Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ৪

ইউসুফের কাঁধে হাত রেখে সাইকেলে উঠলো অপরাজিতা। আজ গ্রামের আকাঁবাঁকা রাস্তায় সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াবে সে। মনের মাঝে অদ্ভুত খুশির জোয়ার ভাসছে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব কথা কি বলা যায়? কিছু কিছু কথা অবাধ্যতায় মিশে থাকে। যেসব মনের সুপ্ত কোণে ঢেকে রাখতে হয়।

গ্রামে একমাত্র তাঁদের বাড়িটি দোতলা। তাছাড়া সব বাড়িগুলো টিনের দোচালা অথবা চৌচালা। অনেক অনেক যায়গায় মাটির ঘরও লক্ষ্য করা যায়। অপরাজিতার বাবা এখানকার বড় ব্যবসায়ী হওয়ায় সবার সুনাম কুড়িয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি ইংরেজরা এখান থেকে চলে যাওয়ায় এলাকার কর্তৃত্ব এখন অপরাজিতার বাবার হাতে। কলকাতায়ও অনেক জায়গা কিনে রেখেছে। আর ইউসুফের এখানে থাকাটা অনেকটাই ভাগ্য বলা চলে। বিজনেস পার্টনার হওয়ায় এখানে থাকার সুযোগ পেয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হওয়ার কারণে অপরাজিতার বাবা ইউসুফদের এখানে রেখে দিয়েছেন যে তারা এলাকার সবার মাঝে একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মূল উদ্দেশ্য হলো ' যদি আমরা হিন্দু মুসলিম দুই পরিবার এক বাড়িতে থাকতে পারি তাহলে গ্রামের মানুষ থাকতে পারবে না কেনো? '। এই নিয়ে গ্রামের অনেকেই ছিঃ ছিঃ করে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না।


