Header Ads Widget

Responsive Advertisement

নিষিদ্ধ নারী -পার্ট ১১

ট্যাক্সিতে বসে অরুনিকা জানালায় মাথা রেখে ব্যস্ত কলকাতার ছুটতে থাকা মানুষদের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বার বার ইন্টেরিয়র মিরোরে অরুনিকার দিকে তাকায়। অরুনিকার বেশ বিরক্তই লাগলো। তাই উচ্চ স্বরে বলে উঠলো, ঘন্টায় পাঁচ হাজার। সামর্থ্য থাকলে ফাঁকা কোন রাস্তায় ট্যাক্সি থামাও।
—অরুনিকার এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, আমার কাছে এতো ট্যাকা তো নেই ম্যাডাম।
—তাহলে ছুঁকছুঁক চাহনিতে আর না তাকিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দাও আমাকে।
—ট্যাক্সি গিয়ে থামলো স্টার হোটেল এর সামনে। অরুনিকা ট্যাক্সি থেকে নেমে চলে যাচ্ছিল।
—পেছন থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, ম্যাডাম আমার ভাড়া।।
—সারা রাস্তা যে চোখের তৃপ্তি মিটালে। আমি কি ভাড়া চেয়েছি? এই বলেই অরুনিকা চলে গেল হোটেল এর ভেতরে।



—অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ড্রাইভার। সে কি করবে? তার দোষটা কোথায়! ওমন পোষাকে রূপবতী কোন নারী যদি ট্যাক্সিতে বসে। স্বাভাবিক ভাবেই তো তার দিকে নজর টা যাবে।
—অরুনিকা রিসিপশন ডেস্ক থেকে মিস্টার.বিস্বাস এর রুম নাম্বার শুনল। লিফটে উঠতে নিয়ে সে দেখল, ডক্টর মৃণাল দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার আমাকে ফলো করছেন কেন?
—মৃণাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কিছু কথা ছিল।
—কি আর কথা থাকতে পারে! উপকার করেছেন তা মানছি। কিন্তু উপকারের প্রতিদান চাইবেন তা দেওয়ার মতো আমার সামর্থ্য নেই।
—প্রতিদান না আমার কিছু কথা ছিল।
—কিছুটা সময় নিয়ে অরুনিকা বলল, হুম শুনবো। আগামীকাল পার্ক স্ট্রিটে দেখা করিয়েন। এই বলে চলে যায় অরুনিকা।
—রুমের ভেতর ঢুকে দেখল মিস্টার.বিশ্বাস শর্টস পড়ে সোফায় বসে ড্রিংক করছে। অরুনিকাকে ঢুকতে দেখে মিস্টার.বিশ্বাস ড্রিংক হাতে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল ইটস লং টাইম ইউ নোট বিন ইন মাই বেড ডার্লিং। কাম হেয়ার। তোমার শরীর এর সাথে রূপ টাও অসম্ভব সুন্দর। তাইতো তোমার বলা কথা ফেলতে পারিনা।এই বলেই ড্রিংক হাতে অরুনিকা'কে টেনে বুকে নেয় বিশ্বাস।
—মনে মনে অরুনিকা ব'লে, এক পা শ্মশানে যার পড়ে আছে তার কাম দেখে মনে হয় নবযুবক। অরুনিকার হাত ধরে বলল, এতো নরম হাতে মানুষ মারলে কীভাবে ডার্লিং? অরুনিকা কিছু বলার আগে এক চুমুক ড্রিংক নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট বসে দেয় বিশ্বাস। অনিচ্ছায় বিশ্বাস এর মুখের ড্রিংক অরুনিকা মুখে নিয়ে ঢুকি চিপে। বিশ্বাস নিজের পুরুষত্বের দাগ কাটে অরুনিকার দেহ। চরম উত্তেজনাই নিজেকে ভাসিয়ে এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে বিশ্বাস।
—নগ্ন শরীরে মেঝে থেকে কাপড় তুলে বাথরুমে যাওয়ার সময় টেবিলে রাখা ফোনের দিকে নজর পড়ে তার। সে দেখল রণক ফোন দিচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা ছিল । ফোন হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে। চল্লিশ বার রণক কল দিয়েছে। আবার রণক এর কল আসতেই কল কেটে ওর নাম্বার ব্লক করে। অরুনিকা চোখ ছাপিয়ে জল নামে। কোন মতো পোষাক টা পড়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। কেইস ফাইল বন্ধ করার জন্য বিনা পয়সায় বিছানায় যেতে হলো আজ অরুনিকার।
—হোটেল থেকে বাইরে আসতে নিয়েছে, দেখল ডক্টর মৃণাল তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে অরুনিকা বলল, আপনার কি ধারণা! এই সব করলে প্রায়শ্চিত্ত হবে?
—মৃণাল হতবাক হয়ে বলল,আপনার কথার মানে বুঝলাম না।
—তখন অরুনিকা বলল, একজন পতিতার দাহ্য বা একটা লাশ গুম করার মতো কাজ।অপরিচিত এক পতিতার জন্য এই সব কেউ কেন করবে? আমার জন্য এই সব করে। নিজের বোনের কাছে করা অপরাধের ক্ষমা কোন দিন হতেই পারে না ডক্টর মৃণাল।
আপনার ছোট বোন মৃধার সাথে যা হয়েছিল ওটার জন্য আপনি দায়ী। আপনি চাইলে সেই সময় ওকে বাঁচাতে পারতেন কিন্তু না আপনি পেছন সরে গেছিলেন ভয়ে। চোখের সামনে আপনার বোন'কে ওরা নিয়ে যায়। আপনি কিছুই বললেননি। চেষ্টাও করেননি নিজের বোন'কে বাঁচানোর।
—অরুনিকার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় মৃণাল। তার মানে আপনি ওকে চিনেন?
—হ্যা আমি মৃধাকে চিনি। খুব মিষ্টি মেয়ে ছিল। রূপোগাছী'তে আমার যাওয়ার কিছুদিন পরেই মৃধাকে পাচারকারীরা বিক্রি করে ওখানে।
—মৃণাল এর চোখ ছাপিয়ে জল নামে। আমাকে একটিবার ওর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন। আমি আপনার পায়ে পড়ি।
—মৃণাল এর চোখের জলে অরুনিকার হৃদয় গলে কিন্তু কিছু করার নেই। আমি দেখা করাতে পারব না।
—কিন্তু কেন!
—শুকনো মুখে অরুনিকা ব'লে, রুপোগাছী থেকে পালানোর কিছুদিন আগেই মৃধাকে বিদেশে বিক্রি করে দেওয়া হয়। শুনেছি উত্তর কোরিয়া কোন হোবাং হো নামে পতিতালয়ে মৃধা আছে। এটা তাও বছর পাঁচেক আগে শোনা। এখন কোথায় আছে আমার জানা নেই।
—অরুনিকার কথা শুনে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে মৃণাল। আমার বোন'কে তাহলে কি আমি কখনো দেখতে পারবো না? আমার বোনের চিন্তায় বাবা মারা গেছে। মা গুরুতর অসুস্থ। উনার শেষ ইচ্ছে মৃধাকে একবার দেখার। মৃণাল অরুনিকার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে কীভাবে চিনেন?
—অরুনিকা যা বলে তাতে মৃণাল নিজেকে আটকাতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। মৃধার স্কুল ব্যাগে মৃণাল এর ছবি ছিল। সবাইকে মৃধা দেখিয়েছে সেই ছবি। সে বলছে তার দাদা নিশ্চয়ই পুলিশের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বেড় করবে তাকে। কিন্তু মাস ছয়েকে পড়ে আপনাকে যখন অপরা দেখে চিনতে পারে। মৃধার কথা আপনাকে জানালে ওই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে বেড়িয়ে যান নিষিদ্ধ পল্লী থেকে। মৃধা আপনার আসার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু যখন জানতে পারে আপনি চলে গেছেন ও ভেঙে পড়ে তারপর পরপরই ওকে বিক্রি করে দেয় বিদেশে।
মৃণাল অরুনিকার পা ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে, যে ভাবেই হোক মৃধার খোঁজ বেড় করতে আমাকে সাহায্য করুন। আমি ওকে ফিরে আনবো। অতীতের করা ভুল আমি সংশোধন করবো। আমার বোন যাইহোক না কেন। ও আমার বোন এটাই একমাত্র সত্য এখন আমার কাছে।
—অরুনিকা নিজের ফ্লাটে এসে শুয়ে পড়ে। অনেকদিন পর নিজের ফ্লাটে ফিরে ভালো লাগে তার। কিন্তু রণকের কথা মনে পড়তেই, মন খারাপ হয়ে যায়। এই আট-নয় মাসে কত বিচিত্র ঘটনায় না ঘটে গেল অরুনিকার জীবনে। অপরার ফিরে আসা। রণকের সাথে পরিচয়, অপরিচিত এক নারীর জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা, ফিরোজার আবির্ভাব,তপনের সাথে প্রণয় তারপর একে একে সবাইকে হারিয়ে ফেলা। অপরার হারানোর শোকে পতিতা থেকে খুনি রূপধারণ করা। কি সব কত বিচিত্র ঘটনায় না ঘটে গেছে। রণকের চেহারা অরুনিকার চোখে ভেসে ওঠে। গাড়ির ভেতর সেইদিন পেছন ফিরে যে যুবকে সে দেখেছিল। সে মনের কোণে ভালো লাগার অদ্ভুত এক জায়গা সৃষ্টি করে আজও আছে। সভ্য সমাজের অংশ হওয়া একজন পতিতার পক্ষে সম্ভব না। একজন পতিতা সভ্য সমাজের অংশ হতে চাইলে তার পরিণতি হবে মৃত্যু। ঠিক যেভাবে তপন আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। তপনের কথা মনে পড়তেই অদিতির কথা মনে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জ্বলে ওঠে চোখ। ফোন হাতে নিয়ে ডক্টর অদিতি নাম সার্চ করে তার ফেসবুক পেইজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
*****
দিপেশ জেল থেকে পালিয়েছে এই খবর শুনে ভূমেন্দ্র সেন বেশ চিন্তিত। ভাঙা শামুকে পা কাটে ভূমেন্দ্র সেন এর তা ভালো করেই জানা। উষা'কে যে ভাবে দিপেশ হত্যা করেছে এতে স্পষ্ট বোঝা যায় এই পরিবার এর উপর দিপেশে ক্রোধ কতটা বেশি।
বেলকনিতে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বুক পকেট থেকে একটা পুরনো সাদাকালো ছবি বেড় করে। লম্বা চুলের বিনুনি। মোটা কাজল দেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে হুকো টানতে টানতে অতীতের স্মৃতি তলিয়ে যায় ভূমেন্দ্র সেন।

