Header Ads Widget

Responsive Advertisement

পরকীয়া Season 2

গত ছয়মাস হলো আমি এক বিবাহিত লোকের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি। সেই লোকের বউ আছে, দুইটা বাচ্চা আছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে সুখী পরিবার তাদের। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে তো আর সব বুঝা যায়না। সেই সুখী পরিবারের ঝলমলে মোড়কের মধ্যে অযত্নে পরে আছে জং ধরা সম্পর্কের শেষ ছিটেফোঁটা। আমি অবশ্য তার পরিবারকে দেখিনি, দেখার প্রয়োজনও বোধ করিনি। তার কাছ থেকেই শুনেছি তার জীবনের টানাপোড়েনের গল্প, একই ছাদের নিচে দিনের পর দিন স্ত্রীর সাথে থেকেও না থাকার গল্প। মন-মানসিকতায়, ধ্যান-ধারণায়, শিল্পে-সাহিত্যে, শিক্ষা-যোগ্যতায় সব কিছুতেই তাদের নাকি যোজন যোজন ব্যবধান। বিয়ের আগে এতটা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারার কথাও না। সেটেল ম্যারেজ ছিল তাদের। এই একটু দেখা, একটু কথা, তখন নাকি খারাপ লাগেনি। ব্যাস তাতেই দুজনে বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছিলো। তারপর একসাথে পথ চলতে গিয়ে ধীরে ধীরে বৈষম্যটা ফুটে উঠতে থাকে। শুরুতে সে ভেবেছিলো যে সময়ের সাথে এই দূরত্ব ঘুচে আসবে। কিন্তু সেই দূরত্ব তো ঘুচে নাইই বরং দিনকে দিন নাকি বেড়েই চলেছে। এখন সেই দূরত্ব এতটাই যে মহাকাশ পাড়ি দিলেও তা আর ঘুচবার নয়। মাঝখান দিয়ে দুইটা সন্তান হয়ে এমন এক বন্ধন সৃষ্টি করেছে যে চাইলেই এ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নেই। তাদের সম্পর্কটা আজ এমনই যে সে এখন না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। এসব সব আমি তার কাছ থেকেই শুনেছি।


আমি তার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারি। কেননা এমনই এক সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে আমি নিজেও মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছি। আমার জন্য ব্যাপারটা অনেক সহজ ছিল। আমার কোনো ছেলেপুলে হয়নি। আমি বুদ্ধিমতী এবং স্বাবলম্বী মেয়ে ছিলাম। বিয়ের শুরুতেই আমি বুঝে গিয়েছি কোথায় জানি একটু তার ছেঁড়া। সব ঠিক আছে আবার কিছুই যেন ঠিক নেই। ঠিক আমারও মনে হয়েছিল আমরা দুজন যেন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তাই বুদ্ধি করে শুরুতেই বাচ্চা নিয়ে নেইনি। তারপর দুইজনে যখন দেখলাম যে আমাদের মধ্যে আর কিছুতেই মিলছেনা তখন নিজেরাই নিজেদের পথ দেখলাম। প্রবাসে থাকার কারণে ব্যাপারটা আমাদের জন্য সহজ হয়েছিল। দেশে থাকলে তো পরিবার-পরিজন, আত্মীয়- স্বজনদের হস্তক্ষেপে জল ঘোলা করতে করতে জীবনের অর্ধেক শক্তি নিঃশেষ করে তবেই না এই ছাড়াছাড়ি করা লাগতো। এ তো গেলো আট বছর আগের কথা। এই আট বছরে আমার মা অবশ্য তার মেয়ের এই ডিভোর্সের ধাক্কা থেকে এখনো রিকভার করতে পারেনি। তিনি মনে করেন আমার দোষেই আমার আজকের এই করুন পরিণতি। মেয়েকে বেশি স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার নাকি এই ফল। সামান্য আপস করে, ছোটোখাটো ব্যবধান মেনে নিয়ে জীবনে চলার ক্ষমতা আমি নাকি হারিয়ে ফেলেছি। তিনি মেয়েকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে আপাতত দিনাতিপাত করছেন।