গ্রামে শতকরা ৭০% হিন্দু হওয়ায় মুসলিমরা অশান্তিতে থাকে এখানে। এই বিবাধের মুল বীজ ইংরেজরা বপন করে গেছে। তার ফল এখন সবাই ভোগ করছে।
অপরাজিতা ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়েছে, চুলচুলো আগের মতোই বেণী করা। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। মুখে কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী নেই। তবুও লাবণ্য যেনো উপচে পড়ছে তার শরীরে। একটা নীল রঙের শাড়ি পড়ে এখন ইউসুফের সাইকেলের পেছনে। হালকা বাতাসে তাঁর শাড়ির আচল মৃদু কাঁপছে। অপরাজিতা ঠোঁটে হালকা হাসি রেখে বললো -
- একটু ধীরে ধীরে চালাও না। পথ যে তারাতারি ফুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা কাজ করো তো। আজ আমাকে নদীর তীরে নিয়ে যাও। ওখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবো। তারপর বাড়ি ফিরবো।
তারপর একটু থেমে আবার বললো -
-তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। আমার প্রেম প্রেম পাচ্ছে।
ইউসুফ হো হো করে হেসে উঠলো। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে দ্বিমত পোষণ করলো। গ্রামে মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই।
অপরাজিতা তবুও নাছোড়বান্দা। শেষমেশ নদীর তীরে উপস্থিত হলো তারা। শরৎ এর এই মেঘমুক্ত আকাশে দুহাত বাড়িয়ে দিলো অপরাজিতা। আকাশের নীল সাদা রঙের মতোই অপরাজিতা এবং ইউসুফের পান্জাবীর কালার। উফফ! প্রতিদিন যদি এভাবে বেড়ানো হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু মহাশয় তো পড়াশোনা করেন সারাটাদিন। এভাবে কি জীবন চলে? যে কথা বলতে পারেনা তাঁর এত পরাশোনা করে লাভ কি? কিন্তু মুখফুটে কখনো এসব বলতে পারে না। সে কখনই চায়না ইউসুফের মনে হালকা আঘাত দিতে। ইউসুফ সাইকেলটা স্টান্ড করে অপরাজিতার কাছাকাছি চলে আসলো। সেখানে ঘাস দেখে দুজনের বসার ব্যাবস্থা করলো। অতঃপর অপরাজিতাকে সেখানে বসতে ইশারা করলো সে। অপরাজিতা বসে ইউসুফকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। একটা সাদা কালারের পান্জাবী পড়েছে সে। উসকোখুসকো চুলগুলো পেছনের দিকে স্পাইক করছে বারবার। তবুও অবাধ্যতায় কপালে পরে যাচ্ছে। ইউসুফের নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে যা তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। একটু দূরেই একটা ঘাট লক্ষ্য করা যায়। সেখানে নৌকা আসছে একটা। আজ হাটের দিন হওয়ায় অনেক লোকজন এপাড়ে আসছে নৌকায় করে। বাতাসে কাশফুল হেলেদূলে পড়ছে যেনো। অপরাজিতার এখানে থাকতে অনেক ভালোলাগছে। সে ঘাসের উপর শুয়ে পরলো নির্দ্ধিধায়। সে চোখ বন্ধ করে বললো-
- তোমার এখানে কেমন লাগছে?
ইউসুফ হাতের ইশারায় বুঝালো অনেক ভালোলাগছে। সাথে তোমাকেও।
অপরাজিতা খিলখিল করে হাসলো। মেয়েটা সবসময় হাসে। যেনো তার এই জীবনে কোনো দুঃখ নেই। হঠাৎ কি দেখে ইউসুফ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অপরাজিতাকে সেখানে রেখেই চলে গেলো ঘাটের দিকে। একটু পর একঠোঙা বাদাম নিয়ে হাজির হলো। হঠাৎ এভাবে না বলে যাওয়ায় অপরাজিতার রাগ হলো কিন্তু বাদাম দেখার পর তাঁর সব রাগ যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো।
অপরাজিতা আবার শুয়ে পরলো ঘাসের মধ্যে। ইউসুফ একটা করে বাদাম ছিলে অপরাজিতার মুখের মধ্যে দিচ্ছে। অপরাজিতা একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে তো একবার লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলছে। আবার নির্লজ্জের মতো বাঁকাচোখে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি দিচ্ছে। আশ্চর্য! আমার লজ্জা লাগছে কেনো? কি যন্ত্রণা।
---------
পরদিন ঘুম ভাঙ্গলো সকাল ৮ টায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে ঝলমলে রৌদ্রুর উঠেছে। বাহিরে পাখির কিচিরমিচির ডাক। সকাল সকাল মনকে ফুরফুরে আর প্রাণবন্ত করে দিলো যেনো। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠেই একবার ভাবলাম পুরোনা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখবো। আবার ভয়ভয় লাগছে। একা একা কি যাবো? ধুর! একা গেলেই বা কি সমস্যা। টেবিলে সকালের নাস্তা করতে দাদুকে দেখা গেলো। কিন্তু সেই মুগ্ধ কোথায়? তাকে তো দেখি খুঁজেই পাওয়া যায় না। মহসিন সরকার চুপচাপ খেয়ে উঠলেন। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
- এখানে থাকতে তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে না'তো?
আমি মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললাম -
- না না দাদু। একটুও হচ্ছে না। আজ বাড়িটার আশেপাশে একটু ঘুরে ঘুরে দেখতাম। কিন্তু আপনিতো আর আমাকে দেখাতে পারবেন না। কষ্ট হবে এই বয়সে।
সাহস করে বলেই ফেললাম কথাটা। মূল উদ্দেশ্য হলো মুগ্ধের সাথে সময় কাটানো। মানুষটা কেমন যেনো! একটু অগোছালো। দাদি আমাকে ছোটবেলায় তাঁর প্রিয় মানুষের গল্প শুনিয়েছেন। সেখানে তার প্রিয় মানুষটা ছিলো ইউসুফ, যে কিনা কথা বলতে পারতো না। কিন্তু অপরাজিতার সামনে সবসময় মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে থাকতো। আর বাকিটা সময় ছিলো গম্ভীর। মুগ্ধ তো সেই রক্তের মানুষ। তাহলে তিনিও কী ইউসুফের মতোই হলেন? দাদি যেভাবে ইউসুফের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি সুন্দর মুগ্ধ। হয়তো ইউসুফের থেকেও বেশী সুন্দর। হঠাৎ দাদুর কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসলাম। তিনি বললেন-
- ভালো তো। মুগ্ধ একটু বাজারে গিয়েছে। যখন আসবে, তখন নাহয় ওর সাথে যেয়ো ।
-----
নাস্তা করে নিজের রুমে একবার আসলাম। শ্রেয়া বসে মনোযোগ সহকারে বই পড়ছে। এখানে এসে কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গিয়েছে আরো। নাহ! খুব তারাতারি এখান থেকে চলে যেতে হবে। ইচ্ছা ছিলো কিছুদিন থেকে পুরোনো সব কিছু জেনে তবেই যাবো। কিন্তু থাকা আর হবে না। আমার কারণে কারো অসুবিধা হবে তা মানায় না। আমি ওর শিয়রের পাশে বসে বললাম -
- মুগ্ধ স্যারকে দেখেছিস? যার কথা ভার্সিটিতে সবাই বলাবলি করছিলো।
শ্রেয়া বইয়ের ভীতর মুখ নিবদ্ধ রেখেই বললো-
- না দেখিনি । তুই হঠাৎ করে এই প্রসঙ্গ তুললি কেন?
শ্রেয়ার এমন কথায় থতমত হয়ে গেলাম। আসলেই তো, হঠাৎ করে উনার কথা বললাম কি দুঃখে। ধুর! কি না কি ভাবলো। তবে উনার সম্পর্কে ভাবতে ভালোলাগছে। আমি হালকা হেসে বললাম -
- যিনি আমাদের এই বাড়িতে নিয়ে আসলো উনার নাম মুগ্ধ। আবরার মুগ্ধ। আমাদের ভার্সিটির নিউ টিচার।
আমার কথা শুনে শ্রেয়া হতবাক হয়ে গেলো। বিষ্ময়কন্ঠে বললো-
- কি বলিস দোস্ত। এই ছেলেতো দেখি পুরাই আগুন। মাই ক্রাশ। আহা!
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম-
- চোখদুটোকে সংযত রাখ। নজর লাগাবি না।
কিছুক্ষণ শ্রেয়ার সাথে কথা বলে একবার নিচে নেমে দেখলাম মুগ্ধ এসেছে। আমাকে দেখেই থেমে গেলো। ব্যাতিব্যাস্তস্বরে বললো-
- দাদু আপনাকে আশেপাশে ঘুরে দেখাতে বলেছে। আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে এক্ষুনি আসুন। নাকি আবার সাজুগুজু করবেন?
আমি উনার কথায় চমকে উঠলাম। এ্যাহ' মনে হয় পাঁচ মিনিটের জন্য একটু সাজতে গেলে দুনিয়া ধংস্ব হয়ে যাবে। নিউটনও বোধহয় সময়ের এত মূল্য দেয়নি। হু। তবুও স্বাভাবিক স্বরে বললাম -
- না না। চলুন যাওয়া যাক। আগে পুরোনো বাড়িটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখি চলুন।
উনি যেনো কথাটা শুনেও শুনলেন না। কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন -
- চলুন বাড়ির পিছনে যাই। ওখানে একটা সু্ন্দর পুকুর আছে। নিরিবিলি যায়গা। যাবেন?
আমি বুঝে গেলাম উনি কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি স্বাভাবিক স্বরে বললাম -
- নাহ! ওদিকে নাহয় পরেই যাবো। আগে বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি।
আমার কথায় উনার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির আভা লক্ষ্য করলাম। কেনো এমন করলেন বোধগম্য হলো না আমার। উনি আমাকে নিয়ে প্রাচীন বাড়িতে প্রবেশ করলেন। উফফ! গা ছমছম করা অবস্থা। এই সকাল বেলায়ও কেমন অন্ধকারে আচ্ছায়িত। সদর দরজা দিয়ে ভীতরে ঢুকেই বিশাল বড় একটা কুয়ো দেখে কলিজা ধ্বক করে উঠলো। আমি উনার দিকে ভয়ার্ত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে ফেললাম। বিষ্মিতস্বরে বললাম -
- এটা এত বড় কেনো? হায় হায়। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম একেবারে।
ভয় পেয়ে হঠাৎ হাত ধরায় লজ্জিত হলাম আমি। উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন-
- এখান থেকেই আপনার দাদিরা পানি তুলে ব্যাবহার করতেন। চলুন উপরে উঠা যাক।
আমি এখনো ভয় পেয়ে জড়সড় হয়ে আছি। অথচ উনি স্বাভাবিকভাবেই চলছেন। হঠাৎ মনে হলো এটাই কি স্বপ্নের সেই সুদর্শন পুরুষের দেখানো কুয়ো? এখান থেকেই তো স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু স্বপ্ন কি সত্যি হয়?

চলবে...........

গল্প: বিদেশিনী
#পর্বঃ০৪
লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments