Header Ads Widget

Responsive Advertisement

নিষিদ্ধ নারী - পার্ট ৫

 ভূমেন্দ্র সেন ও তার স্ত্রী দিলাত্রী সেন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই দিপেশ এর খোঁজ করলেন। মাথায় রক্ত উঠে আছে ভূমেন্দ্র সেন এর। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের ঘরে এমন কলুষিত ঘটনা তার মাথা হেট করে দিয়েছে। মিডিয়া চারিদিকে উষার ব্যাপারটা নিয়ে মাতামাতি করছে।

দিপেশ এর দ্বারাই আচার্য মশাই কে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন ভূমেন্দ্র সেন।
—আচার্য মশাই এসে অনেকটা সময় ধরেই বাইর ঘরে বসে আছে। ভূমেন্দ্র সেন চোখ বুঝে হুকা টানছেন। পুরো ঘর বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়াই ভরে উঠেছে।
ধোঁয়া থেকে গন্ধ শুঁকছে আচার্য মশাই। আর বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে ভূমেন্দ্র সেন এর দিকে। এই ভাবে বসে বসে হুঁকা টানা দেখতে আজ রাগ হচ্ছে তার। অন্য কোন দিন হলে আচার্য ধোঁয়া গন্ধ শুঁকেই আনন্দিত হত।



— হুকা হলো মালিকের সম্পদ ও বিলাসিতার পরিচায়ক। ভূমেন্দ্র সেন যে বিত্তবান মানুষ তা তার চালচলন দেখলেই বোঝা যায়। অহংকারী মানুষ। দেমাকে মাটিতে পা না ফেলার মতো একটা মানুষের সামনে বসে হুঁকার ধোঁয়া গন্ধ শুঁকাই গৌরবের ব্যাপার আচার্য মশায়ের কাছে। কিন্তু আজ আনন্দিত হতে পাচ্ছে না আচার্য মশাই।
—ভূমেন্দ্র সেন এর ছিলিম তৈরির ক্ষেত্রে তার সম্পদ ও বিলাসিতার পরিচয়ও বেশি প্রদর্শিত হতো।
আচার্য জানত না ছিলিম তৈরিতে কি কি ব্যবহার হয়।
—একদিন হুঁকা টানতে টানতে ভূমেন্দ্র সেন বললেন।বুঝলে আচার্য আমার হুঁকার ছিলিম তৈরি তে অনেক মূল্যবান জিনিস ব্যবহার হয়। তামাক, চিটা গুড়, মদ, সুগন্ধিযুক্ত নির্যাস, ফল এবং মসলার মিশ্রণ। ভাবতে পাচ্ছ আচার্য! কতটা রাজকীয় আয়োজনে আমার ছিলিম তৈরি হয়।
এরকম রাজকীয় ছিলিমের উদ্দেশ্য কি বলতে পার?
— এই সব বড় বড় ব্যাপার স্যাপার কম বুঝি প্রধান। যদিও আচার্য মশাই মনে মনে বলে, বড়লোকি চাল দেখানোই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু মুখে বলে,আজ্ঞে না প্রধান।
—ভূমেন্দ্র সেন গোঁফে হাত বুলিয়ে হেসে বলে, লোকজনকে নিজের বৈভব দেখিয়ে বিমোহিত করা এর উদ্দেশ্য। হুঁকা ব্যবহার প্রভাবশালী ব্যক্তির আভিজাত্য ও পদমর্যাদা প্রদর্শনের বস্তু বুঝলে। হুকায় তামাক পরিবেশন নিম্নমানের হলে ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। আমি হলাম গ্রাম্য প্রধান। আমার পদ মর্যাদা ক্ষুন্ন করা যায় কি!
—আচার্য মশাই কথার তালে তাল মিলিয়ে হ্যা ঠিকই তো। আপনার আভিজাত্যের প্রদর্শন না করলে পদ মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। মুখে মুখে প্রশংসা করলেও, আচার্য মশাইয়ের বহুদিন এর সখ এই রাজকীয় হুঁকা টানার। সম্মান দেখাতে গিয়ে কখনো বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
আজ আর সম্মান আসছে না ভেতরে। বাইরে যার এতো দাপট। সে নিজের ঘরের মেয়ে কে সামাল দিয়ে রাখতে পারেনি।
তাই আজ আর গন্ধ শুঁকে মন ভরাতে পাচ্ছে না আচার্য মশাই। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আচার্য মাশাই শেষ পর্যন্ত বললেন। প্রধান, মাথাটা আজ ঠিক নেই। আমার জন্যেও এক ছিলিম এর ব্যবস্থা করেন।
—ভূমেন্দ সেন চোখ মেলে তাকালেন। রক্ত বর্ণ হয়ে আছে সেই চোখ। কিছুক্ষণ আচার্যের দিকে তাকিয়ে থেকে দিপেশ এর উদ্দেশ্য বলল, ছিলিম তৈরি করে আন। মনে মনে ভূমেন্দ্র সেন ভাবলেন, অসময়ে চামচিকেও লাত্থি মারে। আবার চোখ বুঝে হুকাতে মনোযোগ দিলেন।
—দিপেশ ছিলিম তৈরি করে নিয়ে এসে আচার্য মশাইকে দিলেন। দুজনের হুঁকা টানের বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়াই পুরো ঘর ভরে উঠে। দিপেশ এর মুখে হাসি ফুটে উঠে। যে পদ মর্যাদার গৌরব ছিল ভূমেন্দ্র সেন এর আজ তার পতনের শুরু। সামান্য এক আচার্যের সাথে বসে হুঁকা টানছে।
—ভুমেন্দ্র সেন নিরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, পুরো গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দাও আচার্য। গ্রামের যে কেউ উষাকে জীবত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসতে পারবে।তাকে একলক্ষ টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। পুরো গ্রাম সমক্ষে উষাকে জীবত পুরানো হবে। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।
*****
রিতিকার শরীরে নড়াচড়া করার মতো শক্তিটুকুও নেই। ভাড়া করা লোক ফিরোজার হুকুমে রিতিকার সাথে হিংস্রতা দেখিয়ে যৌন সঙ্গম করছে রাত-দিন. চোখের পাতা খোলা রাখার শক্তিও এখন রিতিকার নেই। অবস্বাদ শরীরে ঘুম আসে বারংবার। তখনই শুরু হয় আবার নির্যাতন।
ফিরোজা এসে বরফ পানি ঢেলে দেয় রিতিকার শরীর এর উপর। রিতিকা কেঁপে ওঠে। দেখতেই দেখতে রিতিকার শরীরে খিঁচুনি ওঠে। একটা সময় গিয়ে সব নীরব হয়ে যায়।ফিরোজা কাছে গিয়ে নাকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। রিতিকার নিশ্বাস পড়ে না। ফিরোজা রাগে গড়গড় করতে করতে রিতিকার মাথায় এলোপাতাড়ি লাথি মারে। পাগলের মত চেচামেচি শুরু করে দেয়। দিপেশ দৌড়ে এসে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
—রিতিকা মরতে পারে না। আমি ওকে আরও নির্যাতন করব। আমার মায়ের আত্মা শান্তি পায়নি। ও আমার মাকে নিশংস ভাবে খুন করেছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ফিরোজা। দিপেশ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায়। ভাড়া করা লোকজনদের রিতিকার বডি গ্রামের পাশের জঙ্গলে ফেলে দেওয়ার হুকুম করে।
—রিতিকার বডি তুলে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে নদীর ধারে ফেলে দিয়ে চলে যায় সবাই। ঝকঝকে রৌদ্রময় আকাশের নিচে নিস্তব্ধ জঙ্গলে নদীর ধারে পড়ে থাকে রিতিকা।
*****
রণক পেপার ওয়ার্ক এর কাজে ব্যস্ত। হটাৎ করেই রিতিকার কথা মনে পড়ে যায় তার। বুকে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। মেয়েটির জন্য গ্রাম থেকে উষা কে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে সে। কিন্তু আজ তিনদিন হয়ে গেলো। এখনো কোন খোঁজ নেই মেয়েটির। রণক এর মনে পড়ে সেই রাতের ঘটনা যখন রিতিকা তাকে চুম্বন করেছিল। তখন কার অনুভূতি রণক হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারে না। ট্যাক্সি তে বসে হোটেল এর উদ্দেশ্য রওনা হয় রণক। হোটেল এর কাছাকাছি আসতেই লক্ষ করে দিপেশ বাইরে দাঁড়িয়ে। দিপেশ এর দিকে যেতেই , রণকের হটাৎ করেই রিতিকার কথা মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সর্তকতা অবলম্বন করে সে। রণক এর মনে পড়ে সে বড় একটা ভুল করেছে এই হোটেলে উঠে। সত্যি যদি সব কিছুর পেছনে দিপেশ থেকে থাকে তাহলে এই হোটেলে তাদের খুঁজে বের করা খুবই সহজ। কেননা সব সময় দিপেশের সাথে রণক এই হোটেলেই উঠে। সময় নষ্ট না করে আড়ালে গিয়ে অপরার কাছে ফোন দেয়।
—হ্যালো!
—অপরা আমি রণক। আপনি উষা কে নিয়ে এখনি লোকচক্ষুর আড়ালে বাইরে চলে আসেন। আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।
—অপরা ফোন রেখে চিন্তায় পড়ে যায়। লোকচক্ষুর আড়ালে তারা কি ভাবে হোটেল এর বাইরে যাবে! কি যেন ভেবে হোটেলে রিসিপশনে ফোন দিয়ে রুম সার্ভিসের লোক ডেকে নেয়। এর পর সেই লোকের মাধ্যমে বোরখার ব্যবস্থা করে বেড়িয়ে পড়ে তারা। বাইরে যখন তারা যাচ্ছে তখন গেইটে দিপেশ কে দেখে থেমে যায় অপরা।
—তুমি কি দিপেশ দাদা কে দেখে ভয় পাচ্ছ অপরা? তুমি কি ভুলে গেলে আমরা বোরখা পড়ে আছি!
—উষার কথা শুনে অপরার মনে পড়ে। হ্যা, তাইতো ভয় কেন পাচ্ছে সে। এরপর তারা যখন দিপেশকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, তারা তখন শুনতে পায় দিপেশ এর কথা।
—বডি ফেলে দিয়ে এসেছি পাশের জঙ্গলে। তোমার কোন টেনশন নেই। কাকপক্ষীও জানতে পারবে না ওখানে কারো বডি পড়ে আছে। ওই জায়গায় মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। বছরের একেকবার দূর দূরান্ত থেকে ভ্রমনে আসে মানুষজন। তাই এই খবর লিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
—কথাটা কানে আসতেই পাথরের মূতির মতো শক্ত হয়ে যায় অপরা। তবে কি রিতিকা পৃথিবীতে আর নেই! ভগবান কি তবে মেয়েটার শেষ রক্ষা করলো না। চোখ দিয়ে হু হু করে জল নেমে আসে। উষা অপরা কে ধরে হোটেলের বাইরে চলে আসে। বাইরে এসে রণক কে ফোন দেয়। রণক ট্যাক্সির ভেতরে বসে ছিল। হাতের ইশারায় ট্যাক্সি তে উঠতে বলে। যখন তারা ট্যাক্সি উঠছে তখন খেয়াল করলো গ্রামের অনেক গুলো মানুষ হোটেলে এর ভেতর ঢুকছে। এতে রণক শিউর হয়ে যায় সব কিছুর পেছনে আসলে দিপেশ ছিল।
এই বুঝি দম বেড়িয়ে যায়। ফিরোজার ভাড়া করা লোকগুলো চোখের আড়াল হওয়ার আগেই নিশ্বাস ছাড়ে রিতিকা। খোলা আবহাওয়াতে এসেই প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। জীবন বাঁচাতে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল আজ সে।
—শয়তানের কবল থেকে রক্ষা পেতে যে, শয়তানের শেখানো টেকনিক কাজে লাগাতে হয়। আজ তা যেন অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হলো।
—রিতিকা উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীরে তার সেই শক্তিটুকুও নেই।সে নিজের বিবস্ত্র শরীরের দিকে একবার তাকায়। চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে। অজস্র আঘাতের চিহ্ন। এ যে নারীর দেহ, ক্ষত-বিক্ষতের আড়ালে তা যেন লুকিয়ে গেছে। আকাশ পানে চেয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে রিতিকা। আর তারপর মুচকি হাসে। ফিরোজার করা বোকামির উপরই যেন ভিষণ হাসি পায় তার।
— জনমানবশূন্য নদীর পাড়ে পড়ে থেকে হাসতে হাসতে রিতিকা বিড়বিড় করে বলে। শয়তানের হাতে মৃত্যুর থেকে প্রকৃতির কোলে মৃত্যু অনেক ভালো। তাই ভগবান এর কাছে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চায় সে।
—চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দূর থেকে টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে। শুকনো পাতার মর্মর আওয়াজ ভেসে আসে কানে। কেউ আসছে এইদিকে। রিতিকার বুক কেঁপে ওঠে। ওরাই আবার আসছে না তো! না ওরা কেন আসবে? মৃত ভেবে ফেলে দেওয়া লাশের কাছে তো কারও ফিরে আসার কথা না! নাকি ফিরোজা জানতে পেরেছে! নাজিয়া খালার শেখানো টেকনিকে আজ ওর থেকেই রেহাই পেয়েছি। হায় ভগবান, রক্ষে করো। ভগবান এর নাম নিতে নিতে রিতিকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
*****
অপরার বিলোপ দেখে রণক নিজেকে অপরাধী মনে করে। উষার দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তা করে। আজ তার বোনের জন্য একজন অসহায় মেয়ে নিজের প্রাণ দিল। রণক এর বুকে চিনচিন করে ব্যথা করে। জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় রণক। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা খুলে দিতেই জলের ঝাপটা এসে মুখে লাগে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ভূমেন্দ্র সেন এর উপর রাগ হয় রণকের। বংশ মর্যাদা রক্ষা করে, গ্রামের প্রধান হতে গিয়ে কত নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ যে কেড়ে নিয়েছে এই মানুষটি। আজ নিজের মেয়েকেও ছাড় দিল না। মেয়েকে মারতে না পারার রাগে এক অবহেলিত নারীর জীবন কেড়ে নিতেও কুন্ঠাবোধ করলো না।
আজ নিজেকেই ঘৃণিত মনে হয় রণকের। এমন পাষন্ডের ঘরে জন্মেছে বলে।
—অপরাকে নিয়ে উষা ব্যস্ত। তাই কেউ খেয়ালই করলো না। দুই-দিন আগে দেহ-পসারিণী বলে যাকে ঘৃণা করতো রণক। আজ সেই দেহ-পসারিনী জন্যই চোখ ছাপিয়ে জল নেমেছে তার হু হু করে।
****
ঘরের ভেতর পায়চারি করছে দিপেশ। মাথা কাজ করছে না। পুরো হোটেল তন্নতন্ন করেও রণক আর উষা কে খুঁজে পায়নি সে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে দিপেশ। ফিরোজা এসে ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে।
