অপরার শেষকৃত্য হওয়ার পর চোখের জল মুছতে মুছতে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় অরুনিকা। পৃথিবীর বাস্তবতা এতটা নিষ্ঠুর কেন! মনে মনে প্রশ্ন করে ভগবান এর কাছে।
—ডক্টর মৃণাল এসে পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, আই' অ্যাম সরি। আজকের বিহেভিয়ার এর জন্য আমি খুব লজ্জিত।
—চোখের জল মুছতে মুছতে অরুনিকা বলল, সরি বললেই কি সব ঠিক হয়ে যায় ডক্টর মৃণাল? সরি বললেই কি অপরারা মৃত দেহের সাথে করা অন্যায় মাফ হয়ে যাবে?
—ওই বেচারি তো মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে যমরাজের কাছে চলে গেছে। পৃথিবীতে তখন শুধু ওর দেহটায় ছিল। এই মুখোশধারী সমাজ ওর দেহটাকেও লাঞ্ছিত করতে পিছুপা হলো না। সারাজীবন সমাজের কাছে শুধু লাঞ্ছনা পেয়ে গেছে৷ সে কি জানত মৃত্যুর পরেও দেহ তার যোগ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে!
—তপন গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অরুনিকা তপন এর দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর নিরবে গাড়িতে উঠতে নিয়ে পেছন ফিরে মৃণাল'কে বলল। দোষ না থাকা স্বত্বেও অনেক কথাই শোনালাম। মাফ করে দিবেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, আমার অপরার শেষকৃত্যে এগিয়ে আসার জন্য।
—গাড়িতে বসে তপন এর সাথে চলে যায় অরুনিকা।
—রণক অপরার দেহ ভস্ম নিয়ে এসে অরু অরু বলে ডাকে।
—ডক্টর মৃণাল এগিয়ে এসে অরুনিকার চলে যাওয়ার কথা জানায় রণক'কে।
—অরুর চলে যাওয়ার কথা শুনে রণকের চোখ জলে ভরে ওঠে। কিছু না বলেই কেন চলে গেলে! তুমি কি সত্যি এখন এই সমাজের একজন হতে চলেছ অরু!
—অরুর চলে যাওয়া নিয়ে ভেবে বিষন্ন মনে যখন হোটেলে ফিরে যাচ্ছে রণক। তখন ফোনে মেসেজ আসে।
মেসেজ..
(অপরার দেহ - ভস্ম আগামীকাল নিতে আসব।)
—অ্যম্বুলেন্স এর ড্রাইভার মোটা অংকের টাকা পাওয়ার পরও পতিতা-দের শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করে কষ্ট পেয়ে চলে গেল।
—সবাই নিজ নিজ ভগ্নহৃদয় নিয়ে চলে যায় যার যার পথে। কেউ লক্ষই করে না মৃণাল তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে তার জলে ভরা। অপরার শেষ পরিণতি দেখে তার বুকের ভেতরের পুরনো জখম যেন তাজা হয়ে উঠেছে। হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার দিয়ে একটা নাম ব'লে উঠে। মৃধাআআআআআআআআআআআ।
**********
—বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় অরুনিকা আর তপন এর। গাড়ি থেকে অরুনিকা নেমে যাওয়ার সময় তপন'কে জিজ্ঞেস করলো। অপরার মৃত্যুর আগ মূহুর্ত থেকে ওর শেষকৃত্যের এই পুরো সময় টা আপনি কোথায় ছিলেন?
—একটা ইম্পরট্যান্ট কল এসেছিল। তারপর ওই কাজে বেড়িয়ে পড়ি।
—তজশ্রী ব্যানার্জি নিজের বৌমার ভেজা শরীর দেখে দৌড়ে আসে। কি হয়েছে বৌমা? তুমি ভিজলে কি করে? তপন দ্রুত পায়ে অরুনিকা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আরেহ আর বলিও না মা। ওদের কত নিয়ম-কানুন। তুুমি দেখলে অবাক হ'য়ে যেতে।
—তপনের এমন মিথ্যার উপর মিথ্যা বলা দেখে এখন অরুনিকার মনে প্রশ্ন উঠে। মিথ্যার উপর নতুন জীবন শুরু করা আদৌ ঠিক হবে কি না!
—তজশ্রী ব্যার্নাজি অরুনিকার হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, বিয়ে লগ্নের আর বেশি সময় নেই। ঘন্টা তিনেক পরেই বিয়ের লগ্ন। তাড়াতাড়ি তুই নিজেও তৈরি হয়ে নে তপন।
—তিনতলা বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। মানুষের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে নেয় তার। তাই বাইরে বাগানে চলে আসে অরুনিকা। বাগানের গাছগুলোতে লাগানো হয়েছে ফেইরি লাইট। ফেইরি লাইট এর আলোয় অপরূপ সুন্দর দেখতে লাগছে অরুনিকা'কে। অফ-হোয়াইট লেহেঙ্গা পড়েছে অরুনিকা।
—দূর থেকে দাঁড়িয়ে অরুনিকা'কে দেখছে রণক। খোঁজ করতে করতে শেষ পযন্ত তপন এর বাড়ি পযন্ত সে পৌঁছে গেছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে রণক। রণক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অরুনিকার বিয়ের সাজ। কোটরাগত টানা চোখে আজ মোটা করে লাগানো কাজল মায়াবী করে তুলেছে তাঁকে। পাতলা ঠোঁটে পড়া মিষ্টি রঙের লিপস্টিক। গলায় উঠেছে ডায়মন্ড এর হাড়। উন্মুক্ত সাদা ধপধপে পিঠের মাঝে চুল কারলি করা মাঝ বড়াবড় সিম্পল বেনীর মাঝে ফুল গুঁজে দেওয়া নববধূ অরু।
—অরুনিকার কাছে যেতে নিয়েছে রণক ঠিক তখনি তপনের কাকীমা এসে অরুনিকা'কে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। অনেকটা সময় ধরে অরুনিকা চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে।
—ওগো অরু
পৃথিবীর এই সময় সাক্ষী আমার প্রেমময় হৃদয়ে কোটরে তোমার বাস। এই জীবন সংসার তুমি বিনা শূন্যই হৃদয়ে বেঁচে থাকার নেই কোন ইচ্ছে। আজি তোমার জীবনে শুভক্ষণে আমি নিব চিরবিদায়। যাবার আগে করি আশীর্বাদ, পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার কোলে আসুক নেমে। দূর থেকে দেখব আমি ওগো আমার গোপন অন্তহীন প্রবাহীনি।
—ভগ্ন হৃদয়ে চলে যেতে নিয়েছে রণক তখন ধাক্কা লাগে ডক্টর অদিতি সাথে।
—ধাক্কায় হাত থেকে গিফট বক্স পড়ে যাওয়ায় তুলতে তুলতে অদিতি বলল, অসভ্য লোক! দেখে চলতে পারেন নাআআআ। গিফট তুলে সামনে তাকিয়ে রণক'কে দেখে অবাক হয় ডক্টর অদিতি। আপনি এখানে কি করছেন মিস্টার রণক?
—অদিতি'কে দেখে রণক নিজেও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আপনি এখানে কি করছেন?
—আমি এখানে কি করছি মানে? আমার বান্ধবীর আর তার বড় ভাইয়ের বিয়ে আজ।
—ডক্টর অদিতির কথা শুনে গলা শুকিয়ে যায় রণকের। রণক কি বলবে ভেবে পায়না। অশুভ কিছু ঘটতে চলছে এই ভেবেই বুক কেঁপে ওঠে।
—ডক্টর অদিতি রণকের উত্তর এর অপেক্ষা না করেই ভেতরে চলে যায়। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তারি পেশায় সময় পাওয়া খুব মুশকিল।
— পাশাপাশি দুই মন্ডপে সাত পাকে ঘুরতে শুরু করেছে শেফালী ও অভিনব আর অরুনিকা ও তপন।
প্রথম পাকের প্রথম প্রতিজ্ঞা: তপন, অভিনব ও শেফালী, অরুনিকা চায় বাড়িতে কখনও খাদ্য বা ধন সম্পত্তির অভাব যেন না হয়। তপন অরুনিকা'কে খুশি রাখার এবং ওর দায়িত্বপালনের প্রতিজ্ঞা করে।
দ্বিতীয় পাকের, দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা: তপন, অভিনব ও শেফালী, অরুনিকা দুজনে দুজনকে সমর্থন করার এবং শরীর-মনে একাত্ম হওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।
তৃতীয় পাকে,তৃতীয় প্রতিজ্ঞা: তপন, অভিনব ও শেফালী, অরুনিকা ধন সম্পত্তি সামলে রাখার ও বৃদ্ধি করার প্রতিজ্ঞা করে। তারা প্রতিজ্ঞা করে সন্তানের সঠিক দেখাশোনা করবে।
একে একে সব পাক শেষ সপ্তম পাকে, সপ্তম প্রতিজ্ঞা: তপন, অভিনব ও শেফালী, অরুনিকা শেষ প্রতিজ্ঞা করে এই সম্পর্ক যেন চিরস্থায়ী ও মজবুত হয় তার জন্য দুজনেই সচেষ্ট থাকবে।
সাত পাক শেষে সিন্দুর দানের সময় যেইনা অরুনিকার ঘোমটা সরিয়ে সিঁদুর পড়াতে নিয়েছে তপন আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার দিয়ে মন্ডপের উপর উঠে আসে অদিতি।
এখানে এই সব কি হচ্ছে! আমি জানতে চাই কি হচ্ছে এই সব। শেফালীর সিঁদুর দান হ'য়ে যায়। সে মন্ডপ থেকে উঠে বান্ধবী অদিতির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে। কি হচ্ছে অদিতি। বিয়ের মাঝে হটাৎ সিনক্রিয়েট কেন করছিস?
—সিরিয়াসলি শেফালী! আমি সিনক্রিয়েট করছি! একটা প..
—অদিতির কথা শেষ না হতেই তপন এসে হেঁচকা টানে অদির হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে চাপা কন্ঠে বলে, দেখো অদিতি আমার মেটারে তুমি ইন্টারফেয়ার করিও না প্লিজ। তুমি যা জানো তা নিজের মাঝেই রাখো।
—হৈচৈ এর আওয়াজ পেয়ে ভেতর থেকে তজশ্রী ব্যার্নাজি ছুটে এসেছে। কি হচ্ছে এখানে? কি হয়েছে অদিতি? তুমি বিয়ের মাঝে এই ভাবে বাঁধা কেন সৃষ্টি করলে।
—এতক্ষনে অরুনিকা নিজেও উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখে তার নির্লিপ্ততা। অন্য কেউ হইলে হয়তোবা চোখে এতক্ষণে সত্য প্রকাশের ভয়ের ছাপ ফুটে উঠতো। কিন্তু অপরার মৃত্যুর পর সব কিছুই যেন অরুনিকার কাছে অর্থহীন।
—যে নিজে একজন পতিতা'কে বিয়ে করতে চায় সেখানে অদিতির বলার কিছু থাকতে পারে না। তপনের রিকুয়েষ্ট এর পর অন্য কোনদিন হইলে হয়তোবা অদিতি মুখ বন্ধ রাখত। কিন্তু অরুনিকার আজকের বিহেভিয়ার এর যোগ্য উত্তর দেওয়ার এই সুযোগ সে হাত ছাড়া করতে চায় না। তাই অরুনিকার চোখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল। একজন পতিতার সাথে বিয়েতে, সামাজের একজন দায়িত্বশীল নারী হিসেবে এই বিয়েতে বাঁধা দেওয়া আমার কর্তব্য। এই মেয়ে একজন পতিতা। অদিতির মুখের কথা শুনে, কানে হাত দিয়ে তজশ্রী ব্যার্নাজি বলে, হায় রাম এই মেয়ে কি বলছে এই সব। রাগে গরগর করতে করতে তজশ্রী এসে থাপ্পড় মারে অদিতি'কে।
তোমার কি মতিভ্রম হয়েছে বেয়াদব মেয়ে। লতিকার নামে এতো বড় অপবাদ দাও কোন সাহসে! বেড় হও আমার বাড়ি থেকে।
—অদিতি উচ্চ শব্দে খিলখিল করে হাসে। আপনি কাকে লতিকা বলছেন মাসি? এই মেয়ের নাম রিতিকা স্যানাল, রিতিকা রয়, অরুনিকা নামটা আজকেই জানতে পারলাম। যখন এই মেয়ে অন্য আরও এক পতিতার সাথে দেখা করতে আমার ক্লিনিকে গিয়েছিল।
—অদিতির কথা শুনে তজশ্রী ব্যার্নাজি তপন এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। তপন তুই আমাকে সত্যি টা বল। অদিতি যা বলছে তা কি সত্যি?
—তপন নিরব ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে তার একটি কথাও নেই। তজশ্রী ব্যার্নাজির ছেলের নিরবতা দেখে মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। অরুনিকার কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে তজশ্রী ব্যার্নার্জি, অদিতি যা বলছে তা কি সত্যি?
