Header Ads Widget

Responsive Advertisement

শুধু তুমি - শেষ পর্ব

নীল আমি কখনও মা হতে পারবো না।আমি তোমাকে কখনও বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারবো না। আমার জন্য তুমি কোন দিন বাবা ডাক শুনতে পারবে না।
কথা গুলো বলে তনা নীল কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো। তনা নীলের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। নীল রাগে চুপ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। নীলের অনেক রাগ হলে কোন কিছুর দিকে খেয়াল থাকে না। তনা কেঁদে কেঁদে আবার বলতে শুরু করলো।
-- আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। কিন্তু শুধু ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না। আমি মা হতে পারবো না। কোন দিন একটা বাচ্চার মুখ দেখতে পারবো না।তাই বলছি তুমি আরেকটা বিয়ে করো। আবার নতুন করে সব কিছু সাজাও। তোমার সংসার আলো করে ছোট একটা বাচ্চা আসবে। পুরো বাড়ি হেসে খেলে বেড়াবে। তোমাকে বাবা ডাকবে। দেখো তুমি অনেক খুশি থাকবে তাদের নিয়ে।
তনা আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু কান্নার কারনে আর বলতে পারলো না। নীল সব সহ্য করতে পারে কিন্তু তনার কান্না সহ্য করতে পারে না। তনা চোখে এক ফোঁটা জল নীল দেখতে পারে না। তনা কে এভাবে কাঁদতে দেখে নীল নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলো না। মুহূর্তের মধ্যে নীলের সব রাগ পানি হয়ে গেল।নীল তনার পাশে বসে তনার মাথা নীলের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে


-- তুমি আমার সুখের কথা ভাবছো। কিন্তু তুমি কি এটা জানো না আমার সব সুখ দুঃখ যে তোমাকে ঘিরে। তুমি মা হতে পারবে না তো কি হয়েছে। আমাদের বাচ্চার দরকার নেই। আমি বাবা ডাক শুনতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই। সারা জীবন আমার পাশে শুধুই তোমাকে চাই। আর কাউকে না। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি ভালো থাকবে? নাকি আমি নিজেই ভালো থাকবো বলো?
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের বাচ্চা নেই। এমন অনেক স্বামী স্ত্রী আছে যাদের বেবী হয় না। তাই বলে কি তারা একে অপরকে ছেড়ে চলে গেছে?
তোমার যদি একটা বাচ্চার খুব দরকার হয় তাহলে আমরা বাচ্চা এডাপ্ট করবো। পরেও তুমি এসব বলোনা তনা। তোমাকে ছাড়া যে আমার পৃথিবী অন্ধকার।
তনা নীলের বুকে মাথা রেখে সমানে কেঁদে যাচ্ছে। নীলের কথা গুলো শুনে যেন তনার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। কেঁদে কেঁদে হিচকি উঠে গেছে। তনার কান্না নীলের আর সহ্য হচ্ছে না।
-- তনা এখন কিন্তু আমার দৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। পরেও তুমি আমার সামনে কান্না করে যাচ্ছ।
তনা কিছুই বলছে না। শুধু কান্না করেই যাচ্ছে।
এবার নীল রেগে তনাকে বললো
-- ওকে তুমি এভাবে মানবে না তো। ঠিক আছে দাঁড়াও এখন আমি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেললে তখন তুমি সহ্য করতে পারবে তো?
নীল তনা কে রেখে উঠতে নিচ্ছিল। তনা নীল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। ওকে ছেড়ে নীল কে যেতে দেয় না। কিন্তু তনার কান্না ও থামে না। তনা কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো
-- তুমি আমাকে একা রেখে যেও না নীল। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমি আমার কাছেই থাক।
নীল তনার কথা শুনে একটু মুচকি হেসে তনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তনা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসেই নীলের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল। নীল তনাকে কোলে নিয়ে বেডে গিয়ে তনাকে শুইয়ে দিল।
-- পাগলী টা কে নিয়ে আমি কি করবো? কখন কি করে কি বলে কিছুই বুঝে করে না। মাঝে মাঝে এমন এমন কিছু করে বসে যাতে ও নিজেও কষ্ট পায় সাথে আমাকে ও কষ্ট দেয়।
নীল তনার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।নীল ভাবছে তনা আজ হঠাৎ এমন পাগলামি কেন করলো। তনা তো বাচ্চার কথা প্রায় ভুলেই গেছিল। অনেক দিন ধরে এসব কথা মাথায় আনে না। আজ কি এমন হলো যার জন্য তনা এমন করলো। তনা তো সারাক্ষণ লিনার সাথে থাকে। এসব বেপারে লিনা কিছু জানে কি?
লিনা কে এসব জিঙ্গেস করা টা কি ঠিক হবে? অনেক চিন্তা ভাবনা করে নীল নিচে গেল। নীল লিনা কে ডাকলে লিনা রুম থেকে বের হয়ে আসে
-- ভাইয়া আপু এখন কেমন আছে? তখন আপুর কি হয়েছিল?
-- কিছু হয়নি। এখন তনা ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা লিনা তোমাকে একটা কথা জিঙ্গেস করবো?
-- হ্যা ভাইয়া করো।
-- আচ্ছা লিনা তনার হঠাৎ করে বেবীর কথা মনে হলো কেন? না মানে ও কি কোথাও বের হয়েছিল। নাকি বাসায় কেউ বেবী নিয়ে আসছিল।
-- বাসায় তো কেউ বেবী নিয়ে আসেনি। তবে ভাইয়া
লিনা এটুকু বলে থেমে গেল।
-- তবে কি লিনা বলো?
তনা আর লিনা যে ঐ দিন বের হয়েছিল এটা তো তনা নীলকে বলতে বারণ করেছিল।
-- কি হলো লিনা বলো।
-- আসলে ভাইয়া। ঐ দিন আমার জ্বর আসছিল না। পরে আপু আমাকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে গেছিল।
-- কি?
-- হুম ভাইয়া।
-- কবে গেছিলে আমাকে বলোনি কেন?
-- আপু বারণ করছিল। তাই তোমাকে জানাই নি।
-- আচ্ছা পরে কি হলো?
-- ওখানে মেঘা আপু ও আসছিল। তনা আপু মেঘা আপুর ফোনে ওর বাচ্চার ছবি দেখে। আমরা তিন জন রেস্টুরেন্টে খেতে গেছিলাম। ওখানে তোমাকে দেখি। তুমি একটা মেয়ের সাথে বসে ছিলে।দুজন পুরুষ ও ছিল।
লিনার আর কিছু বলতে হলো না। এইটুকু তে ই নীল সব বুঝে গেছে। তনা ঐ দিন আনিকার সাথে নীল কে দেখছে তাই কিছু দিন ধরে তনা এমন করছে।
-- ভাইয়া আপু তোমাকে ওই মেয়েটার সাথে দেখে আসার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছে।
আজ আপুর সাথে বেবী নিয়ে কথা হওয়ার পর থেকেই আপু যে রুমে গেছে। আর বের হয়নি। এখন তো তুমি দেখলেই তুমি আসার পরে আপু কি করলো।
নীল লিনা কে থামিয়ে দিয়ে রুমে যেতে বললো। লিনা রুমে চলে যাচ্ছিল। রুমে যাওয়ার সময় আবার পিছনে ফিরে
-- ভাইয়া কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।
-- হুম।
-- আপুর কি হয়েছে?
নীল লিনার থেকে আর কিছু লুকালো না। লিনা কে বলে দিল তনা যে কোন দিন মা হতে পারবে না। তনা মা হতে পারবে না একথা শুনে লিনা থমকে গেল। লিনা ভাবছে বিকেলে তনার সাথে বেবী নিয়ে কথা বলাতেই হয়ত তনা এমন করেছে। লিনা কাঁদতে লাগলো।
-- ভাইয়া আমাকে হ্মমা করে দাও। আমি আপুর একথা জানতাম না। আমি না জেনেই আপুকে সব থেকে বড় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
-- এতে তোমার কোন দোষ নেই। তুমি শুধু শুধু হ্মমা চাইছো কেন?
অনেক রাত হয়েছে যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর লিনা তনার একটু খেয়াল রেখো কেমন?
-- হুম ভাইয়া।
পরের দিন নীল অফিসে ওর ক্যাবিনে বসে আছে। কোন কাজেই মন দিতে পারছে না। বার বার তনার চিন্তা মাথায় আসছে। নীল টাকা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সুখ কিনে এনে তনার পায়ের কাছে রাখতে পারবে। তনার সব দুঃখ কষ্ট দূর করতে পারবে। কিন্তু টাকা দিয়ে তনার এই কষ্ট কিভাবে দূর করবে। আল্লাহ নীল কে সব কিছু দিয়েছে। কোন কিছুর কমতি রাখেনি। কিন্ত আল্লাহ তো ওদের থেকে ওদের সবচেয়ে বড় খুশি আর সবচেয়ে বড় সুখ টা দূরে রেখেছে। একটা মেয়ে মা হতে পারবে না। তার কাছে এর থেকে বড় কষ্ট আর কি আছে?
তনার এমন অবস্থা নীল সহ্য করতে পারছে না।
তনা যে দিন জানতে পারছে ও মা হতে পারবে না। সেদিন থেকে তনা পাগলের মত করতে শুরু করে দিছিল। সারাদিন চিৎকার করে কান্না করতো। রুমে নিজেকে বন্দী করে নিয়েছিল। রুম থেকে বের হতো না কারো সাথে কথা বলতো না। মানসিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে গেছিল। নীল অনেক কষ্টে তনা কে এসব থেকে বের করে আনে। তনাকে শহরের নামি দামী কত ডক্টর দেখিয়েছে কিন্তু সবাই ই ব্যর্থ। আল্লাহ যা দেয় নি। ডক্টর রা তা কি করে দিতে পারবে। লাস্ট যে ডক্টরের কাছে গেছিল উনি অন্ধকারের মাঝে একটু আশার আলো দেখিয়েছিল। উনি তনার কিছু টেস্ট করিয়েছিল যার রিপোর্ট এখনও আসেনি। ওই টেস্ট এর রিপোর্ট গুলো আসলে ডক্টর কিছু বলতে পারবে। এখন সব কিছু আল্লাহর হাতে। নিশ্চয় আল্লাহ তনাকে এতো বড় শাস্তি দিবে না। তনা তো কারো কোন হ্মতি করেনি।

নীল আনমনে এসব কথা ভাবছে। হঠাৎ দরজায় কেউ এসে।
-- আসবো?
নীল চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে একটু স্বাভাবিক হয়ে
-- হুম আসুন।
বাইরে থেকে আনিকা নীলের ক্যাবিনে আসলো। নীল ঐ দিকে ফিরে আছে। আনিকা চেয়ার টেনে বসে। আনিকা নীলের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে
-- এই ফাইল টা তে তোমার সাইন লাগবে।
নীল ওপাশ থেকে আনিকার দিকে ঘুরে ফাইল টা হাতে নেয়। আনিকা খেয়াল করলো। নীলের চোখ লাল হয়ে আছে। গলার স্বর ও যেন কেমন শুনাচ্ছে।
-- নীল কি হয়েছে?
নীল আনিকার দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ফাইল দেখতে দেখতে
-- আপনি যে কাজে আসছেন ওই কাজ টা ঠিক মত করেন। কার কি হয়েছে না হয়েছে তা আপনার দেখার বিষয় না।
-- এমন করে কথা বলছো কেন? কি হয়েছে তা আমাকে বলতে তো কোন প্রব্লেম দেখছি না। আমাদের মাঝে আগে কি হয়েছে না হয়েছে তা ভুলে কি আমরা নতুন করে সব শুরু করতে পারি না? আমরা তো বন্ধু হতে পারি। আমি তোমার বন্ধু হয়েই থাকতে চাই এর থেকে বেশি কিছু না। তুমি কি আমার দিকে তোমার বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারো না?
এমনিতেই নীল তনা কে নিয়ে চিন্তিত। তার উপর আনিকার এসব কথা। নীলের কাছে জাস্ট অসহ্য লাগছে। নীল আনিকার সাথে এখন কোন কথা বাড়াতে চাচ্ছে না।
-- আপনি এখন যেতে পারেন। ফাইল টা দেখা শেষ হলে আমি আপনাকে ডেকে নিব।
আনিকা বুঝতে পারছে নীল কোন কিছু নিয়ে টেনশনে আছে। হয়ত তনার কিছু হয়েছে তাই নীলের মন ভালো নেই।
-- নীল তনার কি কিছু হয়েছে? বা তোমার সাথে কি কিছু নিয়ে তনার ঝগড়া হয়েছে?
আনিকার মুখে এসব কথা শুনে হঠাৎ করে নীলের রাগ উঠে গেল। কেন ই যেন হঠাৎ করে নীল নিজের রাগের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললো। নীল বসা থেকে দাঁড়িয়ে
-- মিস আনিকা আপনি এখানে কাজ করতে আসছেন নাকি কার পারসোনাল লাইফে কি সমস্যা হয়েছে তা জানতে আসছেন। আর আপনাকে কত বার বলতে হবে আমি আপনার বস। বস কে নাম ধরে ডাকা এটা কোন ধরনের ভদ্রতা? আপনি আমার অফিসে জব করেন। আপনার কাজ আমার অফিসের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু না আপনি তো দেখছি আমার পারসোনাল লাইফ সম্পর্কে ও জানতে আগ্রহী। আমার ওয়াইফের কিছু হয়েছে কি না। আমার ওয়াইফের সাথে কি আমার ঝগড়া হয়েছে এগুলো নিয়ে আপনার এতো মাথা ব্যথা কেন। কাজ করতে ভালো না লাগলে জব ছেড়ে দেন। অফিসে এসে আজেবাজে কথায় মাথা ঘামানোর তো কোন মানে নেই।
হঠাৎ করে নীলের এমন ব্যবহার দেখে আনিকা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। আনিকা কি এমন বলেছে যার জন্য নীল ওর উপর এতো রাগ দেখাচ্ছে। নীলের কথা গুলো শুনে আনিার চোখে পানি এসে গেল। না চাইতে ও আনিকা নীলের সামনে কান্না করে দিল। আনিকার কান্না দেখে নীলের আরো রাগ হচ্ছে।
-- চুপ করুন একদম কাঁদবেন না। আপনার মত মেয়েরা কান্না ছাড়া আর কি ই বা পারে। আপনাদের চোখের জল এতো সস্তা কেন। কথায় কথায় শুধু কান্না করা। কি ভাবেন একটু চোখের পানি ফেলে ছেলেদের মন গলিয়ে ফেলবেন। আপনার চোখের পানি দেখে আমার মন গলবে না। তিন বছর আগে যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলেন তখন তো আমার জন্য আপনার এতো মায়া হয়নি। আজ কেন এতো মায়া দেখাচ্ছেন? আমি আমার ওয়াইফ কে নিয়ে সুখে সংসার করছি এটা আপনি দেখতে পারছেন না। ভেবে ছিলেন আপনি চলে গেলে হয়ত আমি আমার লাইফে সামনে এগুতে পারবো না?
এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি তনা কে নিয়ে অনেক হেপি আছি। তনা আমার পৃথিবী তনা ই আমার সব।
আনিকা কাঁদতে কাঁদতে
-- নীল তুমি কোথায় থেকে কোথায় চলে যাচ্ছ? আমি কিন্ত এসব কিছু মিন করে কথা গুলো বলিনি। তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। কথা ও কেমন শুনাচ্ছিল। তাই ভাবলাম তোমার হয়ত কিছু হয়েছে।
বিশ্বাস করো নীল আমি মন থেকে চাই তুমি খুশি থাকো। আমি তোমার হাত ধরে রাখতে পারিনি এটা আমার দূর্ভাগা। তনা সত্যিই অনেক ভাগ্যবাতী যার জন্য তোমাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে। আমি তো নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে পারিনি।আমি জানি একটা সংসার ভাঙ্গার কষ্ট কতটা। তাই আমি চাই না আর কোন মেয়ের সংসার ভাঙ্গুক। জাস্ট একজন ফ্রেন্ড এর দাবি নিয়ে জানতে চাইছিলাম তনার সাথে তোমার কিছু হয়েছে নাকি।
আনিকা নীলের ক্যাবিন থেকে বের হয়ে গেল। আনিকা আর এক মিনিট ও অফিসে দাঁড়ালো না। সোজা বাসায় চলে গেল। আনিকা চলে যাওয়ার পর নীল ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো। নীল কি করলো এটা। নীলের সব কষ্ট, রাগ, খোব আনিকার উপরে ঝাড়লো।আনিকা কখনও নীলের খারাপ চায় না এটা নীল ভালো করেই জানে। পরেও অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আনিকা কে। তনা ভালো না থাকলে নীলও ভালো থাকে না। তনার চোখের পানি দেখলে নীলের পুরো পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। আজ নীল তনাকে হাসি খুশি রাখতে পারছে না আর তাই হয়ত নীল নিজের অজান্তে আনিকা কে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। নীল কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছে। হঠাৎ নীলের ফোন বেঁজে উঠল। নীল ফোন রিসিভ করে কানে নিলে ওপাশ থেকে
-- এই নীল তারাতারি বাসায় আসো।লিনার আম্মু অসুস্থ লিনা বাড়ি যাবে ওর আম্মু কে দেখতে।
-- আচ্ছা আসছি।
নীল লিনা কে নিজেদের গাড়ি করে গ্রামে পাঠিয়ে দিল। তনার লিনা কে যেতে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু লিনার মা অসুস্থ তাই লিনার যেতেই হবে।
রাতে নীল কপালের উপর হাত রেখে বেডে শুয়ে আছে। তনা নিচে থেকে রান্না শেষ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে উপরে রুমে আসলো।তনা রুমে এসে দেখে নীল শুয়ে আছে।
-- নীল এখন শুয়ে আছো যে। শরীর খারাপ?
নীল তনার কথা শুনে উঠে বসলো
-- না। শরীর খারাপ না।
-- তাহলে কি মন খারাপ?
-- না।
তনা নীলের পাশে বসে
-- শুধু শুধু আমার কাছে কেন মিথ্যে বলছো?
নীল তনার থেকে আর লুকাতে পারলো না। তনা কে বলেই দিল আজ অফিসে আনিকার সাথে যা যা করেছে নীল। তনা সব কিছু শুনে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে।
-- তুমি আনিকার সাথে এমন ব্যবহার না করলেও পারতে। আনিকার তো কোন দোষ নেই শুধু শুধু ওকে এতো গুলো কথা কেন শুনালে। আল্লাহ আমাকে মা হওয়ার হ্মমতা দেননি। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্য ই করেন। আমি একথা মাঝে মাঝে ভুলে গিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসি। আমি নিজও কষ্ট পাই আর তোমাকে ও কষ্ট দেই। আর তুমি সেই কষ্ট অন্যের উপর ঝাড়।
নীল তনার হাত শক্ত করে ধরে
-- তনা!
-- হুম।
নীল কিছু বললো না। তনা ও কিছু বলছে না। দু'জনই প্রায় অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। তনার কষ্ট নীলের সহ্য হয় না। কিন্তু তনা কষ্ট দূর করার মত হ্মমতা নীলের নেই। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর তনা বলে উঠলো
-- নীল তুমি আনিকার কাছে হ্মমা চেয়ে নিও। আনিকা কে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি। কারো মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ নারাজ হন।
নীল চুপ করে তনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তনা নীলকে বললো
-- এভাবে কি দেখছো? আমাকে কি আগে কখনও দেখোনি? আজ কি নতুন দেখছো?
রান্না করে আসছি। চলো খাবে।
-- হুম।
পরের দিন নীল আর অফিসে যায়নি। লিনা বাসায় নেই তনা একা থাকবে এটা ভেবে লীন তনার সাথে বাসায় থেকে গেল। নীল জাহিদের কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারছে। আনিকা ও অফিসে আসেনি। না আসার ই কথা। এতো অপমান সহ্য করে কোন মানুষ ই জব করবে না। আনিকা ও হয়ত আর জব করবে না। পরেও নীল আনিকার কাছে গিয়ে ওর কাছে হ্মমা চাইবে।

তনার রুটিন চেকআপ এর জন্য নীল তনাকে নিয়ে হসপিটালে যায়। ডক্টর তনার চেকআপ করলে তনা ডক্টরের ক্যাবিন থেকে বের হয়ে চলে আসে। ডক্টরেরে সেই এক কথা বার বার শুনতে তনার একটু ও ভালো লাগে না। তনা ক্যাবিন থেকে চলে যাওয়ায় ডক্টর ও তেমন কিছু মনে করেন নি।কারণ ডক্টর তনার মনের অবস্থা খুব ভালো করেই জানে। নীল ডক্টরের সাথে কথা বলছে। তনা বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা ওর মা'কে নিয়ে ডক্টরের কাছে আসছে। কিছু দিন ধরে আনিকার মায়ের প্রেসার একটু বেশিই বেড়েছে। আনিকা তনা কে দেখে ও তনার সাথে কথা বলতে গেল না। আনিকা তনার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। তনা আনিকা কে দেখে ফেলে। তনা আজ নিজে থেকেই আনিকার সাথে কথা বললো।
-- আনিকা।
আনিকা ভাবতে পারেনি তনা ওর সাথে নিজে থেকে কথা বলবে।
-- তনা তুমি এখানে? কি হয়েছে শরীর সুস্থ আছে তো?
-- হুম।
-- তুমি একাই এসেছো, নীল আসেনি তোমার সাথে?
-- নীল ডক্টরের ক্যাবিনে বসে আছে। আমার ভালো লাগছিল না তাই বাইরে চলে আসছি।
-- ওহ।
-- তুমি এখানে কাকে নিয়ে আসছো? একাই?
-- না আমি মা'কে নিয়ে এসেছি।
-- কি হয়েছে আন্টির?
-- তেমন কিছু হয়নি। প্রেসার টা একটু হাই হয়ে গেছে।
-- ওহ।
আর কি বলবে কেউই ভেবে পাচ্ছিল না। তাই দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে। তনা বলতে লাগলো
-- আনিকা ঐ দিনের জন্য সরি। নীল তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। সরি টা ও নীলের ই বলা উচিত ছিল। যাই হোক ওর হয়ে আমি তোমাকে সরি বলছি। তুমি ওকে হ্মমা করে দিও।
-- আরে না সরি বলতে হবে না। নীল ও রকম ই।
-- হুম। তুমি তো জানোই নীল ওরকম ই। নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। তুমি তো নীল কে আমার আগে থেকেই চিনো। তুমি ওর কথায় কষ্ট পেয় না।
-- কোন ব্যাপার না। আমি নীলের কথায় কিছু মনে করিনি আর কষ্ট ও পায়নি। তোমার সরি বলা লাগবে না।
-- তুমি তো এখন এখানেই থাকো। তাহলে একদিন আমাদের বাসায় উঠতে পারো না?
সময় করে একদিন আমাদের বাসায় যেও। যদি নীল কে আর আমাকে তোমার ফ্রেন্ড মনে করো।
আনিকা তনার ব্যবহার দেখে অনেকটা অবাক হচ্ছে। নিজের হাজবেন্ডের এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে কেউ এতো সুন্দর করে কথা বলবে, এমনকি বাসায় ও যেতে বলবে তা আনিকার জানা ছিল না।
আনিকা মনে মনে বলছে
-- তনা মেয়েটা অনেক ভালো। নীলের জন্য তনা ই একদম পারফেক্ট। নীলের তনা কে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সত্যি ই অনেক ভালো হয়েছে। তনা এতো টা মিশুক।সবাই কে মুহূর্তের মধ্যে ই আপন করে নিতে পারে। তাই তো নীল তনা কে এতটা ভালোবাসে।
আনিকা কিছু বলছে না দেখে তনা আবার বললো
-- কি হলো যাবে না আমাদের বাসায়?
-- হুম। সময় পেলে একদিন অবশ্যই যাবো।
আচ্ছা তনা এখন যাই। মা ভেতরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-- আচ্ছা।
আনিকা হসপিটালের ভেতরে চলে গেল। নীল যে ডক্টরের ক্যারিনে বসে ছিল। আনিকা সেখান দিয়েই যাচ্ছিল।হঠাৎ আনিকার চোখ নীলের দিকে চলে যায়।
-- তনার সাথে তো কথা হলো। কিন্তু তনা কে এটাই জিঙ্গেস করলাম না। ডক্টরের কাছে কেন আসছিল। তনার কিছু হয়েছে নাকি নীলের?
আনিকা ক্যাবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে এগুলো ভাবছে। তখনই নীল ক্যাবিন থেকে বের হলো। অফিসে ঐ দিনের ঘটনার পর আনিকা নীলের সামনে যেতে চায় না। তাই আনিকা একটু সাইডে চলে গেল। যাতে নীল আনিকা কে দেখতে না পারে।
নীল চলে যাওয়ার পর আনিকা ক্যাবিনের ভেতরে গেল। আনিকা ডক্টর কে আগে থেকেই চিনে তাই নীল কেন আসছিল তা জানতে তেমন প্রব্লেম হবে না।
-- আরে আনিকা তুমি। আসো তা কি জন্য আসা হলো?
-- তেমন কিছু না। ডক্টর মা'কে নিয়ে আসছিলাম।
-- ওর তা আন্টি কেমন আছেন?
-- ভালো ই। আচ্ছা নীল কেন আসছিল একটু বলবেন প্লিজ।
-- তুমি মি.নীল কে চিনো?
-- হুম। ও আমার ফ্রেন্ড। কিন্তু এখন তেমন যোগাযোগ নেই।
ও কেন আসছিল? ওর কি কিছু হয়েছে?
-- নীলের কিছু হয়নি। নীল ওনার ওয়াইফ তনা কে নিয়ে আসছিল।
-- তনাকে নিয়ে? কি হয়েছে তনার?
-- তুমি নীলের ফ্রেন্ড। তাহলে তো তনাকে চিনো ই। তনা মেয়ে খুব ভালো।
-- হুম। কিন্তু কি হয়েছে তনার?
-- জানো মাঝে মাঝে তনার জন্য অনেক খারাপ লাগে। এমন একটা হাসি খুশি চঞ্চল মেয়ে কখনও মা হতে পারবে না। এটা ভেবেই কেমন লাগে।
-- কি! তনা মা হতে পারবে না?
-- দেখো সব কিছুই তো আল্লাহ হাতে। মানুষ তো শুধু চেষ্টা করতে পারে। অনেক চেষ্টার পরেও তনার একটা বেবী হলো না। নীল তনাকে নিয়ে অনেক ডক্টরের কাছে গেছে। শুনেছি একজন ডক্টর নাকি বলেছে তনার মা হবার ১০% চান্স আছে। তবুও সিউর হয়ে কিছু বলতে পারছে না।
তনা এসব নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকে শরীরের একদম খেয়াল রাখে না। খাওয়ার দাওয়ার ও কোন ঠিক নেই। তাই নীল ওকে নিয়ে রুটিন চেকআপ করানোর জন্য আসছিল।
আনিকা ডক্টরের ক্যাবিন থেকে বের হয়ে গেল।
-- তনার সাথে কেন এমন হলো। তনা মেয়েটা কত ভালো আল্লাহ তনার সাথেই কেন এমন করলো। নীল তনাকে নিয়ে টেনশনে থাকে তাই তো নীল ঐ দিন আমার সাথে এমন করেছে। আমি নীলকে বুঝতে পারিনি। নীল নিজের ভেতরে কতটা কষ্ট চেপে রেখেছে। আর তনা? তনা কে দেখে তো আমি এসব কিছু বুঝতেই পারিনি।
আনিকার তনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু আনিকা ই বা কি করবে। আনিকার ও তো কিছু করার নেই।
প্রায় পনেরো দিনের মত কেটে গেল। লিনা এখনও গ্রাম থেকে আসেনি। নীল মাঝে মাঝে অফিস কামাই করে তনা কে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে বের হয়। নীল অফিসে চলে গেলে তনা বাসায় একা একা ই দিন কাটায়।
নীল অফিসে কাজ করছে। এমন সময় নীলের ফোন বেঁজে উঠলে নীল ফোন রিসিভ করে কানে নেয়। ফোনের ওপাশের লোকের কথা শুনে নীল সাথে সাথে অফিস থেকে বের হয়ে যায়।
সন্ধ্যার দিকে আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। প্রচুর বাতাস বইছে। তনার মন ভালো থাকলে তনা এখন ছাঁদে গিয়ে প্রকৃতির এই পরিবেশ টা কে উপভোগ করতো। কিন্তু আজকাল তনার মন ভালো থাকে না। তাই কোন কিছুই তনার কাছে ভালো লাগে না। ছাঁদে কাপড় শুকাতে দিছিল। ওগুলো আনতে ও ইচ্ছে হচ্ছে না। দেখতে দেখতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নীল ও বাসায় এসে গেছে। মেইন ডোর খুলা ই ছিল। নীল রুমে এসে দেখে। তনা বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে।
-- তনা বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
-- হুম।
-- তুমি রুমে বসে আছো যে। আজ বৃষ্টিতে ভিজবে না?
-- না। ভালো লাগছে না।
নীল ভালো করেই জানে তনা কেন বৃষ্টি তে ভিজতে গেল না। কিছু দিন ধরেই তনা এমন করছে রুম থেকে বের হয় না। ভালো করে কথা বলে না।সারা দিন মন খারাপ করে রুমে বসে থাকে। আজ ও তনার মন খারাপ। মন খারাপ না থাকলে কি তনা বৃষ্টি তে ভিজতো না?
নীল তনার পাশে বসে তনার হাতে হাত রাখে। তনা নীলের দিকে তাকাতেই চোখ বেয়ে পানি আসছিল।তনা নীলের কাঁধে মাথা রাখে। আর সাথে সাথেই তনার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
নীল তনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিছুক্ষন চুপ থাকে। বাইরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি বেগ ও বেড়ে গেল। নীল তনার পেটে হাত রাখলো।
-- তনা আমাদের প্রথম বেবী কি হবে। ছেলে নাকি মেয়ে?
নীলের এ কথা শুনে তনা নীলের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিল। নীল তনার চোখে পানি মুছে দিয়ে
-- এই পাগলী কাঁদছো কেন? আজকের পর থেকে যেন তোমার চোখে আর এক ফোঁটা পানি ও না দেখি। অনেক কেঁদেছ আর কাঁদতে হবে না। আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন তনা।
তনা নীলের দিক অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
-- আজ অফিসে ডক্টরেরে ফোন এসেছিল। উনি আমাকে উনার চেম্বারে ডেকেছিলেন। তোমার রিপোর্ট গুলো আনতে। রিপোর্ট দেখার পর ডক্টর বললো তুমি মা হতে পারবে তনা।
তোমার কোল জোরে ছোট একটা তনা আসবে। আমাদের বেবী হবে তনা। আমাদের বেবী, যে তোমাকে মাম্মাম আর আমাকে পাপা ডাকবে।
তনা নীলে কথা গুলো শুনে কিছু বলছে না। শুধু তনার দু'চোখ বেয়ে অঝোর দ্বারায় পানি পড়ছে। নীল ও তনাকে কাঁদতে বাঁধা দিচ্ছে তনা। এ কান্না যে সুখের কান্না। না পাওয়া কোন কিছু কে অনেক কষ্ট পাওয়ার কান্না। নীল তনাকে কোলে তুলে নিয়ে।
-- চলো আজ দুজন এক সাথে ছাঁদে গিয়ে বৃষ্টি তে ভিজবো। অনেক দিন হয়ে গেল দুজন এক সাথে বৃষ্টি তে ভিজি না।

চলবে.....


গল্প: শুধু তুমি 

পর্ব - ৭ (শেষ পর্ব)

লেখনীতে: Samira Afrin Samia & জেরিন_আক্তার_নিপা

Post a Comment

0 Comments