তবে আমার মায়ের কাছে আমার পরিণতি করুন মনে হলে কী হবে, আমার নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীন মনে নয়। নিজের মতো থাকি আমি, নিজের মতো চাকরি করি, দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আনন্দ করি আর যেদিন মন খারাপ থাকে সেইদিন সারাদিন গুম মেরে পড়ে থাকি। কোনো বন্ধন নেই, কারও কাছে জবাবদিহি করা লাগেনা, কোনো বোঝা নেই। মন্দ লাগেনা আমার নিজের এই জীবন। মাঝে মাঝে একটু একাকিত্ব বোধ হয় ঠিকই কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধব, শখ আহ্লাদের কমতি নেই। এতেই আমার চলে যায়। তারপরও পরিবার আর বন্ধুদের চাপে পড়ে দুই একজনের সাথে ডেট করেছিলাম ঠিকই কিন্তু কাউকে একটুও মনে ধরেনি। শারীরিক ভালোবাসার কাঙাল আমি কখনোই ছিলাম না, কারও শরীর আমাকে সেভাবে টানে না। আমার কাছে মনটাই বড়। আর শুরুতেই মনে না ধরলে আমার সেখানে কিছু করার নেই।
এরপর হঠাৎই আমার জীবনটা ওলট পালট করে উদয় হলো আমার এই প্রেমিক পুরুষ। তার নাম আবির। এক বাংলাদেশি বান্ধবীর বাসার দাওয়াতে তার সাথে আমার প্রথম দেখা। আমি বাংলাদেশি সার্কেলে মেলামেশা আজকাল কমিয়ে দিয়েছি। আমার বয়সী সিঙ্গেল মহিলা দেখলেই সবাই চুকচুক করে দুঃখ করা শুরু করে। নানান কথা তাদের। আমার একা থাকতে ভালো লাগে কিনা, আমি নাকি বেশি মডার্ন, অমুক ভাবীর ডিভোর্সি দেবর নাকি পাত্রী খুঁজছে, এই টাইপের কথা বার্তা। অসম্ভব বিরক্তকর লাগে আমার। কিন্তু সেই বান্ধবীর জোরাজুরিতে সেদিন যেতেই হয়েছিল। সেখানেই দেখা হয়ে গেলো তার সাথে। সে একাই গিয়েছিল সেখানে। আর বাকিরা সবাই এসেছিলো যার যার পরিবারের সাথে। আমরা দুজন একা থাকার কারনে মনে হয় আলাদা করে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই আমার তাকে ভালো লেগে গিয়েছিলো। একেবারে গতানুগতিক বাকি সব মধ্যবয়সী বাংলাদেশী সাংসারী পুরুষদের থেকে একেবারে আলাদা, একেবারে অন্যরকম। কোথায় জানি মনে হয়েছে আমাদের দুইজনের মাঝে এক অদৃশ্য তারের সংযোগ আছে। আমার বিয়ের পর আমার স্বামীর সাথে যেই তারটি ছেঁড়া মনে হয়েছিল, সেই তারটিই কে যেন সযত্নে এখানে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। আমার প্রতি তার মুগ্ধ দৃষ্টি সেই দাওয়াতে আমার নজর এড়ায়নি। আমি ভীষণ আধুনিক মনের মহিলা এবং সমাজের নানান বিধি নিষেধে আমি বিশ্বাসী না। কিন্তু আমার কিছু নিজস্ব নীতিবোধ এবং বিশ্বাস আছে। যতই অদৃশ্য তারের সংযোগ থাকুকনা কেন, বিবাহিত দুই বাচ্চার বাবার সাথে প্রেম করা আমার রুচিতে বাঁধে। কেউ যদি তার স্ত্রীকে ছেড়ে আমার সাথে প্রেম করতে চায়, সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা মানুষদের আমি ঘৃণা করি।
সেকারণে তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেও প্রশ্রয় আমি দেইনি। কিন্তু সে ছিল একেবারে নাছোড়বান্দা। সেই দাওয়াতের পর থেকে একদম কিশোর বালকের মতো আমার যে পিছু নিলো, সেই পিছু আর ছাড়াতে পারলাম কোথায়। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেকেই আমার পরিচিত। তাই আমার খবরাখবর বের করা তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিলোনা। অফিস শেষে বের হয়ে প্রায়ই দেখি যে অফিসের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, বাড়িতে প্রতিদিন পোস্টে রংবেরঙের ফুলের সমাগম ঘটতে লাগলো, ছুটির দিনের সকাল বেলায় আমার বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে সে বসে থাকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এইসব চলতে থাকে। এইসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়? আমি তার সাথে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম;
- আপনাকে তো আমার খুবই একজন ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি ভীষণ ছ্যাচড়া।
সে মোটেও অপ্রস্তুত হয়নি। সোজা আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিলো,
- কী করবো? আপনার ভীষণ প্রেমে পড়ে গেলাম যে। কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না।
- কী চান আপনি? আমার সাথে পরকীয়া করতে চান? খুবই দুঃখিত, আমি মোটেও ইন্টারেস্টেড না।
- না, কিছুই চাইনা। শুধু আপনার পিছু নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।
- বাহ্, ভালো। কাটিয়ে দেন তাহলে।
এই বলে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আবার বলে উঠলো,
- দাঁড়ান, শুধু আরেকটা ছোট্ট চাওয়া আছে। একদিন যদি আমাকে একটু সময় দিতেন? আমার জীবনের গল্পটা একটু শুনতেন। ব্যাস, আর কখনও কিছু চাইবোনা।
আমার কৌতূহলী মন। এরকম প্রেমিক পুরুষ আমার জীবনে কখনও আসেনি। তার জীবনের গল্প শুনার আকর্ষণ আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি। আমি বলেছিলাম,
- ঠিক আছে, আজকেই শুনে ফেলি। আমার হাতে এখন সময় আছে। তাড়াতাড়ি বলে ফেলেন। শুনি আপনার গল্প।
- আপনি নিশ্চয়ই ডিনার করেননি। চলেন না সামনের রেস্টুরেন্টে বসে একটু কথা বলি? এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে কেমন জানি লাগছে।
- নাহ, আমি বাড়ি ফিরে ডিনার করবো।
- তাহলে তো এক কাপ চা কফি তো খেতে পারেন? চলেন এই কফি শপটাতে না হয় কিছুক্ষনের জন্য বসি।
আমি আর না করিনি। রাজি হয়ে গেলাম। তারপর কফি খেলাম। তার জীবনের গল্প শুনলাম। কেমন করে সে প্রেমহীন, ভালোবাসাহীন, শূন্য জীবনে প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেই গল্প। এমন এক দিন যায়না যে সে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়না কিন্তু তার স্ত্রী নাকি সব দিক থেকেই তার উপর নির্ভরশীল। সংসার ছেড়ে আসলে সে দুইটি সন্তান নিয়ে একেবারে অথৈ সাগরে পড়বে। তাদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্য কাউকে সে এই গল্প শুনালে হয়তো তাদের মনে হতো যে ঢং করার জায়গা পায়না। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। আমি নিজে জানি শূন্য জীবনের সম্পর্ক কতটা কষ্টদায়ক। সে তার স্ত্রীর ছোটোখাটো অনেক গল্পই শুনালো। যদিও তার স্ত্রীর উপর কোনো দোষারোপ সে করেনি, শুধু তারা যে ভিন্ন সেটা বুঝাতেই এত কথা বলেছে। আমারও মনে হয়েছে আসলেই কী ভিন্ন তারা দুইজনে। কী কষ্ট করেই না সে সংসার করে যাচ্ছে। আমার সেসময় মনে হয়েছিল যে ভাগ্যিস, আমি কোনো সন্তান হবার আগেই সংসার থেকে বেরিয়ে এসেছি, তা না হলে আমারও আজ এই পরিণতিই হতো।
সে শুধু অন্যরকমের পুরুষই না, সে একজন প্রেমিক পুরুষ, একজন দুঃখী পুরুষ আর মানতেই হবে যে সে একজন অসাধারণ গল্পকার। আমি মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনলাম। আমার মুগ্ধতা তার নজর এড়ায়নি। তারপর নিজেই বলেছিলো,
- আপনাকে কাজের পর এতক্ষন আটকে রাখলাম। এখন যেতে হবে। আপনার কাছ থেকে আমার কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমার এই পিছু নেওয়াটা শুধু মাঝে মাঝে কষ্ট করে একটু সহ্য করে নিবেন। এই ছোট একটু আনন্দ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ।
এরপর জারি থাকলো তার এই পিছু নেওয়া। ধীরে ধীরে শুধু এই ছোট একটু আনন্দ কেন, আর অনেক বড় আনন্দ থেকেও বঞ্চিত করিনি তাকে। আমার যা দেবার আছে সব তাকে দিয়েছি, একেবারে উজাড় করেই দিয়েছি। কোনো কিছুতেই কার্পণ্য করিনি। বলেছিনা, যে এরকম প্রেমিক পুরুষ আমার জীবনে কখনও আসেনি, আমরা যেন একই তারে বাঁধা। মাঝে মাঝে তার পরিবার সম্পর্কে আমার কৌতূহল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু খুব একটা গা করিনি। ভালোই তো কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন। চলুক না এভাবে, মন্দ কী?
হঠাৎ করে আজ সকাল সকাল আমার ফেইসবুক মেসেঞ্জারে এক নতুন মেসেজের রিকোয়েস্ট। সাধারণত আমি মেসেজ রিকোয়েস্টগুলো ভালোমতো না পড়েই ডিলিট করে দেই। কিন্তু মেসেজটি খুলেই আমার দৃষ্টি আটকে গেলো। সেখানে লেখা,
- আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আবিরের ওয়াইফ। আপনি যার সাথে পরকীয়া করছেন, সেই আবির। আপনি যদি সময় করে কোনো এক সময় আমার সাথে একটু দেখা করতে পারেন, তাহলে ভাল হত। আমার কিছু কথা ছিল।
আমার হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেলো। মেসেজটি এসেছে "বিরহিনী" নামের এক প্রোফাইল থেকে। সেই প্রোফাইল আবার লকড। প্রোফাইল আর কাভার পিকচার দুইটাই ফুলের ছবি। আমি বুঝে নিলাম যে কেউ নিশ্চয়ই শয়তানি করছে। এই জন্য আমি বাংলাদেশিদের সাথে বেশি মিশতে চাইনা। ভীষণ প্যাঁচের বাঙালি। আমাদের সম্পর্কটা কেউ ধরতে পেরে ফুর্তি নেওয়ার চেষ্টা করছে। আরে সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল। আমার তো কিছু লুকানোর নেই। আবির অফিসের কাজে এখন ইউরোপে। এক সময় মেসেজ করে জানাতে হবে।
তারপর অফিসে পৌঁছানোর পর পরই আরেকটা মেসেজ পেলাম।
- ওহ, আপনাকে আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি। আমার নাম অদিতি। আজকে তো অফিস শেষে আপনার মনোরঞ্জন করার মানুষ নেই। অসুবিধা না থাকলে আজই আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আমি আপনার অফিসের সামনে অপেক্ষা করবো। কেমন?
এবার আমার বুক ঢিবঢিব করা শুরু করছে। পরকীয়া ধরা পড়ার ভয়ে না। আমি তো বলেছিই আমার লুকাছাপার কোনো ইচ্ছা নেই। তারপরও কী যেন এক আশংকায় বুক ঢিবঢিব করছে। আবির তো বলেছিলো ওর স্ত্রী এমনই অপদার্থ যে ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তার সামনের স্কুল থেকে বাচ্চাদের আনা নেওয়া করতে হিমশিম খায়। আমার অফিস তো অনেক দূরে। বাচ্চাদের রেখে সে এতদূর আসবে নাকি? হতেই পারেনা। এবারও আমি মেসেজের উত্তর দিলাম না কিন্তু কী মনে করে জানি আবিরকে ব্যাপারটা না জানানোই ঠিক করলাম। দেখা যাক কী হয়। সারাদিন কাজে মন দিতে পারলাম না। ভীষণ অস্থির লাগছিলো। কাজ না করে অফিসে বসে থাকার কোনো মানে নেই। অনেক আগেই বেরিয়ে পড়তে পারতাম কিন্তু ইচ্ছা করে বের হলাম না। প্রতিদিন যেই সময়টাতে বের হই সেই সময়েই বের হব। সত্যি যদি আবিরের ওয়াইফ দেখা করতে আসে তাহলে তো সে নিশ্চয়ই সেই সময়ই আসবে। আগে বের হলে যদি এসে আমাকে না পায় ?

অফিস শেষে বের হয়ে রাস্তার উল্টা দিকের ল্যাম্পপোস্টে আমার চোখ আটকে গেলো। আবির যেখানে সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে সে বাংলাদেশি। তার দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। আমার বুকের হৃদস্পন্দন ছাড়া আর আশেপাশের কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি। তারপরও যথাসম্ভব মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটিয়ে রেখে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। খুবই মিষ্টি দেখতে সামান্য নাদুস নুদুস এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা জিন্স আর মনে হয় আড়ংয়ের এক সাধারণ ফতুয়া। বয়স আমার মতোই হবে, এই মধ্য তিরিশের এদিক ওদিক। আমি আবিরের কাছে তার স্ত্রীর কথা শুনে শুনে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে তার একটা ছবি দাঁড় করিয়েছিলাম। সেই ছবির সাথে এর কোনো মিল নেই। এ কী সত্যি সত্যিই আবিরের ওয়াইফ? এই প্রথম আবিরের স্ত্রী আর পরিবার সম্পর্কে খবর না নিয়ে আবিরের সাথে সম্পর্ক করার জন্য বুকের ভিতর একটু খচ খচ করছে নাকি?
সেই কথা শুরু করলো। কথার মধ্যে কোনো ভনিতা বা জড়তা নেই। বললো,
- আমি অদিতি। আবিরের ওয়াইফ। আর আপনাকে তো আমি চিনিই। আমরা কি কোথাও বসে একটু কথা বলতে পারি?
- আপনি যে আবিরের ওয়াইফ তার প্রমান কী?
- আপনাকে তো প্রমান দিতে আসিনি আমি? আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলে করবেন, না করলে না করবেন। সেটা আপনার ব্যাপার। আমি কয়েকটা কথা আপনাকে জানাতে এসেছি। তা জানিয়েই আমি চলে যাবো।
আমি তার কথার ঝাঁঝে হকচকিয়ে গেলাম। আবিরের কথা শুনে ধারণা করেছিলাম যে তার স্ত্রী একজন ব্যক্তিত্বহীন মহিলা। দুই লাইন কথা কারও সাথে বলে উঠতে পারেনা। এই মহিলাকে তো মোটেও সেইরকম কিছু মনে হচ্ছেনা। তারপরও এই মহিলা যে আসলেই আবিরের স্ত্রী সে ব্যাপারে আমি কেন জানি নিঃসন্দেহ। তাছাড়া আমার কৌতুহলী মন। যেই কৌতূহলী মনের কারণে আমি আবিরের কথা শুনতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম, সেই কৌতূহলের কারণেই আমি মনেহয় আবিরের স্ত্রীর কথা শুনার আগ্রহ বোধ করছি। আমি বললাম,
- চলেন স্টেশনের ভিতরের একটা কফি শপে বসা যাক।
কফি শপে গিয়ে দুইজনই দুইকাপ চা নিয়ে বসে পড়লাম। এবারও সেই কথা শুরু করলো,
- বাচ্চাদের এক ফ্রেন্ডের কাছে রেখে এসেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার হাসবেন্ড কাকে দেখে এত মজলো তাকে কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা।
এইধরণের কথা শুনে এবার আমার একটু মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি তা প্রকাশ হতে দিলাম না। বললাম,
- আবির জানে যে আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন?
- নাহ, তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।
- বাহ্। আপনার স্বামী আরেকজনের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। আপনি তাকে বাড়িতে দিনের পর দিন খাতির করে রেখে তার প্রেমিকার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। হাউ টিপিক্যাল।
- আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে এসেছি আপনাকে সেটা কে বললো? আপনার মতো চরিত্রের মহিলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা কেন, কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।
- নাহ, আপনার রুচির প্রশংসা না করে আমি কিন্তু পারছিনা। নিজের তো কিছু করার মুরোদ নেই আপনার। স্বামী অন্যের সাথে প্রেম করছে জেনেও তার পা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন। আর আমার সাথে কথা বলতে আপনার রুচিতে বাঁধে। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার মতো আত্মসম্মান বোধহীন মহিলার সাথে কথা বলতে আমার এখন রুচিতে বাঁধছে।
সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। সেই হাসিতে এমন কিছু ছিল যে আমার নিজের আত্মবিশ্বাসের ভীত একেবারে চুরচুর হয়ে গেলো। সে বলল,
- আমাদের দুইজনের কথা বলতেই রুচিতে বাঁধছে দেখি। তবে আপনার সাথে কথা কাটাকাটি করতে আমি আসিনি। আর আপনাকে যদি জানাতে হয় যে আমি কেন আমার হাসবেন্ড প্রেম করছে জেনেও তার সংসার করে যাচ্ছি, তাহলে আপনার কাছ থেকেও জানতে হবে, আপনি কেন জেনেশুনে আরেকজনের হাসবেন্ডের সাথে প্রেম করছেন। আপনি নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন যে আমি যেই কাজটা করেছি সেই ব্যাপারটা বেশি ঘৃণ্য না আপনি যা করেছেন তা বেশি ঘৃণ্য? যা হোক, আপনার জীবনদর্শন আপনার কাছে, আমার জীবনদর্শন আমার কাছে। আপনাকে শুধু জানাতে এসেছিলাম, যার সাথে প্রেম করে আপনি এত পুলকিত সে কিন্তু মহা প্রেমবাজ। আগেও প্রেম করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু আপনার মতো এত মডার্ন, স্ট্রং, স্বাবলম্বী মহিলারা যখন এরকম প্রেমবাজদের কাছে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে বসে থাকে তখন দেখতে ভীষণ কুৎসিত লাগে। ভীষণ ছ্যাবলামি মনে হয়।
আমি বেশ একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আমার সামনে বসে থাকা অদিতিকে আবারো ভালোকরে একটু দেখে নিলাম। স্নিগ্ধ একটা চেহারা, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সে বসে আছে। ওর ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা। এবার আমি কথা বললাম,
- আপনি কি শুধু আমাকে এটা জানাতেই এখানে এসেছেন? আর আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই মুখের কথা শুনেই আমি সব খুশি মনে মেনে নিয়ে আবিরকে একজন ধোঁকাবাজ আর প্রেমবাজ মনেকরে দূর করে দিবো। আপনার যেমন তার সম্পর্কে কথা বলার আছে, তারও কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলার আছে।
- তা তো বটেই। তার নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলার আছে।
কিছুক্ষনের নীরবতা। অদিতিকে কি একটু হতাশ দেখাচ্ছে? আমি মেয়েটিকে বুঝার চেষ্টা করছি। কী চায় মেয়েটি? এসব কথা বলে ওর স্বামীকে ফিরে পেতে চায়? আমি কী বলবো চিন্তা করছিলাম কিন্তু সেই আবার কথা বলে উঠলো,
- আমি আপনাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে বলছিনা। শুধু যেটুকু আপনাকে জানানোর দরকার মনে করেছিলাম, সেটুকু আপনাকে জানিয়ে দিলাম। আপনি কী করবেন সেটা আপনার উপর। তবে আপনি সময় নিতে পারেন, আবিরের সম্পর্কে খবর নিয়ে দেখতে পারেন। আর আমিও অনেকদিন সময় নিয়েছি। নিজেকে কষ্ট করে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী করে তৈরি করেছি। ব্যাপারটা সহজ ছিলোনা। অনেক কঠিন। শুধু আর্থিক এবং শারীরিক ভাবে কঠিন না, মানসিক ভাবেও কঠিন। আবির ভেবেছিলো আমার মতো মেয়েদের কোথাও যাবার জায়গা নেই। ওর সংসারেই আমার আজীবন পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু সময় এসেছে ওকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করার। আমি এখন তৈরী, আমি ওর সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
- বাহ্, তাহলে তো বেশ ভালোই। আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
- থ্যাংক ইউ। আর আপনি যদি ভেবে থাকেন যে আমি ওকে ছেড়ে দিলে ও আপনার সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করা শুরু করে দিবে তাহলে আপনার ধারণাটা কিন্তু ভুল । ওর বাড়িতে প্রয়োজন একজন সুচারু গৃহিনী আর বাহিরে প্রয়োজন কেতাদুরস্ত আধুনিকা।
- আমি কিন্তু কিছুই ভাবছিনা। শুধু আপনার কথা শুনছি। আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি আপনার জীবনের কঠিন সময়েও আমার কথা চিন্তা করে আমাকে এতগুলো উপদেশ দিতে এসেছেন।
অদিতির ঠোঁটে আবারো সেই বুক হিম করা হাসি। ও বললো,
- আপনি সার্কাস্টিক হচ্ছেন? দুঃখের ব্যাপার কী জানেন? আমি যেমন আপনাকে দোষী ভাবছি এবং আপনি যেমন আমাকে দোষী ভাবছেন, পুরো সমাজও ঠিক একইভাবে বিভক্ত হয়ে আমাদের এই কাহিনী নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করবে। একদল আমাকে ব্যক্তিত্বহীন স্ত্রী বলে যা তা বলবে। আর আরেকদল আপনাকে নষ্ট মেয়েছেলে বলে আখ্যায়িত করে। দুই সন্তান নিয়ে এই সংসারে আমার কী অপারগতা ছিল তা আমিই জানি আর আপনি কিসের টোপে ধরা দিয়েছেন তা আপনিই জানেন। কিন্তু যেই মানুষগুলো আমার বা আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একজনকে মায়াজালে বেঁধে রাখে, পরিকল্পনা করে ছলনা করে সেই মানুষগুলো বহাল তবিয়তে কিন্তু বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো দোষ হয়না।
একটু থেমে অদিতি আবার বলে উঠলো,
- আমার এখন উঠতে হবে। বাচ্চাদের এক বান্ধবীর কাছে রেখে এসেছি। সেখান থেকে ওদের উঠিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু করবো। আমি আর আমার দুই সন্তান নিয়ে নতুন জীবন। আমি জানি, সেই জীবন মোটেও সহজ হবেনা। হয়তোবা মোটেও আনন্দের হবেনা। কিন্তু আশাকরি অনেক সম্মানের হবে। অসম্মানের জীবন কিন্তু ভীষণ কষ্টের। আর আপনাকে এতকিছু জানালাম কেন জানেন? আমার মনেহয় আপনিও আমার মতো এমন মায়াজালে আটকে পড়ে গিয়েছেন যে ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা আপনার লোপ পেয়েছে। আমি জানি এই মায়াজাল, এই ধোঁকার আকর্ষণ কী সাংঘাতিক। তবে এই ধোঁকার জীবনে আর যাই থাকুক না কেন, কোনো সম্মান নাই। হয়তোবা একসময় আপনি আমার কথা উপলব্ধি করতে পারবেন। ভালো থাকবেন। চলি কেমন।
এই বলে অদিতি নামের মেয়েটি চলে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যতক্ষণ না পর্যন্ত ও দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেলো। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগা শুরু করলো, নিজেকে পরাজিত এক মানুষ মনে হচ্ছে। মেয়েটি যদি আমাকে গালাগালি করে, আমার সাথে রাগারাগি করে যেত, তাহলে হয়তোবা এরকম মনে হতোনা।
নিজের অজান্তে হঠাৎ করেই গত ছয়মাসের সম্পর্কের নানান ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আবির যে একজন অসাধারণ গল্পকার এ ব্যাপারে আমার কোনোই সন্দেহ নেই। কথার মোহেই আমি ওর প্রেমে পড়েছি। শুধু কী কথা? ঐযে অদিতি বলে গেলো, "মায়াজাল"। কী এক মায়াজালে আমি আটকে গেছি যে আসলেই ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি।
হয়তোবা অদিতিই ঠিক, আবির এক মহা প্রেমবাজ। স্ত্রী খারাপ, প্রেম-ভালোবাসাহীন দাম্পত্য সম্পর্ক এসব হয়তোবা ওর প্রেমের এক কৌশল মাত্র। কিন্তু ও প্রেমবাজ কি প্রেমবাজ না সেই ব্যাপারটা আমার কাছে আর মুখ্য না। ওর যে স্ত্রী আছে সেই ব্যাপারটা তো আমার ঠিকই জানা ছিল। আমি তো সেই ব্যাপারটা জেনেই ওর সাথে সম্পর্ক করেছি।
আর হয়তোবা আবিরের কথাও ঠিক। ওর স্ত্রীর সাথে দিনের পর দিন ধরে হয়তো ঠান্ডা সম্পর্ক, ওদের হয়তো যোজন যোজন ব্যবধান। তারপরও তো ওর স্ত্রী, তার সাথে সংসার করে চলছে। এতই যখন কষ্ট তাহলে সেই সংসার ছেড়ে আসার কোনো চেষ্টা করেনি কেন? সন্তানদের জন্য যখন এত মায়া, তাদের ব্যবস্থা করেই নাহয় বেরিয়ে আসতো।
আর আমি? আমি নাকি এক মহা নীতিবান মানুষ। বুক ফুলিয়ে বলেছি যে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা মানুষদের আমি ঘৃণা করি। এই আট বছরের আমার সিঙ্গেল জীবনে আমি তো কাউকে ঠকাইনি। তাহলে কিসের মোহে, কিসের বশে সব নীতি, সাধারণবোধ খুইয়ে বসে আছি? আসলেই নিজেকে ভীষণ ছ্যাবলা মনে হচ্ছে।
আজ যদি অদিতি আবিরের সংসার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত না নিয়ে ঠিক এই একই কথাগুলো আমাকে বলে যেত, তাহলে ওকেই আমার দুর্বল আর ছ্যাবলা মনে হতো। আজ যদি ও এখানে এসে আমার সাথে ঝগড়া বা রাগারাগি করার চেষ্টা করতো, তাহলে আমি ঠিকই নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করে নানান যুক্তি দাঁড় করে ফেলতাম। কিন্তু মেয়েটা যে কিছুই করলোনা। কিছু না করেই আমাকে এভাবে পরাজিত প্রতিপন্ন করে চলে গেলো?
আমার হঠাৎ মনে হলো যে আমি জানি আমাকে এখন কী করতে হবে। আমাকেও সম্মানের জীবন ফিরে পেতে হবে। ব্যাপারটা হয়তোবা সহজ হবেনা। এই মায়াজাল ছিন্ন করা যে বড়ই কঠিন। কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অদিতি যখন পেরেছে, আমাকেও পারতে হবে।
আর আবির? ওর কী হবে? আমরা দুজন ওকে ছেড়ে গেলে ওর কি কোনো চৈতন্য হবে? ও কি বেছে নিবে সম্মানের একটা জীবন?
যে জীবনই বেছে নিক না কেন। আমার তাতে কী? চুলোয় যাক আবিরের জীবন। ওর কথা চিন্তা করে আবারো কেন অকারন মায়া বাড়ানো। এই মায়াজাল যে বড়ই লজ্জার, বড়ই অসম্মানের।

.......................
(সমাপ্তি)
ছোটগল্পঃ পরকীয়া
লেখনীতে: আমিনা তাবাস্সুম

Post a Comment

0 Comments