—আশেপাশে লোকজনেরা ছিঃ ছিঃ বলে যে যার মতো মন্তব্য শুরু করে দিয়েছে।
—অরুনিকার এই সব তামশা ভালো লাগছিল না। তাই সে বলে, হ্যা, হ্যা, আমি পতিতা ছিলাম কিন্তু এখন আমি
—ওর মুখের কথা শেষ না হতেই তজশ্রী ব্যার্নাজির হাত অরুনিকার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে।
—আহ কি করছেন মা লাগছে, ছাড়ুন আমাকে।
—তজশ্রী ব্যার্নার্জি অরুনিকার চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দরজার এর বাইরে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। অরুনিকা উঠে দাঁড়াতেই তজশ্রী কষে কষে চড় মারে তাকে। কুলটা মেয়ে আমার বাড়িতে এতো দিন ছিল আর আমি বুঝতেও পারিনি। ছিঃ ছিঃ। হায় রাম কোন পাপের শাস্তিতে, অপবিত্র করলে আমার সংসার। অরুনিকার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, আর কোন দিন যেন আমার ছেলের আশেপাশে তোকে না দেখি এই বলে দরজা লাগিয়ে দেয়।
অরুনিকা দৃষ্টি তখন সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তপন এর দিকে। সে এখনো নিরব ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে। তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে ওঠে অরুনিকা ঠোঁটের কোণে। কিছুক্ষণ আগেই সপ্তম পাকে যে প্রতিজ্ঞা করছিল চিরস্থায়ী মজবুত সম্পর্কের। এখন সে দাঁড়িয়ে আছে নিরব ভূমিকায়। কয়েক সেকেন্ড এর ব্যবধানে আজ তার সিঁথিতে সিঁদুর উঠে না।
বিয়ে বাড়ির বন্ধ দরজার অপারে রয়ে গেল ভদ্র সমাজের সব মানুষ আর এপারে মাটিতে বসে আকাশপানে চেয়ে আছে অরুনিকা।
—রণক এসে জিজ্ঞেস করে, অরু তুমি ঠিক আছো?
—আকাশপানে চেয়ে অরুনিকা রণক'কে প্রশ্ন করলো, এখানে কি করছেন আপনি?
—তোমাকে দেখতে এসে ছিলাম।
—দেখা হয়ে গেছে?
—রণক নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলার নেই তার।
—অরুনিকা বলল, সমাজ থেকে নিষিদ্ধ গলিতে কোন এক খারাপ মানুষ বা কোন এক সন্ত্রাসচক্র জোরপূর্বক কিছু নারী'কে ঠেলে ফেলে দেয় অন্ধকারে। যখন সে নারী অন্ধকার গলি থেকে আলোয় ফিরে আসতে চায় তখন পুরো সমাজ জোরপূর্বক আবারও অন্ধকারে ঠেলে ফেলে দেয়। তাহলে খারাপ কে হলো! সেই নারী? যাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় নিষিদ্ধ পল্লীতে। নাকি সেই খারাপ পুরুষ বা সন্ত্রাস চক্র আর নাকি এই সমাজ। কে আসলে খারাপ?
—সেই পুরুষ বা সন্ত্রাস চক্র।
—না ভুল বললেন, খারাপ এই সমাজ। সমাজ নিজেই ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। সমাজ নিজেই ছুড়ে ফেলে আমাদেরকে ওই নরকে। নরকে দিন নেই শুধুই রয়েছে অন্ধকার রাত। আর সেই অন্ধকারে পুরুষ এর সাথে মেতে উঠতে হয় যৌন খেলায়। যে একবার এই অন্ধকার জীবনে প্রবেশ করে তার কাছে বাপ-চাচ, ভাই এই সব সম্পর্কের কোন মূল থাকে না। অন্ধকার এই গলিতে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে কারো বাপের সঙ্গে তো কারো ভাইয়ের সঙ্গে। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না।
—আমার পতিতা হওয়ার খবর জানার পরও আমার বাবা-মা জীবিত ছিল। কিন্তু যেদিন এই পতিতা মেয়ে'কে গ্রামে দেখে সেই দিন সমাজের দোহায় দিয়ে দরজা এই ভাবেই বন্ধ করে দিয়েছিল মুখের উপর। হাজার বার ডাকার পরও মা খুলেনি দরজা। তারপর লোকলজ্জার ভয়ে তারা গলায় দড়ি দেয়।
—অরু অনেক হয়েছে বাদ দাও এই সব কথা। চলো এখান থেকে। অরুনিকার হাত ধরে তুলতে নিয়েছে রণক। তখন অরুনিকা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় রণক'কে। চিৎকার করে বলে, আমাকে একা ছেড়ে দিন। চলে যান এখান থেকে বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনিকা।
—না আমি যাবো না এখানে তোমাকে রেখে যাওয়ার জন্য আসিনি। এই বলে আবার অরুনিকার কাছে যায় সে। এইবার আর অরুনিকা দূরে ঠেলে দেয় না রণক'কে। অরু মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে রণক বলে। আমি তোমার পাশে থাকব সারাজীবন। সমাজের ভয় আমার নেই।
—রণক'কের বুকে মাথা দিয়ে অঝোরে কাঁদে অরুনিকা। চোখের কাজল লেপটে গেছে। অরুনিকার গলার হীরের হার খুলে রণক ছুঁড়ে মাড়ে ব্যার্নাজি বাড়ির দরজায়। অরুনিকা'কে নিয়ে চলে যায় সে।
— দোতলার উত্তরের ঘরের জানালা দিয়ে তপন চেয়ে দেখে অরুনিকার চলে যাওয়া। রণকের বুকে আশ্রই পেয়েছে ভেবে তপন মন মনে বলে উঠে এইতো তুমি জায়গা পেয়েছ প্রিয়। আমি তোমার যোগ্য না। সমাজের সাথে লড়াই করে তোমাকে বুকে আগলে রাখার সামর্থ্য আমার নেই।
—ব্যার্নাজি পরিবারে মেহমান একে একে ছিঃ ছিঃ ছিঃ করতে করতে বেড়িয়ে যায়। তনশ্রী ব্যার্নাজি মাথায় হাত রেখে বসে আছে। যে ছেলের উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো। আজ সে ব্যার্নাজি পরিবার এর মান সম্মান ধুলোয় মিশে দিল। শেফালী আর অভিনব এর বাসরের রাত জাগা আর হয় না। সবাই যে যার মতো নিজ নিজ ঘরে চলে যায়।
******
রিতিকা বিয়ের পোষাকে বসে আছে হোটেলে রুমের জানালার পাশে। বর্তমান এই জীবন শুরুর অতীতের স্মৃতিতে তে তলিয়ে যায় অরুনিকা।
—পরেরদিন বিকেলে ট্রেন এসে থামে কলকাতার স্টেশনে। ওরা নামবার কিচ্ছুক্ষণ পরে দুটো ছেলে আসে। অমল পরিচয় করে দেয় ছেলে দুটির সাথে, ওরা ওর বন্ধু। একজনের পিয়াস দাস আর একজন এর নাম শ্যামল চ্যার্টাজি। ওরা দুজনেই নাকি শহরে থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সন্ধ্যা নেমে আসে গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। অরুনিকা ভেবেছিল হয়তো দুই বন্ধুর মধ্যে যে কোন একজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে । কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার পর দেখল শহর থেকে কিছুটা ভেতরে এক বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়েছে।
—অমল শ্যামলের সাথে কিছুটা আড়ালে কথা বলছে। অরুনিকা ঘুরে ঘুরে তার নতুন ঘর দেখছে। এখানেই তাদের নতুন জীবন শুরু হবে। হোক না বস্তুি তাতে কি যায়-আসে। অমল পাশে থাকলে সবরকম জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে অরুনিকা।
—পিয়াস ইতিমধ্যে হোটেল থেকে রুটি সবজি কিনে এনেছে। অরুনিকার হাতে রুটি সবজির ঠোঙা দিতে দিতে নিচু স্বরে বলল, দেখেতো ভদ্রঘরের মনে হচ্ছে। এখানে কেন এসেছেন?
—গলাটা উঁচিয়ে অরুনিকা জিজ্ঞেস করল। কেন এসেছি মানে!
—অরুনিকার কাছে অমল এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে লক্ষী?
—অরুনিকা বলতেই নিয়েছে তখন পিয়াস বলল, আমি বলছিলাম যে অনেক দূরের পথ এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে খেয়েনিন।
—পিয়াস এর মিথ্যা কথা বলা দেখে অবাক হয় অরুনিকা। কিন্তু সে আর কিছু বলে না।
— কলকাতা শহরেরর কথা আজ অব্দি শুধু বাবার মুখেই শুনেছে অরুনিকা। গত এক সপ্তাহ কলকাতায় থেকে এই শহরের ব্যস্তজীবন স্বচক্ষে দেখল সে। প্রতিদিন রাস্তায় লাখ মানুষ নামে। রাস্তায় থাকা এই সব মানুষ এসেছে বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন রাজ্য থেকে। কেউ জীবীকার তাগিদে ব্যস্তময় রাস্তায় ট্যাক্সিতে বসে কর্মস্থলে ঠিক সময়ে পৌঁছাবার টেনশন করছে। কেউ স্কুল কলেজে যেতে আবার কেউ হয়তো ঘুরতে রাস্তায় যানযটে বসে অপেক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছার।
—দুই হাত ভর্তি বাজারে ব্যাগ নিয়ে কলকাতার রাস্তার ব্যস্ততা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ি পথে হাঁটে অরুনিকা। অমল বলেছে রাতে পাশের মন্দিরে অরুনিকা'কে বিয়ে করবে। নিজের বিয়ের জন্য নিজেই টুকটাক বাজার করেছে অরুনিকা। অমলের পছন্দের খাবারের আয়োজন করবে সে আজ।
—কলকাতায় আসার পরে বিয়ে নিয়ে অমল এর সাথে কথা কাটাকাটি হয় তার। অরুনিকা ভেবেছিল কলকাতায় এসেই আগে হয়তো ওকে বিয়ে করবে। কিন্তু অমল বিয়ে কথা উঠলেই অন্য কথা দিয়ে কথার মোর ঘুরে দেয়। তাই আজ সকালে বেশ ভালোই কথা কাটাকাটি হয় তাদের মাঝে। শেষ পযন্ত অমল বলে আজ রাতেই বিয়ে করবে তারা।
— অমলের শরীর ভালো লাগছিল না তাই অরুনিকা নিজে বাজার করতে বেড়িয়েছে। নানান কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছে অরুনিকা দেখল পালোয়ান এর মতো দুইজন অচেনা লোকের মাঝে বসে আসে মাথায় কাপড় দেওয়া এক বয়স্ক মোটা মহিলা। মহিলাটি পান চিবিয়ে মুখ লাল করে রেখেছে । এদের তো অরুনিকা চিনে না। ঘরের ভেতর কোথাও অমল নেই। শ্যামল দাঁড়িয়ে টাকা গুনছে। ঘরের ভেতর ঢুঁকে অরুনিকা বলল, শ্যামল-দা অমল কোথায়! এনারাই বা কে?
—শ্যামল মুচকি হেসে বলল, আরে এনাদের চিনলে না!এনারা তোমার শশুর বাড়ির লোক।
—কি যা-তা বলছো তুমি? আমার শাশুড়ী গ্রামে আছে। আমি এনাদের চিনি না।
—তা চিনো না ঠিক, কিন্তু এখন থেকে চিনবে তাতে সমস্যা তো নেই। মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল।নাজিয়া খালা এই হলো আপনার মাল, আপনাকে বুঝে দিলাম।এখন আমি যাই।
—অরুনিকা শ্যামল এর কাছে গিয়ে বলল, অমল কোথায় দাদা?
—অমল নিজের অংশের টাকার ভাগ নিয়ে বিকেল এর ট্রেনে বাড়ি পথে রওনা দিয়েছে।
—অরুনিকা কোন কথার মানেই বুঝে উঠতে পারে না। ওকে ছেড়ে অমল চলে যাবে কেন! আজতো ওদের বিয়ে।
—শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলছেন দাদা? আজ আমার আর অমলের বিয়ে। ও কেন চলে যাবে! কি মজা শুরু করেছেন? আমার এই সব মজা ভালো লাগে না।
—অরুনিকার কথা শেষ না হতেই সবাই উচ্চ স্বরে হো হো করে হেসে উঠে। শ্যামল হাসতে হাসতে বলে, এখন থেকে প্রতিদিন নিত্য নতুন বিয়ে ছাড়া বর পাবেন।
—এতক্ষণ বসে থাকা মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে অরুনিকার হাত ধরে বলল, অনেক হয়েছে এখন চলো।
—আমি আপনার সাথে কোথাও যাবনা। অমল কোথায়! দাদা অমল'কে ডাক দেন। অরুনিকার চিৎকারে কারো মন গলে না। সে বার বার চিৎকার করে বলে, না আমি যাবো না। অমল কোথায়! আজ অমলের সাথে আমার বিয়ে। আমি কোথাও যাবো না। এরপর থেকেই অরুনিকা স্থান হয় রুপোগাছী নিষিদ্ধ পল্লী।
—নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়ার পরে একদিন পিয়াস এর সাথে দেখা হয় অরুনিকার। পিয়াস এর কাছ থেকেই জানতে পারে নারী পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত অমল। গ্রামের সহজসরল মেয়েদের কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শহরে এনে বিক্রি করে দেয় পতিতালয়ে। সে নিজেও এই কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু সে কোন নারী'কে নিয়ে আসে না। শুধুমাত্র ওদের কাজে হাতে হাতে টুকটাক সহযোগিতা করে।
—পিয়াস যখন জানতে পারে। অরুনিকা'কে প্রেমের জালে ফেলে নিয়ে এসেছে। তখন পিয়াস এর খারাপ লাগে তাই গোপনে ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা প্রথম দিনই সে করেছিল। অমলের কোথায় আছে সেই কথা জানতে চাইলে, পিয়াস জানায়। অমল থাকে কোরিয়ায়। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক এখন সে।
****
ঘরের লাইট অন হতেই অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে অরুনিকা। রণক হাতে খাবার নিয়ে ঘরে এসেছে। অরু তোমার জন্য খাবার এনেছি।
—খাব না আমি। আপনি খাবার নিয়ে চলে যান। আর যাওয়ার আগে লাইট বন্ধ করে যাবেন।
—অরুনিকার মনের অবস্থা বুঝে রণক। তাই আর কথা না বাড়িয়ে খাবার এর প্লেট টেবিলের উপর রেখে বলল, খিদে পেলে খেয়ে নিও। লাইট বন্ধ করে চলে যায় সে।
অরুনিকা ধীর স্বরে বলে, অতীত এর সেই দিনের বিয়ের নামে আমাকে বিক্রি করা হয় পতিতালয়ে আর আজ বিয়ের শেষ আচার সিঁদুর দানে সময় পতিতা বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমাকে।
—ঠিক যেন অতীত এর সেই দিনের মতো। যখন নিষিদ্ধ পল্লী থেকে পালিয়ে গ্রামে যায় অরুনিকা। অরুনিকা'কে দেখতে গ্রামের সবাই ছুটে আসে। হাজার বার মা দরজা খুলো বললেও, রত্নবর্তী বাড়ির দরজা খুলে না। আভা জানালা দিয়ে অরুনিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
—রুপোগাছী নিষিদ্ধ পল্লীতে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান এর ছেলে যায় একদিন। সেখানেই অরুনিকার সাথে দেখা হয়। গ্রামে থাকতে ছেলেটি'কে দাদা বলে ডাকাত। নিষিদ্ধ পল্লীতে অরুনিকার সাথে রাত কাটিয়ে গ্রামে ফিরে অরুনিকার পতিতা হওয়ার গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। সবাইকে জানায় পাশের গ্রামের তার এক বন্ধু নিষিদ্ধ পল্লীতে অরুনিকা'কে দেখে এসেছে। সেই থেকেই গ্রামের সবাই জানত অরুনিকা একজন পতিতা।
—সেই-দিন গ্রাম ঢোকার পর। গ্রামের পঞ্চায়েতে অরুনিকার বিচার বসে। গ্রামের কলঙ্ক এই বলে বিচারে রায় হয় পুড়িয়ে মারা হবে তাকে।
যখন অরুনিকা'কে পুড়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে তখন খবর আসে সুনীল ও তার স্ত্রী রত্নাবর্তী গলায় দড়ি দিয়েছে। এই খবরে অরুনিকা ভেঙে পড়ে। গ্রামে যদি পা না দিত তাহলে তার মা-বাবা অন্তত জীবিত থাকত। মা-বাবার লাশ দেখার সুযোগও সে পায়নি।
—সন্ধ্যায় যখন তার বাবা-মায়ের লাশ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় তখন গ্রাম পঞ্চায়েত এর ছেলে এসে তাকে শোয়ার প্রস্তাব দেয়। বুকে পাথর রেখে সে নিজের শরীর বিলিয়ে দেয় মুখোশধারী ভদ্র সমাজের ওই পুরুষের কাছে। সে যদি অস্বীকার করত তাহলে পালানোর সুযোগ সে পেত না। শ্মশান থেকে ফিরে এসে তাহলে গ্রামের লোকজন তাকে পুরাতো। সে একজন পতিতা হলেও, সে ছাড়া আভার আর আপন কেউ নেই। তাই শেষ পযন্ত আভার কথা চিন্তা করে সে রাজি হয়ে যায়। অন্ধকার গ্রাম থেকে পালিয়ে আসে আবারও কলকাতায়।
*****
রিংটোন বেজেই চলছে রণকের ফোনের। দুইবার বাজার পর রণক এসে ফোন রিসিভ করতই ওপাশ থেকে তপন বলল। আগামীকাল বাড়িতে একবার আসবেন রণক। একটা চিঠি রেখেছি বালিশ এর নিচের ওটা নিয়ে অরুনিকার কাছে একটু পৌঁছে দিবেন। নিজের কথা বলা শেষ করেই ফোন কেটে দেয় তপন।
—রণক তপনের কথার মানে বুঝে উঠতে পারে না।
***
উত্তরের ঘরে ফ্যানের সাথে ঝুলছে তপনের প্রাণশূন্য দেহ। কিছুক্ষণ আগের বিয়ের আলোয় ঝলমল করা বাড়ি এখন অন্ধকার ছেয়ে গেছে। লোকলজ্জার ভয়ে ভালোবাসার মানুষ'কে দ্বিতীয় বার হারিয়ে পৃথিবীতে বাঁচবার আর ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে তপন। তাই ভালোবাসা জন্য একটা চিঠি লিখে বালিশের নিচে রেখে সে প্রাণ ত্যাগ করে।
ব্যানার্জি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে রণক হতভম্ব হয়ে যায়। সে কি করবে এখন! সে কল্পনাও করতে পারেনি তপন এই ভাবে আত্মহত্যা করবে। বাড়িতে লোকের সমাগম।যে যার মতো করে কথা বানাচ্ছে। লাশ দেখে কেউ কেউ ব্যানার্জি পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে বাইরে এসে বলছে, শেষ পর্যন্ত একটা পতিতার জন্য আত্মহত্যা ছিঃ!ছিঃ! ছিঃ। কেউ আবার সন্দেহের চোখে বাড়ির সব খুঁটিয়ে দেখছে এটা আত্মহত্যা নাকি হত্যা। —অনেকে আবার মুখের উপরেই বলে চলে যাচ্ছে।এই সব কিছুর জন্য দায়ী ওই কুলটা।
—তনশ্রী ব্যানার্জির শোকে আধমরা অবস্থা। বেচারি শেফালীর আজ ছিল ফুলসজ্জা কিন্তু দাদার মৃত্যুতে মনের সব রঙ যেন পানসে হয়ে গেছে। মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল। জাতপাত, সমাজের নিয়মকানুন এই সব মানতে গিয়ে দাদা'কে হারিয়ে ফেললাম মা।
—মেয়ের মুখের কথা শেষ না হতেই কাঁদতে কাঁদতে শোকে আধমরা হওয়া তনশ্রী চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে। ওই কুলটা আমার ছেলে'কে খেয়েছে। নরকে স্থান হবে ওর। আমার অভিশাপ ওর জীবন তছনছ করে দিবে। মৃত্যুও আসবে ওর।কষ্ট দায়ক নরকের মৃত্যু।
—রণক মনে মনে চিন্তা করে। কী অদ্ভুত এই সমাজ! নিজের সন্তান কে হারিয়েও গোঁড়ামি যায় না সমাজের মানুষের। ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে যায় উত্তরের ঘরে। বালিশ সরিয়ে চিঠিটা বেড় করে নিয়ে আবার বেড়িয়ে আসে বাইরে। দম কেমন জানি বন্ধ হয়ে আসতে নেই। কয়েক মাসে বেশ কয়েকটা মৃত্যুই সে দেখেছে।
সর্ব প্রথম নিজের বোনের মৃত্যু। উষার মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পাচ্ছিল না রণক। বাড়ির বাগানে উষার বিভৎস লাশ পাওয়া যায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুসারে উষা জীবিত থাকতেই ওর স্তন কেটে ফেলে শয়তান দিপেশ ও ফিরোজা। অতিমাত্রায় রক্ত ক্ষরনের কারণে উষার মৃতু হয়। উষার মৃত্যুর আগে ওর লম্বা চুল আগুন লাগিয়ে পুড়ে ফেলা হয়। পোড়া চুল মাথায় লেপ্টে ছিল গলে যাওয়া মোমের মতো। হাতের নখ উপড়ে ফেলা ছিল। শরীরের জায়গা জায়গা আগুন দিয়ে পোড়ানোর দাগ। চিৎকার যেন করতে না পারে তার জন্য জিব কেটে দিয়েছিল শয়তান গুলো। উষা তিলে তিলে তীব্র যন্ত্রণা পেয়ে মৃত্যুর কোলে শায়িত হয়। হয়তো মৃত্যুর কোলে শায়িত হতে হতে এই অভাগা দাদা'কে স্মরণ করেছে। হয়তো শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এই আশা নিয়ে ছিল ওর দাদা ওকে বাঁচাবে।