—দিপেশ তুমি এতো চিন্তা কেন করছো? খেলা শুরু হয়েছে সবে, এখন যদি তুমি এতো চাপ নেও। তাহলে ভুল হতে সময় লাগবে না, আর আমরা ধরা পড়ে যাবো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ভুমেন্দ্রের বংশের নাম মাটিতে গড়াগড়ি করবে। ওর এমন অবস্থা করব তোমার পায়ে এসে প্রাণ ভিক্ষে চাইবে। ধৈর্য ধরে সময়ের অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। তুমি এত টেনশন করিও না ঠিক রণকে খুঁজে বের করব আমরা। এখন তো শুধু উষার সমকামীর খবর গ্রামের মানুষ জানে। কাল সকালের গরম খবর হবে। গ্রামের প্রধান এর মেয়ে উষা, এক নিরীহ মেয়েকে যৌন নির্যাতনের পর খুন করে নিজ বাড়ির বাগানে পুঁতে রেখেছে। আমিও দেখতে চাই কি ভাবে দেশের বাইরে যায় রণক আর উষা। এই সব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।
—তুমি এখন খোঁজ নাও তো। অরুনিকার লাশ যেখানে ফেলা হয়েছে, সেখানেই আছে কি না।
—ফিরোজার কথাই নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলল, তুমি ঠিক বলেছ। এতো তাড়াতাড়ি হতাশ হলে চলবে না। এয়ারপোর্টে গিয়ে কাল খোঁজ নিব। সাথে ওদের ডাক্তারকেও আমাদের হাতের মুঠোয় আনতে হবে।
—আর তুমি কি পাগল হয়েছো ফিরোজা। এই অসময়ে জঙ্গলে গেলে মানুষ সন্দেহ করবে। আর এতক্ষণে হয়তো চিল শকুনে লাশ ঠুকরে খাওয়া শুরু করেছে।
—না, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে অরুনিকা মরেনি।আহ! ফিরোজা তুমি অযথাই চিন্তা করছো।
*****
প্রায় মাস খানেক পর, আজ লতিকার জ্ঞান ফিরেছে। বাড়িতে যেন হৈচৈ পড়েছে। বুড়ি ছোটাছুটি করে ডাকাডাকি শুরু করেছে। কে কোথায় আছিস, লতিকার যে জ্ঞান ফিরেছে সেই খবর টা কি কেউ এখন অব্দি পায়নি নাকি! সাবকে সাব কাম চোর হে৷ ইস ঘারমে বাহু কা কই খেয়াল নেহি রাখতা। মুঝেই সাবকুছ দেখনা পারতা হে। কুঁজো বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে নাতির ঘরের দিকে যাচ্ছে।
—তপন কিরে কিরে এখনো যে ঘুমাচ্ছিস! কত বেলা হয়েছে সেই দিকে খেয়াল আছে?
— ওহ মা আর একটু ঘুমাতে দাও না। গতরাতে ঘুম হয়নি।
—তা হবে কি করে! মাঝরাতে বাড়ি ফিরলে ঘুম তো হবেই না।
কুঁজো বুড়ি ঘরে ঢুকেই ভ্রু তে গিট্টু দিয়ে বলল, বৌমা তোমার জন্যই আমার নাতীটা দিন দিন বেয়াড়া হচ্ছে।
—কেঁলো করেছে, মায়ের চেঁচামেচি জ্বালায় ঘুম হচ্ছিল না। এখন আবার বুড়ি এসে জুটেছে। কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে তপন।
—বুড়ি চেঁচিয়ে উঠে বলে, কিরে তপন। কথা কানে যাচ্ছে না নাকি! এই যে এতো করে বলছি কারো কানেই দেখি কথা ঢুকে না। লতিকার যে জ্ঞান ফিরেছে। সে খবর কি কারো কানেই ঢুকছে না!
—লতিকার জ্ঞান ফেরার কথা কানে পড়তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তপন।
—কি বললে দীদা? সত্যি লতিকার জ্ঞান ফিরেছে!
— ওরে হ্যাঁ, লতিকার জ্ঞান ফিরেছে। তাড়াতাড়ি চল।
—তপন দৌঁড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। এক দৌড়ে সিঁড়ি ঘরে চলে যায়। দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। মনে মনে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তপন। মেয়েটিকে সুস্থ করার জন্য মাসের পর মাস সে পরিশ্রম করে গেছে। বাড়িতে নানান মিথ্যে কথাও বলেছে । যে মেয়ের নাম সে জানে না। তার একটি নাম দিয়েছে লতিকা।
—একে একে বাড়ির সবাই ঘরের সামনে এসে ভিড় জমিয়েছে। আজ যে আনন্দের দিন। বাড়ির বউ সুস্থ হয়েছে এর থেকে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে!
— কাকিয়া দৌড়ে গিয়ে ঠাকুর ঘর থেকে মায়ের পায়ের ফুল এনে লতিকার মাথায় ছুঁয়ে দেয়।
—তজশ্রী লতিকার পাশে বসে বলল, মা এখন তোমার কেমন লাগছে? তপন কেবলা কান্তের মত হা করে দাঁড়িয়ে কি দেখেছিস? বৌমা কে চেক কর।
—অবাক দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে লতিকা নামের মেয়েটি। সে স্বপ্ন দেখছে নাকি তা বুঝে উঠতে পারে না।
—তপন সবাইকে বলে, এখান থেকে এখন ভিড় কমাও। আমি ওর চেক-আপ করি আগে। তজশ্রী দূর্গা দূর্গা বলে বাইরে চলে গেল। একে একে সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে তপন দরজা লাগিয়ে দেয়।
—কাছে এসে বসে অক্সিজেন মার্কস খুলে দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চেক করতে করতে বলল, আপনার নাম কি?
—মেয়েটির এতক্ষণে মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে না।
—তপন পালস রেট চেক করে। মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে বসলো। কি হলো বললেন না যে! আপনার নাম কি?
—মেয়েটি অনেকটা সময় নিয়ে কি যেন ভেবে তারপর বলল, আমার নাম রিতিকা।

—আমি এখানে কি করে আসলাম? আপনি কি বলতে পারেন! আমাকে সবাই বৌমা কেন ডাকছে?
—তপন সহসা কিছু বলে উঠতে পারে না। তাকে যেন রাজ্যের লজ্জা পেয়ে বসেছে। লজ্জা তো পাবারই কথা। কোমায় থেকে সদ্য জেগে ওঠা মেয়েটি জানতে চাচ্ছে, তাকে কেন বৌমা বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। এই প্রশ্নের জবাবে তপন কি বলবে! আপনি আমার স্ত্রী তাই আপনাকে বৌমা বলছে। না না, তখন তো আবার প্রশ্ন করবে, বিয়ে কবে হলো! কিভাবে হলো! হাজারো প্রশ্ন। সবটা যে গুছিয়ে বলবে তারও ভাষা খুঁজে পায়না তপন।
—কোমায় থাকা এক নারীকে সে তার পরিবার এর কাছে নিজের বউ রূপে পরিচয় করে দিয়েছে। এই কথা সে কি ভাবে বিশ্লেষণ করবে।
—হসপিটালে প্রথম প্রথম যখন মেয়েটির চিকিৎসা করে তপন। তখন চারিদিক থেকেই লিগ্যাল প্রসেস ফলো করতে বলা হয় তাকে। প্রথমে পুলিশ কেইস এরপর যাবতীয় কিছুই এই প্রসেসের মাঝেই হবে। মেয়েটিকে যে অবস্থায় সে পেয়েছিল। এতে খুব সহজেই ধারণা করা যায়, মেয়েটির শত্রু অনেক। তাই তপন এর কাছে সেই সময় লিগ্যাল প্রসেস সঠিক মনে হয়নি। নিজে ডাক্তার হওয়া স্বত্বেও সে হসপিটালের প্রটোকল সাইটে রেখে শুধু মেয়েটির চিকিৎসাতে মনোযোগ দিয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন হসপিটাল রাখা নিজের ক্যারিয়ার এর উপর হুমকি স্বরূপ হয়ে দেখা দিল। তাই শেষ পযন্ত উপায় না পেয়ে, বাড়িতে নিয়ে আসে মেয়েটিকে। আর বাড়ির লোক এমন অচেনা একটা মেয়েকে জায়গা দিবে না, এটাই স্বাভাবিক।মেয়েটি কোমায় আছে, তাতে কি! তাঁরাও বলতো পুলিশ হেফাজতে দিয়ে দে। পরিবার এর কি ডিসিশন হবে, সে সম্পর্কে তার ভালো করেই জানা ছিল। তপন এর মন এসব কিছুই করতে রাজি ছিল না।তাই সে ছোট্ট প্রেমের গল্প বানায়। যে গল্পের শেষে লতিকা তার ভালোবাসার মানুষের কাছে আসতে নিয়ে এক্সিডেন্টে কোমায় চলে যায়।
—রিতিকা খেয়াল করলো। ছেলেটির মুখ লাল হয়ে উঠছে। রিতিকার কাছে সব কিছুই অদ্ভুত লাগছে। সে আসলে কোথায় আছে! যখন সে জ্ঞান হারিয়ে ছিল, তখন নদীর ধারে পড়েছিল। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর নিজেকে অন্য পরিবেশে পাওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর। তার উপর সবাই তাকে বৌমা বৌমা করছে। আর এই ছেলেটিকে লজ্জা পাওয়ার মতো কিছুই তো সে বলেনি। তাহলে কেন লজ্জা পাচ্ছে!
—ছেলেটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রিতিকা। ধবধবে ফর্সা মুখে চাপ দাড়ি। ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে, এই ঠোঁট কখনো সিগারেট স্পর্শ করেনি। জানালা দিয়ে রোদ এসে ছেলেটির মুখে পড়ছে, চিকচিক করছে মুখ। ছেলেটিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে রিতিকার কাছে। হটাৎ মনে পড়ে রণক এর কথা। কিন্তু ছেলেটি মুখ আর রণকের মুখের মাঝে কোনো মিল নেই। তাহলে ছেলেটির চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রণক এর কথা কেন মনে পড়ল তার!
—চাপ দাড়ির নতুনত্বে ছেলেটির বয়স আন্দাজ করে রিতিকা। অল্পবয়সী ডাক্তার, ত্রিশোর্ধ উপর বয়স তো হবেই। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। যারাই লেখাপড়া বেশি করে তাদেরই চোখে চশমা উঠে। রিতিকার হাসি পায়। কেন হাসি পায় সে নিজেও জানে না।
—কি হলো আপনি যে কিছু বলছেন না?
—তপন মাথা নিচ দিকে করে বলল, আপনি গত ছয় মাস যাবত কোমাতে ছিলেন। আপনাকে গৌরি নদীর ধারে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পেয়েছিলাম।
—দরজার কড়া নাড়ে তজশ্রী ব্যানার্জি। তপন কথার মাঝেই থেমে যায়। দ্রুত গতিতে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, বাড়ির সবাই জানে আপনি আমার স্ত্রী। বাকী সব কিছু পরে খুলে বলবো। এই বলেই দরজা খুলে বাইরে চলে যায় তপন।
—তজশ্রী ব্যানার্জি ভেতরে ঢুকে বলল, এখন কেমন লাগছে বৌমা?
—রিতিকা এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি কি বলে গেল! সব কিছুই যেন মাথার উপর দিয়ে গেল।
—কি হলো! কিছু বলছো না যে বৌমা?
—রিতিকা তজ্রশ্রী ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
—তজশ্রী ব্যানার্জি রিতিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ঘুমাও মা।
******
কলকতার গঙ্গা ঘাটে বসে আছে রণক। জীবনে এতো দ্রুত পরিবর্তন আসে।যে মানুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই জীবন পরিবর্তন হয়ে যায়। গঙ্গা জলের ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে উষার দেহ ভস্ম। রণকের চোখ ছাপিয়ে হু হু করে জল নামে। আমাকে ক্ষমা করে দে উষা আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না।
—চোখের পানি মুছে, গঙ্গা জল হাতে নিয়ে রণক শপথ করে। উষার মৃত্যুর জন্য যারাই দায়ী তাদের নিজ হাতে শাস্তি দিবে সে। চোখে তার আগুন জ্বলে তারপর আবার জলে ভোরে উঠে চোখ।
—আভা পেছনে দাঁড়িয়ে। দা-ভাই উঠেন আমাদের এখন যেতে হবে। থানা থেকে খোঁজ নিয়ে আসলাম। অপরার দিদির কোন খোঁজ পুলিশ এখনো পযন্ত পায়নি। আমাদের নিজেদেরই দিপেশ আর ফিরোজা কে খুঁজে বেড় করতে হবে।
—রণক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমাদের না শুধু আমার। তুমি আগামীকালের ফ্লাইটে চীনে ফিরে যাচ্ছ।
—এটা কি বলছেন দা-ভাই! আমি এখনো আমার দি-ভাই এর খুনিদের খুঁজে পায়নি। অপরা দিদি কেউ ওরা নিয়ে গেছে। ছয়মাস হয়ে গেছে, অপরা দিদি কেমন আছে জানি না। এতো কিছু হওয়ার পরও আমি কীভাবে ফিরে যেতে পারি?
—তোমার যেতেই হবে। অরুনিকা চাইত না তোমার জীবন এই সবের মাঝে জড়িয়ে পড়ুক। তাই তোমাকে দূরে রেখেছিল। তুমি এখানে থাকলে তোমাকেও টার্গেট বানাবে ওরা। আর আমি চায়না অরুনিকা নাম যে ভাবে রিতিকা তে পরিবর্তন হয়েছিল। তোমার নামও সেই ভাবে অন্ধকারে তলিয়ে যাক। তাই তোমাকে ফিরতে হবে। সুস্থ জীবন তোমার অপেক্ষায় আছে।
—আভা নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। দৌড়ে এসে রণকে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলে। দি-ভাই ভাবত আমি ওর জীবন সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু দি-ভাই ভুল ছিল। আমি সব জানতাম। যে দিন লোকলজ্জার ভয়ে বাবা-মা গলায় দড়ি দিয়েছিল। দিদিকে গ্রাম পঞ্চায়েতে পুড়িয়ে মারার রায় হয়েছিল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেছিলাম। আমার কথা সেইদিন কেউ ভাবেনি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কাকার বাড়িতে বেশি-দিন জায়গা আমার হয়নি। আমাদের বাড়ি-ঘর সব কিছুই বেদখলে চলে যায়। তারপর এক রাতের অন্ধকারে দিদি আমাকে নিয়ে চলে আসে। দি-ভাই ভাবত আমি ছোট তাই আমাকে কিছুই বুঝতে দিতে চাইত না। আমি দি-ভাই এর এই ভাবনা তে কখনো আঁচড় বসতে দেইনি। সব-সময় এমন ভান করতাম, আমি কিছুই জানি না। সব কিছুই স্বাভাবিক আছে। আমার নজরে দি-ভাইকে ছোট করতে আমি চাইনি। আজ দি-ভাই নেই। তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী আমি তাদের শাস্তি নিজ চোখে দেখতে চাই দা-ভাই।
—রণক আভার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে। সময়ে তোমাকে ডেকে নেওয়া হবে। অপরা তোমার দি-ভাই সম্পর্কে আমাকে যা বলেছে, এতে আমি নিশ্চিত বলতে পারি। উপর থেকে সে নিজেও এটা চায় তুমি এই সব থেকে দূরে সুস্থ জীবন কাটাও।
—আমি উষার দায়িত্ব নিয়েও ওকে রক্ষা করতে পারিনি। তোমার দি-ভাই এর কাছে আমি ঋণী। তোমার জীবনে যদি আমার জন্য কিছু অঘটন ঘটে যায়। তাহলে উপরে গিয়ে আমি মুখ দেখাতে পারব না অরুনিকার কাছে।
—এখন আমার অনেক কাজ আভা। তোমাকে ফিরে যেতেই হবে। তোমার জীবন সুনিশ্চিত করার পরেই আমি দিপেশ কে খুঁজে বের করবো। অনেক কিছুই আমার অজানা। সব প্রশ্নের উত্তর আমার চাই।

To be continued.....


গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)

পার্ট:-০৫
লেখনীতে: সামিনা সামি

Post a Comment

0 Comments