সময় উনিশশো ষাট। ভূমেন্দ্র তখন নবযুবক। বাড়ির বাগানের মালী পল্লব কাকার একমাত্র মেয়ে রমার সাথে তার প্রণয় তখন তুঙ্গে। রমা ছিল গ্রামের সব চেয়ে সুন্দরী মেয়ে। যার সাথে প্রণয়ের বাসনা কত পুরুষের তা বলে বোঝানো মুশকিল। কিন্তু ভূমেন্দ্র কপাল ছিল সোনাই সোহাগা।তাদের দুজনের প্রেম হলো। তারা প্রতিদিন বিকেলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে গ্রামের পাশের জঙ্গলের নদীর ধারে।

সকাল দশ'টা বাজে। ভূমেন্দ্র সেন চিন্তিত মুখে বসে আছে বাড়ির পেছনে সান বাঁধানো পুকুর ঘাটে। বাড়িতে রমা আর তার প্রণয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হ'য়ে গেছে। বাড়িতে এখন যেন ঝড় উঠেছে। জাতপাত না দেখে প্রণয় ব্যাপারটা কেউ মানতে রাজি না। তাকে এখনো ঘর বন্দী করা না হলেও বাড়ি বন্দী করা হয়েছে। বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। পল্লব কাকার সকাল থেকেই কোন খোঁজ নেই। হয়তো ঘটনাটা জানাজানি হতেই তার চাকরি ছাটাই করে দিয়েছে। না ভূমেন্দ্র আর এই ভাবে সময় নষ্ট করতে পারে না। যে করেই হোক রমার সাথে যোগাযোগ টা করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পুকুর ঘাটের পেছন দিকে একটা ভাঙা প্রাচীর ছিল। চারিদিক টা একবার লক্ষ করে সে বেড়িয়ে পড়ে। গ্রামের ছোট বেলার বন্ধু চয়নের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়। প্রথমে ভূমেন্দ্র পিতা জনেন্দ্র সেন এর ভয়ে না না করলেও পরে রমার সাথে দেখা করার একটা পাকাপাকি আয়োজন করে দেয় চয়ন। ভূমেন্দ্র বাড়ি ফিরে আসে। রাতের অন্ধকারে আজ সে দেখা করতে যাবে রমার সাথে। গোপনে বাড়ি ফিরে আবার পুকুর ঘাটে বসে পড়ে। বাড়ির কাকপক্ষীও জানতে পারে না ভূমেন্দ্র কিছু সময়ের জন্য বাড়ি ছিল না।
—পেছন থেকে ভূমেন্দ্রের মা সরলা সেন ডাক দেন।কিরে এখানে একা একা বসে আছিস কেন? বাড়ির ভেতর তোর আর পাত্রীর কুষ্ঠি বিচার করছে ঠাকুর মশাই। মেয়ে ভারী সুন্দর আর সুলক্ষণা। পাশের গ্রাম পঞ্চায়েতর একমাত্র মেয়ে দিলাত্রী ঘোষ।
—কিন্তু মা, আমি তো বিয়ে করবো না। এই সব আমাকে কেন বলছ ? তুমি তো জানো আমি রমা'কে ভালোবাসি। আর তুমি যে মেয়ো'কে সুলক্ষণা বলছ। সেই মেয়ে সম্পর্কে তোমার ধারণা অতি অল্প। মেয়েটির চরিত্র ভালো না। নিজের বোন'কে খুন করার তকমা গায়ে যার, সে কীভাবে সুলক্ষণা হতে পারে মা?
—ভূমেন্দ্র মুখে রমা নাম শুনতেই সরলা সেনের চোখ জ্বলে ওঠে। তুই কি ওই নিচু জাতের মেয়ে'কে ভুলতে পাচ্ছিস না। উচ্চ বংশের মেয়েদের উপর অনেকেই হিংসা করেই বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে দেয়। সব কি আর সত্যি মানা যায়? দিলাত্রীর বোনের মৃত্যু ছিল একটা এক্সিডেন্ট। একটা সামান্য এক্সিডেন্ট এর জন্য উচ্চ বংশের মেয়ের সাথে তুই ওই নিম্ন বংশের নিচু জাতের মেয়ের তুলনা করবি? হ্যা, মানছি এই বয়সে প্রেমে সব কিছুই ভালো লাগে কিন্তু তাই বলে, তুই দিলাত্রী আর রমার মাঝে তুলনা করবি! তোর বাবা কিন্তু এখনো ওই মেয়ের পরিবার এর কোন ক্ষতি করেনি। তুই যদি বেশি ঝামেলা করিস তাহলে পঞ্চায়েতে ওই মেয়ে আর পল্লব'কে পিটিয়ে মারার রায় দিবে তোর বাবা।
—মায়ের চলে যাওয়ার পর ভূমেন্দ্র চিন্তা করে। উচ্চ বংশে খুন করাটা বড় ব্যাপার না কিন্তু নিম্ন জাতের সাথে প্রণয় টা ঘোর অপরাধ।
—রাতের অন্ধকারে ভূমেন্দ্র চলে যায় গ্রামের পাশের জঙ্গলে নদীর ধারে। সেখানে আগে থেকেই চয়ন অপেক্ষা করছিল রমা'কে সাথে নিয়ে। ভূমেন্দ্র'কে দেখে রমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার মানুষটিকে।
—রমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে ভূমেন্দ্র, তুমি কোন চিন্তা করো না রমা। আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।
—কিন্তু কি করে ভূমেন্দ্র? তোমার পরিবার আমাকে কখনো মেনে নিবে না।
—মেনে নেওয়ার ওরা কেউ না। আমি তোমাকে মেনে নিলেই হলো। আজকে এই মূহুর্তে আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
রমা'কে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মন্দিরে যায় ভূমেন্দ্র। সেখানে কোনমতেই ঠাকুর মশাই'কে রাজি করানো যাচ্ছিল না। অনেক জোরাজোরি করার পর ঠাকুর মশাই রাজি হয়। চয়ন এর উপস্থিতিতে আগুন'কে স্বাক্ষী করে ভূমেন্দ্র আর রমার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়।
রমা'কে নিয়ে আবারও নদীর ধারে চলে আসে ভূমেন্দ্র। চাঁদের আলোয় রমা'কে অদ্ভুত মায়াবী লাগে। মাথার টানা সিঁদুর যেন রমার সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমেন্দ্র রমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবে দেয়। নদীর ধারে সদ্য নববিবাহিত দম্পতির মিলন ঘটে।
—ভোরের দিকে তখন ভূমেন্দ্র ক্লান্ত শরীর রমার উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। রমার চোখে ঘুম নেই। বিয়ে তারা করেছে ঠিকই। কিন্তু এই বিয়ে কি কেউ মেনে নিবে? তারা যে নিচু জাত।
—সকালে ঘরে ভূমেন্দ্র'কে না দেখে, পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে সরলা সেন। জনেন্দ্রের মুখের পেশি শক্ত হয়ে ওঠে। কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গদের পল্লবের বাড়ি গিয়ে মেয়ে আর বাপ'কে তুলে আনবার হুকুম দেয়।
বাড়িতে গিয়ে তারা শুধু পল্লব'কে খুঁজে পায়। গ্রামের লোকসমাগম পল্লব'কে টেনেহিঁচড়ে পঞ্চায়েতে নিয়ে আসা হয়। জনেন্দ্র সেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে সেখানেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করার হুকুম দেয়।
—সকালের আলো চোখে পড়তেই ভূমেন্দ্র ঘুম ভাঙে। নিজেদের পোষাক ঠিকঠাক করে নিয়ে। রমা'কে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে সে চলে আসে নিজ বাড়ি।
এইদিকে রমা গ্রামে ঢুকতেই গ্রামের লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারদিকে। সবার চোখেই ঘৃণা বিরাজমান। রমা তা ভালো করেই বুঝতে পারে। বাড়ি ফিরতেই বান্ধবী মিনতি এসে ব'লে, তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যা রমা। তোর বাপেক গাছের সাথে ঝুলিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে। পঞ্চায়েতর লোকেরা তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। সময় থাকতে তাড়াতাড়ি পালা।
গ্রামে খবর বাতাসে উড়ে। রমা বাড়ি ফিরেছে এই খবর লোকে মুখে মুখে পঞ্চায়েতে পৌঁছে গেছে।
রমা বাপের মৃত্যুর খবর শুনে দৌড়ে গিয়ে সরাসরি পঞ্চায়েতে হাজির । ঝুলন্ত বাপের লাশ দেখে সে পাথরে পরিণত হয়। ওই একই পঞ্চায়েতে হুকুম হয় রমা কেউ পিটিয়ে হত্যা করার। বাপের ঝুলন্ত লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রমাকেও যখন গাছের সাথে ঝুলাবার ব্যবস্থা চলছে। তখন সেখানে ভূমেন্দ্র আসে। পিতার হাতে পায়ে পড়ে রমার জীবনের পরিবর্তে সে দিলাত্রী কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
—ভূমেন্দ্র পিতা জনেন্দ্র পঞ্চায়েতে ছেলের শর্তে রাজি হয় সেই সাথে নিজের আরও একটা শর্ত চাপিয়ে দেয়। যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো রমা আর ভূমেন্দ্র এক না হতে পারে। ওই একই পঞ্চায়েতে জনেন্দ্রের হুকুমে রমা'কে গ্রামের উচ্চ বংশের পুরুষদের রক্ষিতা ঘোষণা করা হলো। যে কেউ ইচ্ছে করলেই রমা'কে নিয়ে রাত কাটাতে পারবে।
—রমার তখন চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। সে বাপের মৃত্যুর শোকে পাথর। তার কি শাস্তি হয়েছে সেই দিকে তার কোন খেয়াল নেই। ভূমেন্দ্র সেই দিন কিছুই করতে পারেনি কারণ তার কোন ক্ষমতাই ছিল না।
—দিন-মাস পেরিয়ে কয়েক বছর পাড় হয়। জনেন্দ্র মারা গেছে। দিলাত্রী তখন সেন পরিবার এর পুত্রবধূ। ভূমেন্দ্র সেন এখন পঞ্চায়েত প্রধান। রমার জীবন পরিবর্তনে জন্য ভূমেন্দ্র সেন একদিন রমার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। তখন রমা গ্রামের উচ্চ বংশের এক পুরুষ এর সাথে বিছানায় শুইয়ে আছে।
—রমার এমন পরিণতি দেখে ভূমেন্দ্র সেন নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। বাইরে বেড়িয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অভিশপ্ত এই জীবন থেকে রমা'কে বেড় করতে আবারও ছোট বেলার বন্ধু চয়ন এর বাড়ি যায়।
চয়ন ছিল গরীব ঘরের ছেলে। মূর্তি তৈরি করে যে পয়সা পেত তা দিয়ে কোন মতে সংসার চালাত। ভূমেন্দ্র চয়নের কাছে প্রস্তাব দেয় নগদ দুই লক্ষ টাকা সে পেতে পারে যদি গ্রামের লোক সম্মুখে রমা'কে বিয়ে করে। যদিও এই বিয়ে হবে শুধুই লোক দেখানো। রমার সব দায়িত্ব ভূমেন্দ্র নিজে নিবে।

সাংসারিক অসুবিধার জন্য চয়ন আর তার স্ত্রী দুজনেই রাজি হয়ে যায়। রমা'কে রাজি করিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে তারা। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয় তখন যখন এই খবর জানতে পারে দিলাত্রী সেন।

দিলাত্রী সেন ষড়যন্ত্রে রাতারাতি পুরো গ্রামের মানুষ তার পক্ষে চলে যায়। পরের দিন যখন মন্দিরে চয়ন আর রমার নকল বিয়ের আয়োজন চলছে তখন দিলাত্রী সেন এসে হাজির হয়। গ্রামের লোকজনের সমাগমের ভেতর দিলাত্রী সেন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে। আচ্ছা এর আগে কখনো কি শুনেছেন? বাইরের পন্ডিত মশাই'কে দিয়ে আমাদের গ্রামের মন্দিরে বিয়ের পড়ানো হয়েছে? মন্দির যখন গ্রামের তখন পন্ডিত মশাই কেন বাইর গ্রামের হবে?

—গ্রামের মানুষ সমস্বরে বলে ওঠে, হ্যা ঠিক তাই। ঠাকুরানী ঠিক বলছে। মন্দিরের পন্ডিত মশাই থাকতে বাইর গ্রামের পন্ডিত কেন?

—ভূমেন্দ্র তখন ছটফট করছিল। বাইর গ্রাম থেকে সে এনেছে নকল পন্ডিত। এখন এই মূহুর্তে পন্ডিত এর পরিবর্তন হলে তাহলে নকল বিয়ের জায়গায় আসল বিয়ে হয়ে যাবে। ভূমেন্দ্র অবস্থা দেখে দিলাত্রী আনন্দিত হয়। গ্রামের সব মানুষ দিলাত্রী পক্ষেই কথা বলে তাই ভূমেন্দ্র হাজার চেষ্টা করেও আর কিছুই করতে পারে না।

—অন্যদিকে চয়ন আর তার স্ত্রী মুখ শুকিয়ে গেছে। অভাবের কারণেই তারা এই কাজ করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এখন যদি সত্যি বিয়েটা হ'য়ে যায় তখন কি হবে! দেখতেই দেখতে দিলাত্রীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয় ভূমেন্দ্র, রমা,চয়ন ও তার স্ত্রী।
—গ্রামের মানুষ এর সামনে চয়ন আর রমার বিয়ে হয়। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে চয়নের স্ত্রী চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে। তারপরেই হটাৎ মাথা ঠান্ডা করে সে ব'লে ওঠে। আরেহ আমরা তো ভুলেই গেছিলাম রমার আগেই বিয়ে হয়েছে। তার মানে এখনো আমরা এটাকে নকল বিয়ে মানতেই পারি। কারণ এক স্বামী বেঁচে থাকা কালীন সময়ে অন্য কোন বিয়ে হতে পারে না।

