বিপদের সমাবেশ
------------------------
গ্রামের মানুষের এমন দলে দলে ছুটে আসা দেখে রিতিকা দু’পা পেছনে গিয়ে চাপা গলায় বলল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার অন্য কোনো পথ আছে কি?
—হ্যা,আছে। কিন্তু কেন বলুন তো।
—এই মূহুর্তে উষা আর অপরা কে নিয়ে আমাদের এখান থেকে বেড়িয়ে পড়তে হবে। প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করবেন না। আর ভুলেও দিপেশ এর সাথে কনটেক্ট করবেন না। এই বলেই সে ছুটে গেলো উষার ঘরে। দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকতে একটু বিব্রত বোধ করল সে। বিবস্ত্র অবস্থায় অপরার বুকে শুয়ে আছে উষা।
—অপরা তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে উষা কে নিয়ে বাইরে আয়।আমাদের এখনি বের হতে হবে।
—রিতিকার এমন আচরণে উষা বিরক্ত হলেও অপরা বুঝতে পারে আসন্ন বিপদের কথা। বিছানা থেকে নেমে কাপড় পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে অপরা।পেছন পেছন আসে উষা। রিতিকা এর মধ্যেই উপর থেকে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে নেমে এসেছে।
—কি হয়েছে রিতিকা? মুখের কথা শেষ না করতেই বাড়ির দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা পড়ে। একজন লোক দাদাবাবু সম্বোধন করে বলে।
ছোট দাদাবাবু ভালো কইরা কইতেছি নষ্টা মেয়ে কে আমাদের হাতে তুলে দেন। গ্রামের নামডাক নষ্ট হতে দিমু না আমরা। লোকটির সাথে সাথে আরও কিছু লোক সমস্বরে বলল।ঠিক ঠিক গ্রামের নাম ডাক নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দিমু না। পঞ্চায়েত এর হাতে তুলে দেন কুলক্ষণে মেয়েটিকে। আর লগে যে বেশ্যা আছে তারেও তুলে দেন আমাগো হাতে।
—কারো বুঝতে বাকী থাকে না,উষার ব্যাপার জানাজানি হয়ে গেছে। রণক এর ফোন বেজে উঠে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে উচ্চ তীক্ষ্ণ কন্ঠে ভূমেন্দ্র সেন বললেন। উষার ব্যাপারে যা শুনতে পেলাম তা কি সত্য রণক?
—বাবা তুমি কি ভাবে জানতে পারলে?
—তার মানে ঘটনা সত্য! তোর সাহস হলো কি করে আমার বংশের মানসম্মান নিয়ে খেলা করার? যে মেয়ে বংশের মুখে চুনকালি মাখাতে পারে। তাকে মেরে না ফেলে দিয়ে তুই নিজেও বংশের মুখে চুনকালি মাখালি! গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে এমন ঘটনা অবিশ্বাস্য।
তুই গ্রামের আর্চয মশাই এর হাতে উষা কে তুলে দে। আমি আসতেছি। এমন অশ্লীল কাজ যে করবে, সে-ই শাস্তি পাবে। সমাজের নিয়ম কানুনের বাইরে গিয়ে সমাজ নষ্ট করতে দিতে পারিনা। আমার মেয়ে বলে সে রেহাই পাবে না। পঞ্চায়েত বিচারে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
—বাবা তুুমি নিজের মেয়ে সম্পর্কে কথা বলতেছ। তোমার রাজনীতির কোন মহড়া উষা না। আমার বোন একা সমকামী না। পৃথিবীতে অনেক এমন ছেলে-মেয়ে আছে যারা সমকামী। অশ্লীল সে কিছুই করেনি।তোমরা গ্রাম পঞ্চায়েত এর নামে নির্যাতন কর। সে কি আমার জানা নেই। সমাজের এমন নোংরা নিয়ম কানুন অসহায় মেয়ে-ছেলেদের উপর চাপিয়ে দিয়ে, তাদের জীবন ধ্বংস করছ তোমরা দিনের পর দিন। সমাজের নাম নিয়ে মানুষ এর উপর জুলুম বন্ধ কর। গোপনে নিজেদের কুকীর্তি কথা ভেবে দেখ। কারা সমাজ নষ্ট করছে নিজেরাই বুঝতে পারবে।
—আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস তুমি কোথায় পেলে।তুমি যদি নিজে শাস্তি পেতে না চাও তাহলে যা বলেছি তাই করো রণক। বাড়িতে পতিতা এনেছ একটা অশ্লীল দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য। বাড়ির মানসম্মান আর রক্ষা হলো না। তোমার এমন কাজ এর জন্য, তুমিও শাস্তি যোগ্য। আমার বংশের একমাত্র বংশধর তুমি না হলে আজ তোমারও পঞ্চায়েতে বিচার হতো। আমি আর্চয মশাই এর কাছে ফোন দিচ্ছি। আমি আসার আগ পযন্ত গ্রাম বাসী কে শান্ত করার দায়িত্ব উনার। তুমি নিজের ভালো চাইলে যা বলছি তাই করো।
—ফোন রেখে দিতেই উষা দৌড়ে এসে বলল। কিরে দা-ভাই বাবা কি বলল?
—রণক অসহায় মুখে কিচ্ছুক্ষণ উষার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল। আমি আর তোকে রক্ষা করতে পারব না।
—রিতিকা এসে উষার হাত ধরে বলল, আর সময় নষ্ট করবেন না। এখুনি বেড়িয়ে পড়তে হবে। উষা যদি একবার গ্রাম বাসীর হাতে পড়ে তাহলে ওর জীবন একেবারে শেষ হয়ে যাবে। গ্রাম পঞ্চায়েত খুব খারাপ।
—রণক এক মূহুর্ত কী যেন ভেবে সে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে এসে বলল,আসুন আমার পেছন পেছন।
—বাড়ির ভেতরে পেছন সাইডে গ্যারেজে যাওয়ার একটা দরজা আছে। আমাদের গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেড় হতে হবে এখান থেকে। কথা বলতে বলতে গ্যারেজে এসে থমকে দাঁড়ায় রণক। জানালা দিয়ে দেখতে পায় গ্যারেজ এর বাইরেও অনেক মানুষ।
—উষা ভয় পেয়ে অপরা কে জড়িয়ে ধরে। হতবুদ্ধি হয়ে রণক দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এই দিকে ধীরে ধীরে বাইরে মানুষের শোরগোল বেড়েই চলছে। দরজা ভেঙে ঢুকবে এমন অবস্থায় রিতিকা বলে উঠলো। আমি সামনের গেট দিয়ে বের হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতর এইদিককার মানুষ এর সমাগম কমে যাবে। এই সুযোগে আপনি বেড়িয়ে যাবেন।
—অপরা উত্তেজিত হয়ে বলল।কি বলছিস রিতিকা!তুই এখানে থাকলে কি হবে বুঝতে পাচ্ছিস?
—রিতিকা তাচ্ছিল্য সুরে বলল, বেশি কিছুই হবে না। আমাকে বড়জোর সন্ধ্যা পযন্ত আটকে রাখবে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসলেই কেউ না কেউ আমার সাথে শুইতে আসবে।একবার বিছানায় গেলেই আমি অন্ধকারে পালানোর সহযোগিতা করার মানুষ পেয়ে যাব। রণক এর দিকে তাকিয়ে বলল, আর বেশি দেরি করা উচিত হবে না। আমি আপনার জন্য অনেক বড় রিস্ক নিচ্ছি। টাকাটা রাজিব এর হাতে না দিয়ে অপরার হাতে দিবেন। রণক অবাক হয়ে রিতিকার কথা শুনছে। নিজের বাবা-মা যেখানে পাশে নেই। সেখানে একটা পতিতা তার বোনের জন্য এতকিছু করছে। রিতিকা অপরার দিকে তাকিয়ে বলল। আমার বাড়িতে আবার যেন যাসনে। ওই টাকা দিয়ে তুই তোর একটা ব্যবস্থা করে নিবি।
—সময় নষ্ট না করে, রিতিকা আবার ভেতরে চলে যায়। বাড়ির মেইন দরজায় এসে ভেতর থেকে উচ্চ গলায় ব'লে, বাড়িতে তো এখন কেউ নেই। রিতিকার গলার আওয়াজ বাইরে পযন্ত গেল কি না বোঝার উপায় নেই। কারণ বাইরের হৈচৈ এর শব্দে রিতিকা নিজেই নিজের কন্ঠ শুনতে পাইনি। বড় করে নিশ্বাস নিয়ে রিতিকা দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ভেতরে সবাই ঢুকে পড়ে। আর কয়েকজন এসে রিতিকার দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখে। এদের ভেতর একটা মেয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কেমন আছ মিস অরুনিকা? সেই তো ফাঁদে পা দিয়েই ফেললে।
—কথাটা কানে পড়তেই শিউরে ওঠে রিতিকা। এই কন্ঠ তার চেনা। রিতিকা উত্তেজনা নিয়ে বলল, কে!কে ফিরোজা?
— মুখ ফুটে আর কথা বলার সুযোগ সে পাইনা কারণ ততক্ষণে কেউ একজন তার মাথায় সজোরে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। রিতিকা যখন জ্ঞান হারিয়ে নেতিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, তখন সে অস্ফুটস্বরে বলল কে নাজিয়া খালার মেয়ে ফিরোজা!
—গ্রামের লোকজনের ছদ্মবেশে আসা কিছু লোক, ভিরের সুযোগ নিয়ে রিতিকা কে তুলে নিয়ে চলে যায়। গ্রামের মানুষজন যখন বাড়ির ভেতর ঢুকে তন্ন তন্ন করে উষা আর পতিতা-দের খুঁজতে ছিল, সেই সুযোগে গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যায় রণক বোন উষা আর অপরা কে নিয়ে।
—গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় রণক বার বার লুকিং গ্লাসে ফেলে আসা লোকজনের ভিড়ে রিতিকা কে একপলক দেখার শেষ চেষ্টা করছিল। একজন পতিতা হয়ে যে এত বড় মনের পরিচয় দিতে পারে এই সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না রণক এর। সে সব সময় পতিতা-দের কে সমাজের নিকৃষ্ট কীট বলেই মনে করত।
—রণক কে বারবার লুকিং গ্লাসে তাকাতে দেখে অপরা বলল। রিতিকা কে নিয়ে ভাবতে হবে না। এর আগেও গ্রামের লোকজন এর এমন হট্টগোল সে দেখেছে। পঞ্চায়েতর বিচারের পুড়ে মেরে ফেলার শাস্তিও হয়েছিল ওর। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেই পঞ্চায়েত প্রধান অরুনিকা কে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাবে এক রাত কাটানোর কথা বলে। পুরুষ সমাজ কি তা রিতিকা জানে, তাই এত চিন্তা করার কোন কারণ নেই। রাতের অন্ধকারে কারো না কারো সাথে শুয়ে গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে রিতিকা।
—অপরা কথা শুনে রণক অবাক হয়ে যায় অবলীলায় এরা পুরুষের সাথে শুয়ার কথা বলে বিন্দুমাত্র ইতস্তত বোধ ছাড়াই। রণক অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে অপরার দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করে। অরুনিকা কে? আর এর আগের ঘটনা টা কোন গ্রামের?
—রিতিকার আসল নাম অরুনিকা। এই পেশায় আসার পর বাবা-মায়ের ভালোবাসার নাম অরুনিকা পাল্টে হয়ে যায় রিতিকা। কোন গ্রাম তা সঠিক জানা নেই। রিতিকা ওর গ্রামের বাড়ির সম্পর্কে কখনো কিছুই বলেনি।
—ওয়েট ওয়েট, আপনি বলতে চাচ্ছেন উনার নিজ বাড়ি ছিল? আর এর আগের গ্রাম পঞ্চায়েত এর যে ঘটনা তা উনার নিজ গ্রামে!
—হ্যা, নিজ গ্রামের ঘটনা। কার আবার নিজের বাড়ি থাকে না? আমরা কি জন্ম থেকেই পতিতা নাকি! আমাদের জীবনে বেশিরভাগেরই এমন গ্রাম, পাড়া, মহল্লা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা থাকে। একেক জনের গল্প একেকরকম হলেও গ্রাম,পাড়া,মহল্লা থেকে বিতাড়িত এটা কমন।
—কথাটা শুনে রণক আর কোন কথা বলতে পারে না। মনে মনে চিন্তা করল, এতদিন তার চোখে এই পেশার নারীদের নিয়ে যে দৃষ্টি ছিল। আজ তা ভুল প্রমাণিত করল রিতিকা মেয়েটি।
আজ যদি এই মেয়েটি না থাকত, হয়তো উষার জীবনেও গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার একটি গল্প যোগ হত।
—অপরা জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল। ভারতের মেয়েরা বিংশ শতকেও স্বাধীন হতে পারেনি। আজও গ্রামে গ্রামে মেয়েদের বিনাদোষে জীবন্ত পুড়ে মারা হয়।বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মেয়ে জন্মেছে শুনেই পুঁতে ফেলার হুকুম দেওয়া হয় কিছু গ্রামে। পতিতা-দের ঘরে যে সব নিস্পাপ শিশুর জন্ম হয় তারা কি কখনো বেড়িয়ে আসতে পারে! হয়তো পারে আর যারা পারে না তারা পরাজিত। যেমন আমি। এই সব মেয়ে যদি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেহ-পসারিণী খাতায় নাম লেখায় এতে কি দোষ সেই মেয়েদের!
অন্ধকার স্যাঁতসেঁথে ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রিতিকা। দড়িতে হাত-পা বাঁধা তার। জ্ঞান ফিরে আসতেই উঠে বসার চেষ্টা করে সে। মাথার পেছনে ব্যাথায় চোখে ঝাপসা দেখছে ।
—ওহ তো মিস অরুনিকা জ্ঞান ফিরেছে! মুঝে তো লাগিথি, এক মারছে তু উপার চাল বেঠি।
—সামনের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রিতিকা অস্ফুটস্বরে বলল, ফিরোজা।
—একদাম কারেক্ট পেহচ্যানা মেরি জান।
—আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস ফিরোজা? আমাকে ছেড়ে দে। আমরা বসেও কথা বলতে পারি।
—ফিরোজা নরম সুরে বলল, ডার্লিং কোথাই তুমি! একটা চেয়ার নিয়ে আসতো।
—দিপেশ চেয়ার নিয়ে এসে ফিরোজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, সরি ডার্লিং। তোমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি!
—দিপেশ কে দেখে রিতিকা মোটেই অবাক হয়নি। আগে থেকেই সে অনুমান করেছিল। রণক এর বোন এর সাথে যা কিছু হচ্ছে, তার সাথে দিপেশ জড়িয়ে। কিন্তু সে অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে এটা ভাবছে। ফিরোজা আর দিপেশ এর মাঝে কিসের সম্পর্ক! এরা একে অপরকে কীভাবে চিনে? রিতিকা আর ভাবতে পাচ্ছে না, মাথাটা মনে হয় ব্যাথাই ফেটে যাচ্ছে।
—ফিরোজা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল।আরেহ না ডার্লিং, আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। অরুনিকা বসে কথা বলতে চাইল তাই আর কি। তুমি দেখছি খুব পঁচা দিপেশ। আমার জন্য শুধু চেয়ার নিয়ে আসলে, আমাদের অতিথির জন্য আনলে না কেন?
—এখুনি নিয়ে আসছি ডার্লিং।
—রিতিকা অস্ফুটস্বরে বলল, ফিরোজা তুই ভালো করেই জানিস আমি বসে কথা বলতে কি বুঝিয়েছি। তুই পাগলামি করিস না। আমারা আমাদের ভেতর এর সমস্যা মিটিয়ে নিলেই ভালো।
—আগুনে ঘী পড়বার মতোই দপ করে জ্বলে উঠে ফিরোজার চোখ। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লাথি মেরে চেয়ার ফেলে দিয়েই চেঁচিয়ে বলে, দিপেশ কোথাই তুমি তাড়াতাড়ি এসো।
—দিপেশ ফিরে আসল এক হাতে চেয়ার নিয়ে অন্য হাতে স্টেপস।
—স্টেপস দেখে রিতিকা আৎকে উঠে। ফিরোজা তুই কি করতে চাচ্ছিস! প্রতিশোধের আগুনে কারো কখনো ভালো হয়নি। আমি নাজিয়া খালাকে হত্যা করিনি। বিশ্বাস কর আমার কথা।
—দিপেশ এই বেশ্যার খেদমত এর ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি। আমি আর এই মাগীর মুখের কথা সহ্য করতে পাচ্ছি না। শালীর মুখ দিয়ে শুধু চিৎকার এর আওয়াজ যেন বেড় হয়। আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে। এই খানকি মাগী যে ভাবে মা কে মেরেছে তার শতগুণ ভয়ংকর মৃত্যু দিব আমি ওকে।
— দিপেশ ফিরোজা কে বুকে টেনে নিয়ে বলল, অক্ষরা শান্ত হও। তোমার অন্তরাত্মা আজ খুশিতে নেচে উঠবে দেখে নিও তুমি। তোমার জন্যই সব ব্যবস্থা করেছি আমি।
—রিতিকা আরও বেশি অবাক হয়ে যায় অক্ষরা নাম শুনে। তার মানে ফিরোজা দিপেশর অক্ষরা। সব কিছুই যেন গোলকধাঁধার মতো লাগছে। রিতিকা কিছুটা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে পেছনের দিকে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
