ছাদে বর্ষণ চলছে ক্রমাগত। আষাঢ়ের এই ঘনঘটা মুহুর্তে আকাশ তীব্রভাবে ডাকছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের ঝলকানি পুরো পৃথিবীকে সেকেন্ডের জন্য আলোকিত করছে। এদিকে দুটো মন ছাদের ছোট্ট ঘরে চুপ করে বসে রয়েছে। তাদের মনের ভীতর কাজ করছে এক আকাশ লজ্জা, ভয়, সংকোচ। ভেজা শরীরে এখনো অপরাজিতা বসে রয়েছে কাঠের চেয়ারটাতে। ঠান্ডায় শরীরে কাঁপন ধরছে ধীরে ধীরে। ইউসুফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপরাজিতাকে দেখছে৷ সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা অপরাজিতাকে অপ্সরী মনে হচ্ছে তাঁর। ছাদঘরের টিনের চালে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। সেই ঝুমঝুম শব্দ আর আকাশের গর্জনে ছাদটা কেমন ভয়ংকর গোমট ভাব ধারণ করছে।
--------
আমার ধ্যান ভাঙলো কাকের কর্কশ কন্ঠে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যের কাঠফাটা রোদ উঠেছে। অথচ সেই কৃঞ্চচুড়ার ছায়াতলে থাকায় রোদ লাগেনি। ওড়নাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। সব ঘরগুলো আরেকবার দেখে নিলাম। আর হয়তো আসা হবে না এখানে। চলে যেতে হবে। ক্যামেরাটা বের করে সবকটা রুমের ছবি তুলে নিলাম। বাসায় গিয়ে বাবা-মা কে দেখাবো।
নিচে এসে সেই লোকটাকে দেখলাম কুয়োর পাশে চুপটি করে বসে কার সাথে যেনো কথা বলছে। এটাই সুযোগ লোকটার সাথে কথা বলার। একটা ময়লা সাদা চাদর দিয়ে পুরো শরীর আবৃত করা উনার। একটু সাহস জুগিয়ে সামনে গেলাম। উনি কিছু পাথর কুয়োর ভীতরে নিক্ষেপ করছে আর অস্পষ্টস্বরে কি কি যেনো বলছে। আমি আরো কাছে কুয়োটার দিকে লক্ষ করলাম। দেখার সাথে সাথেই ভয়ে আমার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। কি ঘন অন্ধকার। সেখানে লোকটার নুড়িপাথরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার। হঠাৎ লোকটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যেটা শোনার সাথে সাথেই আমি চমকে পিছনে সরে গেলাম। উফফ! কি ভয়ংকর।
- কে রে?
- আমি আমি
উনি হঠাৎ এমন কথা বলায় আমি সাথে সাথে ভয়মিশ্রিত কন্ঠে জবাব দিলাম। সাথে একটা শুকনো ঢোক গিললাম।
- ও তুই। তোকে তো আমি চিনি। হাহাহাহা।
বলেই হেসে ফেললেন উনি। সে কি ভয়ংকর উনার হাসির শব্দ। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
- আপনি কি করছেন এখানে?
- কথা বলি দেখতে পারছিস না। কথা বলছি। হাহাহাহা।
- কার সাথে কথা বলছেন? আমি কি জানতে পারি?
- তোকে বলবো কেন? সরে যা। সড়ে যা এখান থেকে।
আমি হালকা কেঁপে উঠলাম উনার শক্ত কন্ঠে। চেহারাটা যেমন ভয়ংকর, কন্ঠাটাও যেনো হরহর মুভির কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড। আমি বললাম-
- আপনি তো আমায় চিনেন। তাহলে বলবেন না কেনো? বললে এমন কি ক্ষতি হবে আপনার?
- দুই ট্যাকা দিবি? তাহলে বলবো। হাহাহাহা। সেই টাকা দিয়ে বিড়ি খাবো। দিবি? দিবি?