এরপর থেকে সব স্বাভাবিক ছিল। রমা ছিল চয়নের নামের স্ত্রী। গোপনে ভূমেন্দ্র আর রমা পেতেছিল ছোট্ট এক সংসার। বছর পেরুতেই ঘর আলো করে জন্ম নেয় তাদের এক পুত্র সন্তান। দুজনেই ভালোবেসে নাম রাখে দিপেশ। রমার জীবনের অন্ধকার কেটেই গেছিল। কিন্তু তখনই গোপন সূত্রে ভূমেন্দ্র আর রমার ব্যাপারে সবকিছু জেনে দিলাত্রী পুনরায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এইবার সে গ্রাম বাসীর কাছে রমা যে এখনো রক্ষিতা রয়ে গেছে এটাই প্রমাণ করে।
—ভূমেন্দ্র যখন প্রতিবাদ করতে নেয়। তখন দিলাত্রী, রমা আর ভূমেন্দ্রর সন্তান'কে অপহরণ করে। নিজ সন্তানের জীবনের ভয়ে সেইদিনও পঞ্চায়েত রমা আবারও রক্ষিতা হিসেবেই পরিচিত হয়। রমা নিজের জীবন মেনে নেয়। সে স্বীকার করে ভূমেন্দ্র সেন এর রক্ষিতা সে।
— চয়ন নিজের সম্মান বাঁচতে রমা'কে নিজ বাড়ি থেকে বেড় করে দেয়। তারপর থেকেই রমা রক্ষিতা হিসেবেই ভূমেন্দ্র বাড়ি থেকে যায়। অন্য দিকে ভূমেন্দ্র আর দিলাত্রী ঘর আলো করে জন্ম নেয় রণক। দিলাত্রী সন্তান বংশের প্রদীপ রূপে বড় হতে থাকে। আর রমার সন্তান দিপেশ নিজ বাড়িতেই প্রতিহিংসা মনে নিয়ে কাজের ছেলে হিসেবে বড় হয়।

—দিপেশ জানত তার বাবা হলো চয়ন। ভূমেন্দ্র ক্ষমতার জোরে তার মা'কে রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছে। এই সব কথা সে দিলাত্রী কাছ থেকেই শুনেছে। রমা কখনো ভূমেন্দ্রের কথা দিপেশ'কে বলেনি। সে চাইত না দিপেশ এর গায়ে কোন কলঙ্ক লাগুক। কারণ দিপেশ যখন হয়েছে তখন গ্রামের সবাই রমা'কে চয়নের স্ত্রী হিসেবেই জানত। তাই সবার এই ধারণা হয় যে দিপেশ চয়নেরই ছেলে।

—চয়নের থেকে দূরত্ব আর ভূমেন্দ্রর বাড়িতে মায়ের রক্ষিতা হয়ে থাকাটাই দিপেশের মাঝে প্রতিহিংসার বিজ বপন হয়। ছোট্ট বেলা থেকেই দিপেশ ভূমেন্দ্র বংশের বিনাশ চাইত মনে প্রাণে। ছোট্ট এই ছেলের মনের ঘৃণা তার মা রমাও বুঝতে পারেনি। এই ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালার কাজ দিলাত্রী খুব ভালোই করেছে।

দিনে দিনে ভূমেন্দ্র নিজেও তার বংশের পদমর্যাদা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শুরু করে। তাই তার যে বড় সন্তান এর প্রতি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তা আর পালন করা হয়ে ওঠে না।

সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হলেও রমার জন্য তখন ভূমেন্দ্র ভালোবাসা ছিল। রমা যখন আবার গর্ভবতী হয় তখন ভূমেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর নয় এবার সে রমা'কে সকলের সামনেই স্ত্রী মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নিবে। ভূমেন্দ্র ইচ্ছে ছিল এবার তার ঘরে একটা কন্যা সন্তান আসবে। রমার আদরযত্ন দেখে দিলাত্রী সহ্য করতে পারত না। তাই সুযোগ বুঝে সন্তান প্রসবের পর দিলাত্রী মৃত সন্তান রমার কন্যা সন্তান এর সাথে পালটে দেয়। ভূমেন্দ্র কন্যা সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর রমা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

******
এতো বছর পরেও রমার জীবন আর মৃত্যু দুটোই কাঁদায় ভূমেন্দ্রকে। ভূমেন্দ্র ভালোবাসা প্রমাণ তার বুকপকেটে রাখা রমার ছবি। ভূমেন্দ্রের চোখে পানি কারণ নিজের অজান্তে রমা আর তার একমাত্র মেয়ে উষার মৃত্যুর হুকুম সে নিজেই দিপেশ'কে দিয়েছে। বংশের মানসম্মান রক্ষা করতে দিলাত্রী কথা শুনেই উষা'কে মারার হুকুম দিয়েছিলেন ভূমেন্দ্র। তখন যদি জানত উষা তার আর রমার মেয়ে। তাহলে এই ভুল সে কোন দিন করতো না। নিজের দাদার হাতে ছোট বোনের মৃত্যু কি নৃশংস!

ভূমেন্দ্র চোখ বেয়ে জল পড়ে। দিলাত্রী সেন পেছনে এসে দাঁড়ায়। এতবছর পরেও স্বামীর হাতে রমার ছবি দেখে জ্বলে ওঠে দিলাত্রী। কি ব্যাপার পুরোনো প্রেম মনে উঁকি দিচ্ছে নাকি?

—দিলাত্রী কথায় চমকে উঠে ভূমেন্দ্র। তুমি! তুমি এখানে কি করছো? আর কি চায় তোমার? আমাকে একা ছেড়ে দাও।
—চাওয়ার মতো এখনো অনেক কিছুই আছে।
—আমার জানা মতে আর কিছুই নেই দিলাত্রী। তোমার ষড়যন্ত্রের শিকার হ'য়ে নিজের মেয়ে'কে মারার মতো জঘন্য পাপ আমার হাতে হয়েছে। নরকেও স্থান হবে না আমার। দিপেশ আমার বড় ছেলে কিন্তু বলার মতো পরিস্থিতি তুমি রাখোনি।রমার মৃত্যুর পর দিপেশ'কে আমার নাম দিতেও তুমি দাওনি। সব কিছুর জন্য তুমি দায়ী।

—ভুল বললে ভূমেন্দ্র। আমার জন্য কিছুই হয়নি। তোমার ব্যক্তিত্বহীনতার জন্যই সব কিছু হয়েছে। কোন নারী চাইবে না তার ঘরে সতীন আসুক। আমিও চাইনি তাই ওই সব কিছু করেছি। তুমি চাইলে সব কিছু ঠিক করতে পারতে।কিন্তু বংশ মর্যাদার দোহাই দিয়ে তুমি নিজেই কিছু করোনি। এতো দিন ধরে যখন কিছুই করোনি। আশা করছি এখনো কিছু করার চিন্তা তুমি করবে না ভূমেন্দ্র। দিপেশ এর মৃত্যু অবধারিত কারণ সে আমার একমাত্র ছেলে রণকের জীবনের পেছনে পড়েছে।

—ভূমেন্দ্র কিছুই বলে না। চুপচাপ ধীরগতিতে চোখ বন্ধ করে। কারণ দিলাত্রী এই কথা সত্যি বলেছে। বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে দিনের পর দিন অন্যায় সব কিছুই সে মেনে নিয়েছে। ভূমেন্দ্র কে সামনে রেখে দিলাত্রী সব কিছু কঠোর শাসক রূপে পরিচালনা করেছে এতদিন। সে তো নামে মাত্র পঞ্চায়েত প্রধান। সব শক্তি দিলাত্রী হাতেই।

—ভূমেন্দ্র আর ভাবতে পারে না। সে নিজের চোখে সন্তানের মৃত্যু দেখতে পারবে না। সে কোন ভাবেই কিছু আটকাতেও পারবেনা। দিপেশের প্রতিহিংসা ওকে অন্ধ করে রেখেছে। জেল থেকে পালিয়ে সে নিশ্চয়ই প্রথমে তাকেই মারতে চাইবে তারপর রণক'কে। ভূমেন্দ্র যদি এখন দিপেশ'কে বলে সে তার বাবা। তাহলে দিপেশ কি এই কথা মেনে শান্ত হয়ে যাবে! নিজের মনে প্রশ্ন করতে করতে সে উঠে দাঁড়ায়। না আসলেই তার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব না। সে নিরবে উঠে যায় ছাদে। ছাদের রেলিং এর কাছে এসে একবার আকাশ পানে তাকিয়ে ব'লে, আমাকে ক্ষমা করে দিও রমা। আমি না হতে পেরেছি ভালো স্বামী আর না ভালো বাবা। আমি কিছুই হতে পারিনি। ভূমেন্দ্র ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে দিলাত্রী। এমন পুরুষত্বহীন স্বামীর জন্য সে এতো লড়াই করেছে! ভাবতেই তার ঘৃণা লাগে। সে এখন যা করবে তা শুধুই নিজের একমাত্র সন্তান রণকের জন্য।  