—দীপেশ রিতিকাকে চেয়ারে বেঁধে ফেলে স্টেপসে আটকে দিয়ে।
—ফিরোজা হাতে ইচেনোক্যাকটাস নিয়ে রিতিকার দিকে এগিয়ে আসে।
—ফিরোজা তুই কি করতে চাচ্ছিস! এমনটা করিস না, আমাকে ছেড়ে দে। নিজেকে ছাড়ানোর সব ব্যর্থ চেষ্টা করে রিতিকা।
—ইচেনোক্যাকটাস হাতে রিতিকার কাছে এসেই নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে রিতিকার যোনি তে আঘাত করে।
—রিতিকা ডুকরে কেঁদে উঠে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় সে। ইচেনোক্যাকটাস এর কাঁটা যোনির লেবিয়া মাইনরা, ক্লিটোরিস ও আশেপাশের অংশগুলো বিদ্ধ হয়ে অঝোরে রক্ত ঝড়ে পড়ছে। ব্যাথায় হাত-পা ছোটাছুটি করতে করতে চেয়ার সহ উলটে পড়ে যায় রিতিকা।
—রিতিকার ব্যাথায় ছটফটানি দেখেও, মনে শান্তি আসে না ফিরোজার। চোখে জ্বলা আগুন নিভে না। রিতিকার চিৎকার যেন আগুনে ঘী ঢালছে। পাগলের মত ভেতরে ছুটে গিয়ে হাত লবণ নিয়ে ফিরে আসে ফিরোজা।
—রিতিকা দিপেশ এর দিকে তাকিয়ে বলে। আমি আপনার কোন ক্ষতি করিনি, আমাকে বাঁচান। এই মেয়ে তার মায়ের মতই পাষাণ।
—ফিরোজা চেঁচিয়ে বলে, মাগী আমার মা পাষাণ ছিল! যে তোকে থাকার জায়গা দিল, অন্ন দিল, খদ্দের দিল তুই তাকেই মেরে ফেলে আজ বলছিস সে পাষাণ ছিল। তোর শরীর সব তেজ আজ বেড় করব বলেই যোনি প্রবেশমুখে লবণ দেয়।
***
—দিপেশ দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুধু দেখছে। ফিরোজা মেয়েটির সাথে তাঁর পরিচয় হয় বছর তিনেক আগে। নিষিদ্ধ পল্লীতে পছন্দসই মেয়ে খুঁজতে গিয়ে ফিরোজার সাথে দেখা। ফিরোজার সাথে কথা বলার সময়, ওর চোখে প্রতিশোধের যে আগুন দেখতে পেয়েছিল দিপেশ। সেই আগুন দিপেশের চোখে জ্বলছে ছোট বেলা থেকেই। ফিরোজা ভালোবাসে তাকে। কিন্তু দিপেশ ভালোবাসে অক্ষরা কে। অক্ষরা আর ফিরোজার মাঝে একটা অদ্ভুত মিল আছে।ওরা দুজনেই জেদ মিটাতে পাগলামি করে। কারো পরওয়া করে না। অক্ষরা আজ এই পৃথিবীতে নেই, দিপেশ এর ভালোবাসা পেতে ফিরোজা অক্ষরা নামে তার সাথে তালে তাল মিলিয়ে পথ চলছে। প্রতিশোধের স্পৃহায় দুজন মানুষ আজ কাছাকাছি। ফিরোজার পাগলামি দেখে দিপেশ এর চোখে দপ করে আগুন জ্বলে উঠে। সে নিজেও এমন পাগলামি করতে চায়। ভূমেন্দ্র সেন এর বংশের মান-সম্মান, মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায়।
****
—দিপেশ কি হলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো? সিগারেট নিয়ে আসো। মাগীর যোনিতে জ্বলন্ত সিগারেট ঢুকিয়ে দাও। কে কোথাই আছিস, আয় আজকে এই পতিতার শরীর খুবলে খুবলে খেয়ে নে।
—রিতিকা ইতিমধ্যে দুইবার জ্ঞান হারিয়েছে। দিপেশ এসে ফিরোজার কথা মতো জ্বলন্ত সিগারেট রিতিকার যোনি তে ঢুকিয়ে দেয়। রিতিকা দাপাদাপি করা দেখে, খিলখিল করে হাসে ফিরোজা।
—রিতিকার গলা দিয়ে আওয়াজ বেড় হয় না। শরীরের সব শক্তি দিয়েও সে নিজেকে স্টেপস মুক্ত করতে পারেনা। চারিদিকে রক্তে মাখামাখি।রিতিকা অস্ফুটস্বরে বলল, আমি নাজিয়া খালা কে হত্যা করিনি। আমি শুধু তার মৃত্যুর সুযোগে ওই নরক থেকে বেড়িয়ে এসে ছিলাম। আমি মারিনি। আমাকে ছেড়ে দে বলতে বলতে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
***
কলকাতায় ফিরে এসে একটা হোটেলে উঠে রণক তার বোন উষা আর অপরা কে নিয়ে। রাত সাড়ে বারোটা। এখনো কোন খোঁজ নেই রিতিকার। কথা ছিল গ্রাম থেকে সন্ধ্যাই বেড়িয়েই আগে ফোন দিবে। আসার সময় নিজের ফোন টা অপারার হাতে দিয়েছিল।
ইতিমধ্যে রাজিব ফোন দিয়েছে বেশ কয়েকবার। অপরা ভয়ে রিসিভ করেনি। একটা সময় সে নিজেও রাজিব এর আন্ডারে ছিল। নাজিয়া খালার রুপাগাছি নিষিদ্ধ পল্লী থেকে বেড়িয়ে আসার পর রিতিকা আর অপরা দুজনে ভালো হয়ে জীবন-যাপন করার অনেক চেষ্টায় করেছে। কিন্তু এই পুরুষ শাসিত সমাজে একলা নারী সবাই পতিতা সমতুল্য। সুযোগ পেলেই এদের শরীর এর উপর হানা দেয় নেকড়ের দল। অপরার একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়।
সেই সময় রিতিকা আর অপরা কুমোরটুলি পাড়ার বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নেয়। দুজনেরই একটি শপিংমলে চাকরিও জুটিয়ে যায়। প্রথম প্রথম ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের ।বিপত্তি ঘটে তখন, যখন হটাৎ একদিন সেই শপিংমলে দেখা হয় পুলিশ বাবুর সাথে। যে পুলিশ বাবুর জন্য রিতিকার কপালে টানা তিন দিন ভাতের বদলে জুটেছিল কিল-ঘুষি। পুলিশ বাবু এসেই আড়ালে রিতিকার কোমড়ে হাত দিয়ে বলে, তুই খাসা মাল আছিস।
—রিতিকা কষে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, শালা ভাগ হারামজাদা। তু নিজেও তো রুপাগাছি তে গিয়ে বসতে পারিস। ওখানে অনেক মদ্দার খদ্দেরও আসে।
—পুলিশ বাবু ক্ষেপে গিয়ে শোরুমে মালিক এর কাছে গিয়ে রিতিকার রুপাগাছির অতীত সম্পর্কে সব কিছু বলে দেয়।
—মালিক সব কিছু শেনার পরও সেদিন কিছুই বলে না দেখে, রিতিকা আনন্দিত হয়ে পরের দিন কাজে যায়।
—রাতে শোরুম বন্ধ করার সময় পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে শোরুমের মালিক। রিতিকা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সেই রাতে সে এই পুরুষ শাসিত সমাজের ভেতর পুনরায় ধর্ষিত হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে রিতিকা প্রতিবাদ করলে, ওকে চোর অপবাদ দিয়ে বেধড়ক মার মারা হয়।
—এমন আর-ও কত কথাই যে মনে পড়ে তার হিসেবে নেই। জীবন তাদের ঢেউ এর ধাক্কায় নিয়ে এসে ফেলে রাজিব এর কাছে। রিতিকা আর অপরার জীবনে রাজিব এর প্রবেশ ছিল আলোর দুনিয়ায় অন্ধকারের প্রতিক স্বরূপ। রাজিব এর সাথে পরিচয় অবশ্য প্রথম অপরার হয়। অপরা ভালো ভেবে পরিচয় করে দিয়েছিল রিতিকার সাথে। প্রথম প্রথম তাঁরা হোটেলে ওয়েটার এর কাজ করত। অপরা আর রিতিকা ভেবে ছিল তাদের জীবনের সব সত্য জেনেও যে মানুষ তাদের কর্ম দিয়েছে। হয়তো উনি সত্যি ভালো মানুষ। এমন মানুষ ভগবান সমতুল্য। কিন্তু পরবর্তী তে দেখা গেল এই ভগবান তাদের জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো। পরবর্তীতে রাজিব হলো তাদের খদ্দের আনার দালাল।
To be continued.....
গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)
পার্ট:-০৪
লেখনীতে: সামিনা সামি
.jpg)
0 Comments