- দুই টাকা কেন? আরো টাকা দেবো। আমার কাছে অনেক টাকা আছে। আপনি বলেন।
উনি আর বলতে পারলেন না কিছু। তখন কোথা থেকে হালকা একটা লাঠিতে ভর করে দাদু হঠাৎ উপস্থিত হলো । লোকটাকে দেখার সাথে সাথেই উনি কেমন রাগান্বিত হলেন। খুবই শক্তকন্ঠে বললেন-
- এখানে কেনো তুই? চলে যা ।
আমি যা বুঝলাম তাতে দাদু লোকটাকে চিনেন। শুধু আমার সাথে কথা বলতে দিচ্ছেন না কেনো বুঝতে পারছি না। এমন কি কথা জানা আছে লোকটার যা আমাকে বলতে দিচ্ছেন না। লোকটা দাদুর কথা শুনার সাথে সাথেই সেখান থেকে চলে গেলো। অতঃপর দাদু আমাকে নিয়ে তার রুমে চলে চললেন। আমি দাদুকে বললাম-
- দাদিমা এখান থেকে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সব ঘটনা আমাকে বলেছেন। কি কারণে চলে গিয়েছেন সব আমার জানা। আমি শুধু এখানে এসেছি তার পরের ঘটনা জানতে। তিনি কেমন আছেন? তার ছেলে মেয়েরা কেমন আছে। নাতি নাতনীরা কেমন আছে। আর ঘুরতে এসেছি পূর্বপুরুষদের আবাসস্থলে।
সবটা জানা হলে এখান থেকে চলে যাবো দাদু। আপনি ছিলেন তিনভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তাহলে বাকিদুজন কি মারা গেছেন? কারণ উনার আপনার থেকে অনেক বড় ছিলো। দাদিমাও আমাকে সবটা বলেছে। বাকিটা না জেনে আমি চলে যেতে পারছি না দাদু। আমি আমার দুজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছি এখানে। তারা এখানে মানিয়ে নিতে পারছেন না। সবটা জানা হলেই চলে যাবো।
কথাটা বলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উফফ!
উনি দেখলাম নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আমার কথা শুনছেন। কথাটা শেষ হওয়া মাত্র উনি উনার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসলেন। আমাকে সোফা দেখিয়ে বললেন-
- বসো এখানে। তুমি কি জানতে এসেছো আমি জানি। সবটা বলবো ইনশাআল্লাহ । আর সবটা জানার পর যে তোমরা এখান থেকে চলে যাবে এটাও আমি জানি। কিন্তু আমি সেটা চাই না। দিদি চলে গেছেন বহুবছর হলো। আমি / আমরা খোঁজ নিতে যাইনি। না উনার খোঁজ নিয়েছেন। এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
এবাড়িটার মালিক এখনো তোমার দাদিমা। অথচ আমরা এখন এখানে থাকছি। উনারা চলে যাওয়ার আগে পুরো বাড়িটা বাবার নামে করে গেছেন। কিন্তু কি কারণে এই কাজ করলেন আমার জানা নেই। আমি তখন সামন্যই বুঝি। জমিপত্রের এই বিষয়গুলো মাথায় ঢুকেনি। আজ পর্যন্ত জানা হয়নি। আজীবন জানতে পারবো না। কারণ বাবা মারা যাওয়ার আগে কিছুই বলেন নি।
যাই হোক, অপরাজিতা দিদি চলে গেছেন। আর ফিরে আসেননি। আর কখনো আসবেন না। কিন্তু তার বদলে তুমি এসেছো। সামান্য দুটো দিন থেকে যাবে তা তো হবে না। এসেছো যখন কিছুদিন থেকে যাও। এখানে এসে তোমার দাদিমা'কে অনুভব করো। আমার ছোট্টবেলার খেলার সাথী ছিলেন তিনি। সারাদিন বাসায় থাকতে হতো বাবার করা আদেশে। এতটাই দুষ্টু ছিলাম যে কারো সাথেই মিশতে দিতো না এলাকার। কিন্তু দিদি ছিলেন। আমি হাজার অপরাধ করে বাসায় ফিরলেও যদি দিদি সামনে থাকতো তাহলে আমি বেঁচে যেতাম। ইউসুফ ভাই আমাকে সহ্য করতে পারতো না এই কারণে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ শুধু ঘুরে বেড়াতাম। ভাইয়া মারতে আসলে দিদি ছিলো আমার বাঁচার হাতিয়ার। কোনোভাবেই হোক ইউসুফ ভাইকে থামাতেন। আমিও যমের মতো ভয় পেতাম তাকে। কি শান্তশিষ্ট মানুষ। কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর চোখ কথা বলতো। তার চোখের দিকে একবার তাকালে আমি ভয়ে চুপসে যেতাম। অথচ সেই চোখ দেখে কিভাবে তোমার দাদিমা প্রেমে পরলেন কে জানে।
বলেই হাসতে থাকলেন তিনি। আমি স্পষ্ট উনার চোখে জল লক্ষ্য করলাম। কিছু স্মৃতি মানুষকে ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিতে পারে। তার আরেকটা জ্বলন্ত প্রমাণ পেলাম। আজ উনার কেউ নেই। কিন্তু একসময় উনার আলাদা একটা পরিবার ছিলো। সেই পরিবারের ছোট রাজপুত্র ছিলেন তিনি। অথচ আজ পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটাই তিনি। সময় সব বদলে দিবে। এটা সময়ের খেলা।
চলবে?
চলবে................
( বিঃদ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
গল্প: বিদেশিনী
#পর্বঃ০৬
লেখনীতে: Rifat Amin
.jpg)
0 Comments