নিজের বোনের বিভৎস মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে করতে হাতে থাকা তপনের চিঠি বুকপকেটে রেখে হোটেল এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে।
********
বিয়ের পোষাকে জানালার পাশেই মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অরুনিকা। ঘরে রোদের আলো আসায় ঘুম ভেঙে যায় অরুনিকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা ১১ টা বাজে। অপরার দেহ ভস্মের কথা মনে পড়ে তার। তৎক্ষনাৎ ফোন হাতে নিয়ে গঙ্গা পাড়ে যেতে হবে এই লিখে রণক এর কাছে মেসেজ করে অরুনিকা।
মেসেজ করে সে বাথরুমে স্নান করতে যায়। স্নান করার সময় সে পাশের রুমের বার্থরুম থেকে গোঙানি শব্দ শুনতে পায়। চটজলদি স্নান ছেড়ে রণকের কিছু হয়েছে মনে করে পাশে রুমে যায়।রুমের গেইট বন্ধ দেখে হোটেলের রিসেপশনিস্ট এর কাছে থেকে মাস্টার কী নিয়ে এসে গেইট খুলে। তারপর দ্রুত পায়ে বাথরুম এর দিকে এগিয়ে গিয়ে গেইট খুলতেই দেখল। বাথরুমের ফ্লোরে মুখ, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ফিরোজা।
—অরুনিকাকে দেখেই ভূত দেখার মতো ছানাবড়া চোখ করে তাকিয়ে থাকে ফিরোজা। মনে মনে তার নিশ্চয়ই এটাই হচ্ছে যে, অরুনিকা বেঁচে আছে কি করে। অরুনিকার দিকে তাকিয়ে চোখের ঈশারায় মুখের স্কচটেপ খুলে দিতে বলে ফিরোজা।
—ফিরোজা'কে দেখা মাত্রই অরুনিকা চোয়াল শক্ত হয়ে, চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে। দ্রুত বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে চারিদিকে হন্যে হয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে।
—রণক এসে অরুনিকার এমন হন্যে হয়ে কিছু খুঁজতে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কি খুঁজছ তুমি?
—রণক'কে দেখেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে আমি ওকে খুন করবো। ওর বাঁচবার কোন অধিকার নেই। এই বলে আবার পুরো ঘর হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করে।
—রণক অরুনিকার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল,শান্ত হও অরু। ওকে মারবে অবশ্যই মারবে, কিন্তু এখানে না। হোটেলে খুন করে তোমার কি জেলে যাওয়ার ইচ্ছে জেগেছে? তুমি জেলে গেলে আভার কি হবে? সবাই সবার অংশের শাস্তি পাবে তবে এমন ভাবে পাবে কাকপক্ষীও জানতে পারবে না।
—রণকের বুকে গিয়ে অরুনিকার রাগ কমে যায়। স্বাভাবিক হয়ে সে বাথরুমের গেইটে গিয়ে রণকের উদ্দেশ্যে বলল, আমাকে যে জঙ্গলে ফেলে এসেছিল এরা। ওই জঙ্গল ওকে মারার জন্য পারফেক্ট জায়গা।
—অরুনিকার কাছে এগিয়ে এসে রণক বলল, ওকে মারবার আগে তোমার আরও একটা শোক সামলিয়ে উঠতে হবে।
—রণকের কথা বুঝতে না পেরে। হা করে কেবল তাকিয়ে থাকল রণকের মুখের দিকে।
—রণক নিজের বুকপকেট থেকে তপনের চিঠিটা বেড় করে এগিয়ে দিল অরুনিকার দিকে।
—কী এটা রণক? প্রশ্ন করে, সে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করে।
অরুনিকা,
আর কিছুই নতুন করে ঘটবার নেই। নতুন করে কিছু বুঝবারও নেই। কষ্টের সাগর পেরিয়ে অরণ্যের মাঝে তোমাকে পাই। নতুন করে তোমায় নিয়ে বাঁচবার ইচ্ছে আমার মাঝে তিলে তিলে সঞ্চয় হয়। কিন্তু সমাজের এই নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়ি তে আমি বাঁধা। ভগবান আমাকে সেই শক্তি দেয়নি যে সমাজের এই বেড়ি ভেঙ্গে তোমার কাছে ছুটে যাবো। বলবো তোমাকে ভালোবাসি। আজ যখন তোমার অপমান হচ্ছিল সমাজের সব অমানুষের মাঝে। তখন খুব ইচ্ছে করছিল, তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেই সাহস যে আমার নেই। এই সমাজের বেড়িতে আবদ্ধ থেকে নতুন করে আরও এক কষ্টের সাগর পাড় করবার শক্তি আমার ছিল না। তাই সমাজের এই বেড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে গেলাম। আর কেউ সমাজের চিরাচরিত নিয়মের দোহাই দিয়ে আমাকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। আমি চাই তুমি সমাজের সব শৃঙ্খলের বেড়ি ভেঙ্গে জয় করো নিজেকে। সবাইকে দেখিয়ে দাও তুমি পতিতার আগে একজন মানুষ। তোমারও বাকী পাঁচজন এর মতো অধিকার আছে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবার। তোমার সুখ আমার কাম্য।
ইতি
------------------
তপন
চিঠি পড়া শেষ করে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অরুনিকা। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। গতকালই যে জীবিত ছিল। বর সাজে মাথায় টোপর দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিল শুভ পরিণয়ের অপেক্ষায়। সমাজের মানুষ সেই বিয়েতে বাঁধা সৃষ্টি করলে বরের নির্লিপ্ততা দেখে অরুনিকা যে মানুষটি'কে ঘৃণিত সমাজেরই অংশ বলে ধরে নিয়ে ছিল। এখন সেই মানুষটি তার ভালোবাসার জন্য অপঘাতে মৃত্যু'কে আলিঙ্গন করল। সে কি বলবে? এই সমাজ কেন এতো অদ্ভুত? তপনের মতো এমনও কোন মানুষ এই সমাজের অংশ অরুনিকার ভাবতে অবাক লাগে।
—মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে অরুনিকা বলল, কেন আপনি একবার আমাকে বলতে পারলেন না। এই সমাজের বেড়ি তে আবদ্ধ আপনি। কেন আমাকে ভুল চিন্তা করতে বাধ্য করলেন? কেন! কেন!
—রণকের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে অরুনিকা বলল, আমাকে নিয়ে গিয়ে একটি বার উনাকে দেখাতে পারবেন?
—একি বলছো তুমি অরু? ওখানে যাওয়া অসম্ভব। তোমাকে দেখলে ওখানে কেউ ঠিক থাকতে পারবে না। রাগের বশিভূত হয়ে কে কি করে বসে বলা যায় না।
—অরুনিকা হাত জোর করে বলল, যে করেই হোক একটি বার আমাকে ওই মানুষটিকে দেখার সুযোগ করে দিন। পৃথিবীতে এতো নিখুঁতভাবে কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। যখন কেউ ভালোবাসল এই সমাজ তাঁকেও আমার থেকে কেড়ে নিল। তপন বলে ছিল আমার পরিচয় কেউ মেনে নিবে না তাই লতিকা নাম নিয়ে যেন ওর সাথে সারাজীবন আমি থাকি। তখন আমার খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পাচ্ছি, কেন সে ওই সব করছিল। আমাকে কাছে রাখার জন্য সব রকম মিথ্যের আশ্রই সে নিয়েছে ।কিন্তু ডক্টর অদিতি তার সব চেষ্টা বৃথা করে দিল। অদিতির কথা মনে পড়তেই দপ করে জ্বলে ওঠে অরুনিকা চোখ। কাউকে ছাড় দিব না। কাউকেই না। প্রতিশোধ নিব, সবাই যার যার নিজ কর্মের শাস্তি পাবে। আমি দিব সেই শাস্তি।
হন্তদন্ত হয়ে রণক বড় বড় ধাপ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গহীন জঙ্গলে। বারবার মানা করা স্বত্তেও অরু এমন কাজ কীভাবে করতে পারে!
—আগে যদি অনুমান করতে পারতাম তাহলে ওই মেয়েটি'কে ফোন করা থেকে আটকাতাম।
—মৃণাল এর কথা শুনে ওর দিকে তাকালো রণক। অন্ধকারে মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। আপনি অরুর কাছে কেন গিয়ে ছিলেন? কিছুদিন হলো দেখছি অরু কে ফলো করেছেন!
—এই সব প্রশ্ন পরেও করতে পারবেন। পুলিশ এর আগে আমাদের মিস.অরুনিকা'কে খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরী । পুলিশ চারিদিকে খুঁজছে উনাকে। একবার ধরা পড়লে সব শেষ। ভিকটিম নিজে উনার নাম নিয়েছে তাই ধরা পড়লে বাঁচবার কোন চান্স নেই। ফিরোজা নামের ওই মেয়েটি দুর্দান্ত চালাক। মেয়েটি জানত পালানোর শক্তি ওর মাঝে নেই। তাই শত্রুর আস্তানায় থেকেই পুলিশ এর কাছে ইনফর্ম করেছে।
হটাৎ রণক আর মৃণাল থমকে দাঁড়ায়। সামনেই ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। ছুড়ি থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। মাটিতে পড়ে আছে ফিরোজার লাশ।
—নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা রণক। অরুনিকা সত্যি সত্যি ফিরোজা'কে খুন করেছে!
—তুমি কি করলে অরু? তোমাকে না বলেছিলাম। কেন এমনটা করলে তুমি? ফিরোজার কাছ থেকে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকী ছিলো। দিপেশ এর সম্পর্কে শুধু ফিরোজাই সব কিছু বলতে পারতো। কেন করলে এটা তুমি? পুলিশ তোমাকে চারিদিকে খুঁজছে। ফিরোজা'কে তুমি এখানে নিয়ে আসার আগেই ফিরোজা আমার হোটেলের রুম থেকে পুলিশ এর কাছে ইনফর্ম করেছে। তুমি ওকে বন্দী করে রেখেছ। এতক্ষন এটা ছিল অপহরণ এর কেইস। কিন্তু এখন তো এটা মার্ডার কেইস।
—অরুনিকা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে এক পলকে তাকিয়ে আছে ফিরোজার লাশের দিকে। চোখে তার এখনো আগুন জ্বলছে।
—অরুনিকা'কে চুপ থাকতে দেখে রণক এগিয়ে এসে ওর গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল। তুমি কি বুঝতে পারছ, আমি কি বলছি।
—মৃণাল এগিয়ে এসে বলল। পুলিশ আপনাকে চারিদিকে খুঁজছে। আমি হোটেল থেকেই এই নিউজ পেয়েছি। যা করার এখুনি করতে হবে। এই শহর এখুনি ছাড়তে হবে আপনাকে। এই মেটার ঠান্ডা না হওয়া অব্দি আপনার কলকাতায় থাকাটা রিস্ক।
—অরুনিকা রণক আর মৃণাল মুখে পুলিশ এর কথা শুনে উচ্চ শব্দে হেসে ওঠে । চিন্তা করবেন না। আমি কে এটা হয়তো ভুলে গেছেন আপনারা। আমার সাথে বিছানায় শোয়ার দরুনে অনেক উপর মহলের লোকেদের সাথেই আমার পরিচয়। একটা মামলা ধামাচাপা দেওয়া আমার কাছে কোন ব্যাপার না। ফিরোজা খুন হয়েছে কেউ জানতে পারবে না।
—রণক এর দিকে তাকিয়ে অরুনিকা বলল। আমার জন্য তো এই অব্দি অনেক কিছুই করেছেন। আজ আর একটা কাজ করে দিবেন প্লিজ।
—হুম, বলো কি কাজ?
