমি দাদিমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছেন। বোধহয় কোনো রোমান্টিক সিনের কথা বলবেন। তখন আমার সদ্য কিশোরী মন সেই গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। ভূলে গেলাম আমার জ্বরের কথা। দাদি চোখ ফিরিয়ে বলতে থাকলেন -
-'১৯৪৯, তখন বর্ষাকাল চলছে।
অথচ আকাশে তীব্র রোদ উঠেছে। সাথে আমার মনেও। আর সেই রোদে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে ইউসুফ। সেদিন আমার শাড়ি পড়তে ভীষণ ইচ্ছা হলো। মা'কে বললাম একটা শাড়ি বের করে দাও । মা বিরক্ত হলেন আমার কথায়। এই নিয়ে মাসে যে কতবার শাড়ি পড়েছি তা বলার বাইরে। দিনে দুই-তিনবারও শাড়ি পড়েছি। বাবা তো বাইরে কোথাও গেলেই আমার জন্য দুই-তিনটা করে শাড়ি নিয়ে আসতো। ভীষণ দামি সেই শাড়িগুলো। কিন্তু সেগুলো আমি পড়তাম না। বাবা মা'কে যেগুলা এনে দিতো সেগুলায় ভাগ বসাতাম। মা এই নিয়ে সে কি রাগ। আলমারিতে এত এত শাড়ি অথচ আমার শাড়িতেই মেয়ের নজর। বাবা শুনতেন আর হাসতেন। সেদিন একটা লাল শাড়ি পড়লাম। এটা নাকি মায়ের বিয়ের শাড়ি। আমি মনোযোগ দিয়ে শাড়ি পড়লাম। শাড়িটা পড়েই আমার কেমন বউ বউ অনুভব হলো৷ শাড়িটা এর আগে কখনো পড়া হয় নি। তাই সেটা পরে চুলগুলো ছেড়ে দিলাম পিঠে। আজ আর কোনো বেণী চলবে না। চুল ছেড়ে দেয়ায় সারা পিঠ ঢেকে গেলো চুল দিয়ে। তখন যে কতবড় চুল ছিলো তা বলার বাইরে। গ্রামে আমার থেকে বড় চুল কারো ছিলো না। কপালে কালো টিপ পড়লাম। চোখে হালকা কাজল দিলাম। সকালে মনের সুখে পায়ে আলতা দিয়েছিলাম। কেনো দিয়েছিলাম নিজেও জানি না। পায়ে নূপুর পড়লাম। সেটা উপহার দিয়ে ছিলো ইউসুফ সেবছর বৈশাখী মেলায়। সেই শাড়ি পরে সাজসজ্জা করে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম যার উদ্দেশ্যে এতকিছু তাকে দেখানোর জন্য। ইতোমধ্যে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। এটা নতুন কোনো ব্যাপার না। বর্ষাকালে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেখলাম মহাশয় এখনো বই পড়ছে মগ্ন হয়ে। এদিকে আকাশের রুপ পরিবর্তন তার নজরে আসে নি। আমি ছাদে উঠেছি সেটাও অনুভব করতে পারলো না সে। আমার রাগ হলো। ভীষণ রাগ। অথচ সে নির্লিপ্ত।
খানিক্ষণ সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। তবেই মহাশয় বুঝলো এখন তার বই পড়ার সমাপ্তি ঘটাতে হবে। বইয়ের ছোট্ট টেবিলটা তাড়াহুড়ো করে ছাদের ছোট ঘরটাতে রাখলো। বৃষ্টিতে আমি ভিজে গেছি তবুও নড়ছি না। দেখি সে কতক্ষণ এভাবে আমায় না দেখে থাকতে পারে। যখন তার টেবিল চেয়ার ঘরে রাখার কাজ সমাপ্ত হলো তখন আমার দিকে তার নজর আসলো। আমার রক্তিম চোখ তার নজরে আসলো। আর সে বরবরের মতোই হেসে উঠলো৷ আমি তবুও ভাবান্তর করলাম না। আজ যাই হয়ে যাক না কেনো। তার মিষ্টি হাসিতে কাবু হবো না। এখানেই দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো। ইউসুফ ঝটপট রুম থেকে বেড়িয়ে আমার হাত ধরলো। আমাকে সেই রুমে যাওয়ার জন্য হাত ইশারা করলো। আমি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। সে থাকুক তার পড়া নিয়ে। তীব্র কন্ঠে বললাম -
- যাও রুমের মধ্যে গিয়ে পড়তে বসো। এখানে এসেছো কেনো? আমি আজ সারাদিন ভিজবো। তুমি গিয়ে তোমার পড়াশোনা শুরু করো। যাও বলছি।
তখন ইউসুফ ব্যাথিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ বোধহয় সে সত্যি সত্যি অনুতপ্ত। এদিকে আমার রাগ কমে যাচ্ছে। কিন্তু রাগ কমালে তো চলবে না। ইতোমধ্যে তীব্র বর্ষণে আমরা ভেজা কাক হয়ে গেছি। তার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে কপালবেয়ে চোখে ঠেকে যাচ্ছে। সাদা পান্জাবীটা শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়ে তার সৌন্দর্য ভয়ংকর রুপে প্রকাশ পাচ্ছে। ভাগ্যিস সে সারাদিন ছাদে বই পড়ে। নাহলে গ্রামের কত মেয়ে যে পাগল হয়ে যেতো সৃষ্টিকর্তাই জানে। এই দিক থেকে তাঁর বই পরার গুরুত্ব অপরিসীম মনে হলো। যাই হোক, অবশেষে কোনো লাভ হলো বোধহয় বই পড়ার।
সে এখনো আমার লেপ্টে যাওয়া কাজল চোখে তাকিয়ে আছি ঠাই দাঁড়িয়ে। তার কেমন নেশাতুর দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতেই তো মিশে আছে আমার মৃত্যু, আমার ধ্বংস। অথচ সে তার দৃষ্টিতে ঘায়েল করছে আমায়। এর শাস্তি কি হতে পারে সে কি জানে না?
সে এগিয়ে আসলো আমার আরো কাছে। হাতদুটো গালে রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো।


চলবে................
( বিঃদ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

গল্প: বিদেশিনী 

#পর্বঃ০৫

লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments