নীল ওর ক্যাবিনে বসে কিছু ফাইল দেখছিল।এমন সময় দরজার সামনে থেকে কেউ বলে উঠলো
-- ম্যা আই কাম ইন স্যার?
নীল নিচের দিকে তাকিয়ে ফাইল দেখতে দেখতে ই বললো
-- ইয়েস কাম।
নীল ওর পুরো মনযোগ দিয়ে ফাইল দেখছিল যার ফলে ভেতরে কে আসলো তা খেয়াল ই করে নি।আনিকা প্রথমে জানত না এটা যে নীলের কোম্পানি। জানলে হয়ত এই জব টা করতো না। আনিকা ভেতরে এসে নীল কে দেখে অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে। নীল এখনও আনিকা কে দেখে নি।
-- সিট ডাউন প্লিজ।
আনিকা কিছু বলছে না। বলছে না বললে ভুল হবে কিছু বলার শক্তি টুকু পাচ্ছে না। যে নীলের কোন জব ছিল না বলে আনিকা ওকে ছেড়ে চলে গেছিল। আজ আনিকা সেই নীলের কোম্পানিতে জব করতে আসছে।
সামনের জন কিছু বলছে না দেখে নীল ফাইল টা পাশে রেখে
-- কি কাজে আসছেন তা বলেন। সময় নষ্ট করা আমি একদম পছন্দ করি না।
এটা বলে নীল সামনে তাকিয়ে আনিকা কে দেখে। নীল অবশ্য আনিকা কে এখানে দেখে একদমই অবাক হয়নি। কারণ কালকের ইন্টারভিউ তে কি কি হয়েছে তা নীল আগেই সিসিটিভি ফুটেজে দেখে নিয়েছে।এমনকি নীল ই ওর পিএ কে ফোন দিয়ে আনিকা কে জব টা দিতে বলেছিল। নীল চায় আনিকা দেখুক যাকে ও বেকার বলে অবহেলা করে ছেড়ে গেছিল। আজ সে কত বড় পজিশনে আছে। নীল অনেক স্বাভাবিক ভাবে
-- সো মিস আনিকা দাড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।
আনিকা নীলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে
-- নীল তুমি?
নীল একটু হেসে
-- আমার কোম্পানি,আমার ক্যাবিন আমি থাকবো না?
-- এটা তোমার কোম্পানি?
-- কেন আগে জানতেন না? যাই হোক এসব বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই। আপনার কাজ কি, কি তা বুঝে নিছেন তো?
আনিকা যতই নীল কে দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। কত পাল্টে গেছে নীল।
-- তুমি আমাকে আপনি করে বলছো?
-- আমি আপনার বস আর আপনি আমার অফিসের একজন কর্মচারি। এর বেশি তো আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে আমি আপনাকে তুমি করে বলার তো কোন প্রশ্ন ই আসে না। আর আমি যেহেতু আপনার বস। তাই আপনি ও আমাকে তুমি করে বলতে পারেন না। বস কে তুমি করে বলাটা মানায়?
-- একজন বস আর কর্মচারি! এর থেকে বেশি আমাদের মাঝে আর কোন সম্পর্ক ই নেই কি?
-- আছে কি নেই তা আমার থেকে ভালো আপনি বলতে পারেন মিস আনিকা।
-- তুমি কি সত্যি ই আগের সব কিছু ভুলে গেছ? আমাকে কি পুরো পুরি তোমার মন থেকে মুছে দিতে পারছ?
-- উফ ডোন্ট টক টু রাবিশ। চুপচাপ জব করতে হলে করো নয়ত যেতে পারো। কি মনে হয় তোমার আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এটা জেনে রাখ। তুমি যদি ভাবো আমি এখনও তোমাকে ভালোবাসি তাহলে ওটা শুধু মাত্র তোমার ভুল ধারণা। আমার বউ আছে সংসার আছে। আর আমি তনা কে খুব ভালোবাসি।এখন আমার সবটা জুড়ে শুধু তনার অস্তিত্ব আর কারো না।
নীলের কথা শুনে আনিকার চোখ ছলছল করছে। আনিকা চুপ করে নীলের সব গুলো কথা শুনছে
-- আমি জানি নীল তুমি তোমার ওয়াইফ কে নিয়ে অনেক সুখে আছো। সত্যি বলছি আমি যদি আগে জানতাম এটা তোমার কোম্পানি তাহলে আমি এখানে জবের জন্য আসতাম না। আমি চাই না আমার জন্য তোমার প্রব্লেম হোক। আমার উপস্থিতি তোমাকে বিরক্ত করুক। আমি এই জব ছেড়ে দিব।তুমি চিন্তা কারো না।
-- তোমার জন্য আমার প্রব্লেম হবে,তোমার উপস্থিতি আমাকে বিরক্ত করবে এসব বলতে তুমি কি বুঝাতে চাইছ??
তুমি কি সত্যি ই বুঝতে পারছো না। এই নীল আর আগের নীল নেই। এই নীল আর আগের নীলের মাঝে কতটা ডিফারেন্স তা কি সত্যিই তুমি দেখতে পারছো না?
আগে যে নীল ছিল সে আনিকা নামের মেয়েটি কে নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসতো।মেয়েটার একটু অবহেলা সহ্য করতে পারতো না। এমন কি ওই মেয়েটা কে ছাড়া বাঁচার কথা কল্পনা ও করতে পারতো না। বোকা ছিল আগের নীল যে ভাবত তার ভালোবাসা কোন দিনও তাকে ছেড়ে যাবে না।
আর এখনকার নীল আনিকা বলে কাউকে চিনে না। এই নীলের কাছে ওর বউ ওর পুরো পৃথিবী। আগের নীলের কাছে কিছুই ছিল না। কিন্তু এই নীলের কাছে বাড়ি গাড়ি সম্পত্তি টাকা পয়সার কোন কিছুর অভাব নেই।
আনিকা নীলের কথা শুনে কান্না করে দিছে। চোখের পানি গুলো কে কোন ভাবেই আটকে রাখতে পারছে না। আনিকা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে নীল ওর উপর অনেক অভিমান করে আছে। সময়ের সাথে সাথে অভিমান গুলো রাগ ও ঘৃনায় পরিণত হয়েছে। এখন আনিকার প্রতি নীলের কোন ভালোবাসা নেই যা আছে তা হলো রাগ আর ঘৃণা। নীল আবার ও বলতে শুরু করলো।
-- তুমি চাইলে ও এই জব ছাড়তে পারবে না। আমাদের কোম্পানির কিছু রুলস আছে। সব রুলস গুলো মধ্যে একটা হলো। কেউ জব নিলে সে এক বছর আগে কোন ভাবেই জব ছাড়তে পারবে না। যদি সে জব ছেড়ে দেয় তাহলে তার কোম্পানি কে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে জব ছাড়তে হবে।
আর আমার কোম্পানিতে তোমার জব করাটা আমার কাছে তেমন ম্যাটার করে না।বাকি পাঁচ জনের মত তুমিও আমার কাছে একরকম ই।
নীল আরো কিছু বলতে যাবে তখনই ওর ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তনা কল করেছে। নীল ফোন রিসিভ করে
-- হ্যা তনা বলো।
তনা ফোনের ওপাশ থেকে
-- নীল তুমি এখুনি বাসায় আসো।
-- কেন কি হয়েছে?
-- তুমি তারাতারি বাসায় আসো।
তনার হঠাৎ এমন ব্যবহারে নীল অনেক ভয় পেয়ে গেল। নীল ভাবছে তনার কিছু হলো না তো? তনা তো কখনও এমন করে না। আজ কি হলো ওর?
নীল আরো কিছু বলার আগেই তনা ফোন কেটে দিল। নীল আবার তনাকে ফোন করলো কিন্তু তনার ফোন সুইচ অফ বলছে। নীল আর কিছু না ভেবে দৌড়ে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে আসলো। আনিকা এখনও ঠিক আগের মতই দাড়িয়ে আছে। তনার ফোন আসাতে নীল কতটা ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। কতটা কেয়ার করে নীল তনার। আনিকার চোখ দিয়ে এখন ও অনবরত পানি পড়ছে। আনিকার চোখের সামনে নীল আজ অন্য কাউকে পাগলের মত ভালোবাসা তা আনিকা মেনে নিতে পারছে না। নীল খুব দ্রুত কার ড্রাইভ করে বাসায় চলে আসছে। বাসায় আসার পর দেখে মেইন ডোর খুলা।নীল ভিতরে গিয়ে তনা কে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তনার কোন সারা শব্দ নেই। সব গুলো রুমে খুঁজলো পরেও তনাকে পেল না। নীল চিৎকার করে তনাকে ডাকছে
-- তনা কোথায় তুমি??
তনা প্লিজ কথা বলো। কোথায় তুমি?
নীল আর কিছু ভাবতে না পেরে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। নীল তনার নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। এমন সময় নীলের ফোন বেঁজে উঠলে। কে ফোন দিয়েছে তা না দেখেই নীল ফোন রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে
-- এই নীল কোথায় তুমি। কখন আসতে বলেছি। এখন ও আসছো না কেন?
ফোনের ওপাশ থেকে তনার কথা শুনে নীল জীবন ফিরে পেল।নীল কিছুটা শান্ত হয়ে
-- আমি তো বাসায়। তুমি কোথায়?
-- বুদ্ধু তুমি বাসায় কি করো? ছাঁদে আসো তারাতারি।
-- আচ্ছা আসছি একটু ওয়েট করো।
নীল এক দৌড়ে ছাঁদে চলে যায়। গিয়ে দেখে তনা দাঁড়িয়ে আছে। নীল তনার কাছে গিয়ে তনাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ নীলের এমন কান্ড দেখে তনা একটু অবাক হয়।
-- কি হলো মি.নীল আমাকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরছেন কেন। আমি কি কোথাও হারিয়ে যাবো । নাকি আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি?
-- চুপ। একদম চুপ।তুমি একদম আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না। আমি তোমাকে কোথাও হারাতে দিব না।
তনা নীলে দিকে তাকিয়ে দেখে নীলের চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দুটো একটু একটু ফুলে ও গেছে।
-- এই নীল তুমি কি কান্না করছো?
-- না। কান্না করবো কেন? এসব রেখে এখন বলো ফোন দিয়ে এতো তারা দিছ কেন বাসায় আসার জন্য?
-- একদম কথা ঘুরাবা না। তুমি কান্না করছো। আমার সাথে মিথ্যা বলার চেষ্টা ও করবে না। কেন কান্না করছ তা বলো।
-- তুমি ফোনে এমন ভাবে বাসায় আসার কথা বলছিলে আমি ভাবছি তোমার হয়ত কিছু হয়েছে। আর বাসায় এসে ও তোমাকে কোথাও পেলাম না।
-- আর তাই তুমি আমাকে হারানোর ভয়ে কান্না করে দিছ তাই তো?
-- হুম।
--এতটা ভালোবাস আমাকে। আমি যদি কোথাও হারিয়ে যাই তখন?
নীল তনাকে ছেড়ে দিয়ে। তনার দিকে রাগী লুক নিয়ে
-- তোমার পা ভেঙ্গে রুমে বসিয়ে রাখবো।আর একবার এসব উল্টা পাল্টা কথা বললে এক থাপ্পড় দিয়ে সামনের দাঁত দুটো ফেলে দিব।তখন আর এসব কথা মুখে আসবে না।
নীল আজ তনাকে থাপ্পড় দেওয়ার কথা তে ও তনা কিছুই বললো। অন্য দিন হলে তো নীলের চৌদ্দ গোষ্ঠীর খবর নিয়ে ছাড়ত। তনা আজ নীলের প্রতি টা বকায় প্রতিটা শাসনে ওকে হারানোর ভয় দেখতে পারছে। নীলের চোখে তনাকে হারানো ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তনা কিছু না বলে অপলক দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষন নীলের দিকে তাকিয়ে থেকে নীলকে আবার জড়িয়ে ধরে।
নীল ও তনাকে ওর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।
দু'জনই কিছুক্ষন চুপ থাকে। তার পর নীল বলতে শুরু করে
-- আচ্ছা এখন বলো ফোনে এভাবে আমাকে ভয় দেখানো মানে কি ছিল?
-- আমি তোমাকে ভয় দেখাইছি? ভয় তো আমি নিজে পাইছি।
-- তুমি ভয় পাইছ?
-- হুম।
-- কিন্তু কেন?
-- দেখনা আমাদের ছাঁদে কত গুলো ফুল গাছ। কোথা থেকে আসছে এগুলো। কে এখানে এনে রেখে গেছে?
নীল তনার কথা শুনে। তনাকে ছেড়ে দিয়ে তনার দিকে তাকিয়ে
-- এই ফুল গাছ গুলো দেখে তুমি ভয় পাইছ?
-- হুম।
আমরা তো কাল বাসায় ছিলাম না। তখন কি কোন চোর আসছিল।আর চোর তো চুরি করতে আসবে। ফুল গাছ দিতে আসবে না। চোরই বা আসবে কি ভাবে বাসা তো বন্ধ ছিল।তাহলে কি এই গাছ গুলো ভুত পেত্নী এখানে রেখে গেছে?
-- তনা তুমি কি পাগল??
-- আমি পাগল হতে যাবো কেন? আর আমি যদি পাগল হতাম তাহলে পাবনা থাকতাম। তোমার বাসায় না।
-- তোমার মধ্যে একটু ও কমনসেন্স নেই। তুমি কি একবার ও আমাকে জিঙ্গেস করে দেখেছ এগুলো আমি আনছি কি না?
-- তুমি এগুলো আনবে কখন তুমি তো সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিলে।
-- জি না ম্যাম। আপনি যখন আপনার বাবার বাসায় গিয়ে আপনার ফুল গাছ গুলোকে দেখতে দৌড়ে আমাকে রেখে রুমে চলে গেছিলেন। তখন আমি বের হয়ছিলাম। আর তখনই এগুলো আনিয়েছি।
-- তাহলে আমাকে বলোনি কেন?
-- গাড়ি তে বলছিলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব?
-- হুম।
-- এটাই ছিল তোমার সারপ্রাইজ। কিন্তু আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার আগেই তুমি আমাকে আরো বড় সারপ্রাইজ দিয়ে দিয়েছ।
নীল আর তনার দিন গুলো এভাবেই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে কাটতে লাগলো। যতই দিন যাচ্ছে নীল আর তনার ভালোবাসা ততই গভীর হচ্ছে। নীল তো তনাকে না দেখে এক মূহুর্ত ও থাকতে পারে না। তনার একটু কিছু হলে নীল পুরো পাগল হয়ে যায়। এই তো সেদিন নীল অফিসে ছিল। কেন ই জানি ঐদিন নীলের কোন কিছু ভালো লাগছিল না। কোন কাজেই মন বসছিল না। বুকের মাঝে কেমন অজানা একটা ব্যথা অনুভব করছিল। বার বার মনে হচ্ছিল তনা ঠিক আছে তো। তনার কিছু হলো না তো। নীল আর অফিসে বসে থাকতে পারলো না। সব কাজ ফেলে রেখে বাসায় চলে আসলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলছে না। নীলের ভয় টা আরও বাড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজানো পরও যখন ভেতর থেকে তনার কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না। তখন নীল বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। নীল ভেতরে এসে দেখে তনা ফ্লোরে পড়ে আছে। নীল তনা বলে দৌড়ে এসে তনাকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেল।নীল কিছু ভেবে না পেয়ে ডক্টর কে ফোন দিয়ে আসতে বললো।
---------------------------
কিছুক্ষন পর,,,,,
ডক্টর তনার পাশে বসে তনাকে চেকআপ করছে। নীল তো পুরো পাগল হয়ে গেছে। যে ডক্টর তনাকে দেখছে ইনি নীল দের ফেমিলি ডক্টর। কারো কিছু হলে সব সময় ইনি ই চিকিৎসা করেন।নীল পুরো রুমে পায়চারি করছে আর ডক্টরের কাছে বার বার তনার কথা জিঙ্গেস করছে।
-- ডক্টর প্লিজ বলুন না তনার কি হয়েছে?
-- কাম ডাউন নীল। তোমার ওয়াইফের তেমন কিছু হয়নি। প্রেসার টা কমে গিয়েছিল তাই হয়ত মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
-- শুধু কি প্রেসার কমে যাওয়ার কারনে এমন হয়েছে নাকি সিরিয়াস কিছু। প্লিজ ডক্টর প্লিজ বলুন।
-- তেমন সিরিয়াস কিছু না। শুধু প্রেসার ই কম। আর তনার শরীর অনেক র্দুবল।মনে হয় খাওয়া দাওয়ার প্রতি একদম মনযোগ নেই। তুমি সারা দিন অফিসে থাকো।ওর বাসায় একা থাকে ঠিকমত খায় ও না মনে হয়। ওর সাথে কেউ একজন থাকা দরকার তাহলে ওর একাকিত্বটা কম হবে।
-- হুম ডক্টর। এখন থেকে তনার খাওয়ার প্রতি খুব নজর দিব।আর ওকে একা ও ছাড়বো না।
-- আচ্ছা নীল তনা কি কোন কিছু নিয়ে খুব বেশি টেনশন করে?
-- ডক্টর আপনি তো সব ই জানেন। তনার তো ঐ একটা বিষয় নিয়েই সকল টেনশন। কিন্তু কিছু দিন ধরে মনে হয় অন্য কিছু নিয়েও টেনশন করে।
-- আসলে তনা সারাক্ষণ বাসায় একা থাকে তো। তাই সারাক্ষণ শুধু এগুলো নিয়েই ভাবতে থাকে। তনার সাথে যদি কেউ থাকত তাহলে তার সাথে কথা বলতে পারত।বা ওর বেশি কিছু কাজ থাকলে। কাজ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তনার জন্য এটা সবচেয়ে ভালো হবে ও যদি কারো সাথে সব সময় থাকে কথা বলতে পারে।
আর নীল তুমিও তনাকে একটু সময় দিও।অনেক তো কাজ করেছ এখন একটু ওয়াইফের খেয়াল রাখ।
-- হুম ডক্টর আমি তনার খুব খেয়াল রাখবো।
-- আচ্ছা আজ তাহলে আমি আসি।
-- হুম চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
-- না তার দরকার হবে না। তুমি তনার পাশে থাকো।আমি আসি।
-- ধন্যবাদ ডক্টর।
ডক্টর চলে গেলে নীল তনার পাশে বসে। তনার হাত নীলের হাতে মুঠোয় নিয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তনার দিকে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তের মধ্যে নীলের চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল জমা হয়ে গেল। কিন্তু জলের কণা গুলো নীলের অনুমতি ছাড়া চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে না। তনা একটু একটু করে চোখ মেলছে। তনার জ্ঞান ফিরতে দেখে নীল বাম হাত দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে নিল।তনা নীল কে দেখে উঠতে চেষ্টা করলে নীল তনাকে বাঁধা দিতে শুয়ে থাকতে বললো। তনা শুয়ে শুয়েই নীলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো।
-- নীল তুমি এখানে। অফিস থেকে কখন আসছো?
আর কি হয়েছিল আমার। আমাকে এভাবে শুইয়ে রাখছো কেন?
-- চুপ একটা কথা ও বলবা না। কি হয়েছিল তোমার??
তুমি জানো না কি হয়েছিল তোমার?
না খেয়ে টেনশন করে নিজের কি অবস্থা করেছ একবার দেখ তো। প্রেসার লও মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলে। আমি বাসায় এসে দেখি তুমি নিচে পড়ে ছিলে।
তনা কিছু বলছে না কারণ তনা জানে এখন কিছু বলতে গেলেই নীলের বকা খেতে হবে। তাই তনা চুপ করে নীলের কথা গুলো হজম করছে।
-- কি হলো কিছু বলছ না কেন?
কত দিন ধরে এভাবে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো না?
এতো কিসের টেনশন তোমার। তুমি কি এটা বুঝ না তুমি ভালো না থাকলে যে আমি ও ভালো থাকি না। তুমি যে আমার ভালো থাকার মেডিসিন এটা তুমি কবে বুঝবে?
তনা এবার ও কিছু বললো না। শুধু নীলের দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে একটা হাসি দিয়ে নীলের বুকে মাথা রেখে আলতো করে নীলকে জড়িয়ে ধরলো। তনা মাঝে মাঝে এমন করে যার কারনে নীল তনাকে কিছুই বলতে পারে না। তনার মায়া মাখা মুখটা দেখে নীল সব কিছু ভুলে যায়।
-- তনা....?
-- হুম।
-- সারদিন বাসায় একা থাকতে তোমার ভালো লাগে?
-- ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। তুমি তো আর অফিস ফেলে রেখে আমার কাছে বসে থাকবে না।
-- তাই ভাবছিলাম তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য একজন লোক রেখে দিই?
-- একা একাই তো আমার ভালো লাগে। নিজের কাজ গুলো সেরে ছাঁদে ফুল গাছ গুলোর যত্ন নেই। মাঝে মাঝে টিভি দেখি। এভাবেই তো আমার সময় কেটে যায়।
-- পরেও এমন একজন যদি সব সময় তোমার সাথে থাকে যার সাথে তুমি কথা বলতে পারবে আড্ডা দিতে পারবে। তাহলে খারাপ হয় না তাই না?
-- হুম। তুমি যা ঠিক মনে করো।
-------------------------------------
নীল ওর স্টাডি রুমে বসে আছে। ফোন টা হাতে নিয়ে জাহিদ কে কল করলো। কিছুক্ষন রিং হওয়ার ওর ওপাশ থেকে জাহিদ ফোন রিসিভ করলে।নীল এপাশ থেকে বলতে শুরু করলো
-- জাহিদ আর্জেন্টলি নিউজ পেপারে কাজের লোকের জন্য বিজ্ঞাপন দেও। আমার বারো ঘন্টার মধ্যে একটা কাজের লোক চাই।
-- ওকে স্যার এখুনি দিচ্ছি।
নীল ফোন রেখে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তনা দাড়িয়ে আছে। নীল তনাকে ডেকে
-- তনা কি হলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।
-- না ভাবছিলাম তুমি কাজ করছো তাই তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।
-- ধুর কিসের কাজ। আমি তো শুধু কাজের লোকের জন্য জাহিদের সাথে কথা বলছিলাম।
-- তুমি বাসায় কাজের লোক রাখার জন্য এতো ব্যস্ত হলে কেন? আমার রান্না কি তোমার কাছে ভালো লাগে না?
-- আরে পাগলী তার জন্য না। তুমি বাসায় একা থাকো তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হয়।দেখলে না আজ কেমন একা বাসায় মাথা ঘুরে নিচে পড়ে ছিলে।
আমি যদি বাসায় না আসতাম তাহলে কেমন হতো?
-- নীল তুমি আমাকে এত ভালোবাসো কেন?
নীল তনাকে ওর কোলে বসিয়ে। আলতো করে তনার গালে হাত রেখে
-- তুমি যে আমার পাগলী বউ তাই তোমাকে এতো ভালোবাসি।
তনা মিষ্টি করে হেসে দিয়ে। নীলের নাক টেনে নিয়ে
-- তাই বুঝি মি.হাজবেন্ড?
-- হুম গো পাগলী বউ।
------------------------------
নীলের কথা মত বারো ঘন্টা হবার আগেই কাজের লোকের লাইন লেগে গেল।লাইন লাগার ই কথা দ্বিগুণ বেতন দিলে সবাই কাজ করতে চাইবে। সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি। অনেক জনের ভিতর থেকে জাহিদ কয়েক জন কে সিলেক্ট করে নীলের কাছে নিয়ে আসলো।নীল তাদের মধ্যে থেকে যে কোন একজন কে বেছে নিবে।
নীল দুই তিন জনের মধ্যে থেকে তনার বয়সী এক মেয়েকে কাজে রাখলো। মেয়েটা গ্রাম থেকে আসছে। খুব দরিদ্র পরিবারের। এবার এসএসসি এক্সাম দিতে পারেনি। বাবা মারা যাওয়ার কারনে মা তাকে নিয়ে লোকের বাসায় কাজে গেছে।
নীল আর তনা সোফায় বসে আছে আর মেয়েটা সামনে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা কে দেখে তনার খুব মায়া হচ্ছে। তনা মেয়েটা কে উদেশ্য করে জিঙ্গেস করলো
-- তোমার নাম কি?
-- আমার নাম লিনা।
-- ওহ। তুমি এত ছোট বয়সে লোকের বাসায় কাজ করতে আসছো।তুমি সব কাজ পারো?
-- হুম ম্যাডাম। আমি সব কাজ পারি। ছোট থেকেই মায়ের সাথে এটা সেটা করতে করতে সব শিখে গেছি।
-- তোমার পরিবারে কে কে আছে?
-- ম্যাডাম আমার পরিবারে শুধু আমি আর আমার মা। বাবা মারা গেছে আমি ক্লাস সেভেন এ থাকতে। বাবা মারা যাওয়ার পরও মা লোকের বাড়ি কাজ করে খুব কষ্ট করে আমাকে লেখা পড়া করিয়েছে। কিন্তু আমার এসএসসি পরীক্ষার কিছু দিন আগে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে যার কারনে আমার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। মার চিকিৎসার টাকার জন্য ই আমি শহরে কাজ করতে আসছি।
লিনার কথা শুনে তনা প্রায় কান্না করে দিল। ছোট একটা মেয়ে তার এখন হেসে খেলার বয়স। কিন্তু এই বয়সে সে মায়ের চিকিৎসা করার জন্য লোকের বাসায় কাজ করতে আসছে।
নীল তনার দিক লক্ষ্য করে দেখে তনা কান্না করে দিচ্ছে। তাই নীল আর কথা বাড়ালো না।
-- আচ্ছা আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। তোমার থাকা খাওয়া ফ্রি। আমি তোমার দু'মাসের কাজের বেতন এডভান্সড দিয়ে দিচ্ছি।
-- আচ্ছা স্যার।
নীল তনাকে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেল।
কিছু দিনের মধ্যেই লিনার সাথে তনার খুব ভাব হয়ে যায়। লিনা মেয়েটি খুব মিশুক। আর অনেক চঞ্চল। ঘরের সব কাজ খুব গুছিয়ে করতে পারে। তনার কথায় নীল লিনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। নীল এখন তনাকে রেখে অফিসে যেতে ভয় পায় না। তনা লিনার সাথে সময় কাটায়। হাসি ঠাট্টায় সারাটা দিন কেটে যায়।
এভাবে দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে যায়।
চলবে.....
গল্প: শুধু তুমি
পর্ব - ৩
লেখনীতে: Samira Afrin Samia & জেরিন_আক্তার_নিপা
0 Comments