—মাটি খুড়ার ব্যবস্থা করুন। এরপর সে মাটিতে এক দলা থুতু ফেলে মুখ খিস্তি করে বলল, মাগীক মারতে চাইনি প্রথমে। যখন বলল, আমার অপরার খোঁজ ওই মাগীই কর্ণভ'কে দিয়েছে। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল কুটিকুটি করে কেটে ওর মাংস কুকুররে খাওয়ায়। পরে আবার চিন্তা করলাম। যে খারাপ মাগী ছিল, ওর মাংসের কোন স্বাদ মজা পেত না কুকুর। বেচারা কুকুরের মুখের স্বাদ তাই আর নষ্ট করত মন চাইলো না। এই জন্য ঠিক করলাম মাগীক পুঁতে রাখব।
—অরুনিকার অস্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে রণক ওর গায়ে হাত দিয়ে বলল, তুমি ঠিক আছ অরু? কি সব যা-তা বলছো?
—অরুনিকার জ্বলজ্বল করা চোখ নরম হয়ে আসে। চোখ জলে ভরে ওঠে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে, অপরার কোন দোষ ছিল না। কর্ণভ'কে ও ভালোবেসেছিল। যখন সেই ভালোবাসার মানুষের অত্যাচার হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে ছিল। এই ফিরোজা ওকে কর্ণভ এর হাতে তুলে দিয়েছে। উষা আর অপরার অপহরণ ফিরোজা আর দিপেশ মিলেই করেছিল।
—মৃণাল আর রণক দুজন মিলে মাটি খুঁড়ছে। গাছের নিচে বসে আছে অরুনিকা। মৃণাল এর দিকে তাকিয়ে অরুনিকা বলল। এতোদিন পর অনুশোচনা হয়ে কি কোন লাভ আছে ডক্টর মৃণাল?
—অরুনিকার হুট করেই এমন কথার কোন মানে খুঁজে পায় না মৃণাল। মাটি খুঁড়া বন্ধ করে অরুনিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। কি বলতে চাচ্ছেন আপনি? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
—কিছুই বুঝাতে চাইনি। যে কাজ করছিলেন সেটাই করুন মন দিয়ে।
—মাটি খুঁড়া শেষ করে ওরা ফিরোজার লাশ মাটি চাপা দেয়। অরুনিকা কাছে এসে রণক জিজ্ঞেস করে এখন কি করবে?
—অরুনিকা উঠে দাঁড়িয়ে মৃণাল এর কাছ থেকে ফোন চেয়ে নেয়। খানিকটা দূরে গিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলে। ফিরে এসে বলল, আর কোন সমস্যা নেই। ফিরোজার অপহরণ এর কেইস ফাইল বন্ধ। ওর খোঁজ কেউ আর করবে না।
—রণক অবাক হয়ে যায় একটা ফোন করে কীভাবে অপহরণ এর কেইস ফাইল বন্ধ হয়। এরকম ক্ষমতা তো শুধু উপর মহলের লোকেদেরই থাকে।
***
হোটেলে ফিরে এসে শাওয়ার নিতে বার্থরুমে যায় অরুনিকা। কিছুটা সময় নিয়েই হট শাওয়ার নেয় সে। শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ভেজা শরীরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। আয়নায় দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রাই দিয়ে চুল শুকচ্ছিল তখন রুমে ঢুকে রণক।
—অরুনিকা'কে আয়নার সামনে তোয়ালে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ এর জন্য থমকে যায়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরুনিকার দিকে।
—রণক'কে দেখে অরুনিকা ব'লে ওঠে, আমি আসলে খেয়াল করিনি গেইট খোলা ছিল। আপনি একটু বাইরে দাঁড়ান আমি কাপড়...
—অরুনিকার কথা শেষ না হতেই রণক গিয়ে ওর কোমড় দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের বুকে টেনে নেয়। এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে অরুনিকার ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁট ডুবে দেয়। প্রথম ছানাবড়া চোখে রণকের কান্ড দেখে অবাক হলেও পরে রণকের ছোঁয়ার সুখের আবেশে অরুনিকার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। একে অপরকে যখন জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বনে ব্যস্ত তারা।
—তখন হোটেলের স্টাফ এসে রুম নক করে।
—অরুনিকার ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে রণক বলে। তোমাকে দেখে নিজকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি গেইট টা খুলে এখুনি ফিরে আসছি। তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।
—গেইট খুলে রনক দেখল ব্যাগ হাতে হোটেলের স্টাফ দাঁড়িয়ে। স্টাফটি ব্যাগ এগিয়ে দেয় রণক এর দিকে।
—ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বলল, এটা কি? আমরা তো কিছু অর্ডার করিনি।
—রিসিপশনে এটা কেউ অরুনিকা ম্যাম এর জন্য রেখে গেছে।
রণক ব্যাগটা নিয়ে গেইট বন্ধ করে দেয়। অরু তুমি কিছু অর্ডার করে ছিলে?
—অরুনিকা এগিয়ে এসে বলল, ওহ মিস্টার. বিশ্বাস পাঠিয়ে দিয়েছে।
—মিস্টার.বিশ্বাস টা আবার কে অরু?
—অরুনিকা ব্যাগ খুলে গাউন বেড় করতে করতে বলল, ক্লাইন্ট এর পরিচয় বলা যায় না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে পরে কথা হবে। এই বলেই বাথরুমে চলে যায় সে।
—অরুনিকার বলা কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারে না রণক। কিসের ক্লাইন্ট!
—বাথরুম থেকে কালো স্যাটিন গাউন পড়ে বেড়িয়ে আসে অরুনিকা। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাল্কা মেকআপ করে,ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দেয়। উন্মুক্ত খোলা পিঠে চুল বাতাসে উড়ছে। পারফিউম দিয়ে নিজের শরীরের সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয়। পেন্সিল হিল পড়তে পড়তে অরুনিকা বলল। আপনার আর আমার আজকেই শেষ দেখা। আমাদের দুজনের পথ আলাদা। আজকের পর হয়তো আর কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হবে না।
—পেন্সিল হিল জোড়া পড়ে অরুনিকা যখন দাঁড়াল তখন ওকে দেখতে প্রথম দিনের মতোই কামুকতা পরিপূর্ণ লাগছিল। গাউন এর এক পায়ের উচ্চ চেরা তার ধবধবে সাদা থাই দেখা যাচ্ছে । অরুনিকার এমন রূপ ধারণে রণক হতভম্ব হয়ে যায়।
—কিছুক্ষন আগেও যে মেয়েটিকে ভালোবেসে সে চুম্বন করল। সেই মেয়েটির এখনকার রূপ সে মানতে পারছে না।
—অরুনিকা আর বিশেষ কিছু না বলে হাতে র্পাস নিয়ে বেড়িয়ে যায়।
— বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রণক। সে কি বলবে! তার এই মূহুর্তের করণীয়ই বা কি?
To be continued.....
গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)
পার্ট:-১০
লেখনীতে: সামিনা সামি
0 Comments