দিপেশ জেল থেকে পালিয়ে হন্যে হয়ে ফিরোজা'কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফিরোজার কোন খোঁজ না পেয়ে। সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে ভূমেন্দ্র উপর। আচ্ছা অক্ষরার মতো ফিরোজার সাথেও। না এটা হতে পারে না। সে একবার ভালোবাসা হারিয়েছে দ্বিতীয়বার হারাতে দিতে পারে না। তাই ছুটে যায় গভীর রাতে ভূমেন্দ্র সেন এর বাড়িতে। অন্ধকারে বাড়ির ভেতর ঢুকতে নিতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। অন্ধকারে কোন মতে উঠে দাঁড়াতেই পেছন থেকে কেউ মাথায় সজোরে আঘাত করে। মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে যায় দিপেশ।
—দিলাত্রী সেন বাড়ির ভেতর অপেক্ষা করছে দিপেশের জন্য। স্বামী মরে পড়ে আছে বাইরে সেই দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। এমন শক্ত মনে নারী এর আগে হয়তো কেউ কখনো দেখেনি। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে তার সাঙ্গপাঙ্গদের মাঝে। বাড়ির ভেতর ভোরের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে। দিপেশ আসেনি এটা ভেবেই চিন্তিত হলো দিলাত্রী। বাড়ির বাইরে হৈচৈ শুরু হ'য়ে গেছে। দিলাত্রী তার সাঙ্গপাঙ্গদের বাড়ির গ্যারেজের দরজা দিয়ে বেড় করে দিয়ে, নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে।
—বিমলা ছুটে এসে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে, ঠাকুরানী প্রধান আর নেই। দিলাত্রী না জানা’র ভান করে বিছানা থেকে উঠে ছুটে বাইরে যায়। দিলাত্রী সেন এর ছুটে যাওয়া স্বত্তেও বিমলার সন্দেহ হয়। কেন জানি মনে হয় তার ঠাকুরানী আগে থেকেই প্রধান এর মৃত্যুর ব্যাপারে জানত। এই বিমলাই শুরু থেকে দিলাত্রী সেন এর সব অপকর্মে সহচরী ছিল। যদি দিলাত্রী আগে থেকেই প্রধানের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানত. তাহলে তাকে কিছু বলল না কেন! আর তার সামনে এই না জানবার অভিনয় কেন?
—বিমলা নিজের মনের ভুল বলে ঠাকুরানীর পেছন পেছন ছুটে যায়। এতক্ষণে পুরো গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। পুলিশ এসে তদন্ত করেছে। দিলাত্রী সেন কান্নাই ভেঙে পড়েছে। গ্রাম্য মহিলারা এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। পুলিশ লাশ নিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠাতে চাইলে পঞ্চায়েতর কিছু সদস্য বলল, প্রধানের লাশ কেটে টুকরো করে কি আর ধরা পড়বে! বুঝাই যাচ্ছে আমাদের প্রধান বংশের মর্যাদা ডুবে যাওয়া সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।
—গ্রামের বিধবা মহিলারা এসে দিলাত্রী সেন এর হাতের শাঁখা পলা ভেঙে দিয়ে, সিঁদুর মুছে দিল। গায়ে জল ঢেলে দিয়ে তাকে সাদা শাড়ী পড়িয়ে দেয়। স্বামী মারা গেছে সেই শোকের থেকেও সে বেশি শোকাহত হয়েছে দিপেশ না আসায়।
—দূরে দাঁড়িয়ে রণক তার পিতার দাহ্য দেখছে। যে মানুষ অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সে কীভাবে নিজে আত্মহত্যা করে! ধীরে ধীরে সব কিছুই কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠছে। অতীতের কোন রহস্যের জালে বর্তমানে তাদের জীবন আবদ্ধ হয়ে আছে। তা জানা নেই রণকের। ভূমেন্দ্র ভালো লোক ছিল না এটা জানা স্বত্বেও পিতার মৃত্যুতে তার খারাপ লাগছে।
***
সোফায় বসে আছে অরুনিকা। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মৃণাল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। মেঝের ভেতর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে দিপেশ। ফেরারি আসামি দিপেশ'কে খুঁজতে পুলিশ ব্যস্ত। তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অরুনিকা দিপেশ'কে অপহরণ করেছে মৃণাল এর সহায়তা নিয়ে।
—দিপেশ এর জ্ঞান ফিরেছে।আশেপাশে তাকিয়ে সে কোথায় আছে তাই বোঝার চেষ্টা করলো। অরুনিকা'কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দিপেশ। এর আগে যখন দিপেশ এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল অরুনিকা তখন দিপেশ ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই অরুনিকার বেঁচে থাকার গল্পটা ওর কাছে সম্পূর্ণ নতুন।
—তুমি কি করে বেঁচে আছো? তুমি তো..
—দিপেশের বলার আগেই অরুনিকা বলল। আমি তো কি! মারা গেছি। এই কথা বলেই হা হা হা করে হেসে উঠে।
—পাশে থেকে মৃণাল বলল, আমি তাহলে এখন যাই। আপনি তো বাকী কাজ করবেন। যখন গুম করার ব্যবস্থা করতে হবে তখন না হয় আসব।
—মৃণাল এর কথা শুনে দিপেশ ভয় পেয়ে চিৎকার করতেই নিয়েছে তখন অরুনিকা বলল, চিৎকার করে লাভ হবে না। এই বাড়ির ভেতরের কোন শব্দ বাইরে অব্দি যায় না। এই জন্যই ডক্টর মৃণাল বুদ্ধি করে এই বাড়িতে এনেছে।
—আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি অরুনিকা। যা করার ফিরোজা করেছে। তাহলে তুমি আমাকে কেন মারতে চাচ্ছ?
—অরুনিকা বলল, হুম ঠিক তুমি কিছুই করোনি শুধু ফিরোজা'কে সাহায্য করেছ। ঠিক যেমন মৃণাল এখন আমাকে সাহায্য করছে। এখন তুমি চিন্তা করে দেখতো। তুমি যদি বেঁচে যাও তাহলে শুধু আমাকে মারার চেষ্টা করবে? নাকি সাথে মৃণাল কেউ মারবে?
—দিপেশের মুখে কোন কথা নেই। অরুনিকা বলেই চলছে। আমাকে যখন ফিরোজা নির্যাতন করছিল তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে। আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলে?
আর উষা! ওই বেচারি তো নিজেই অসুস্থ ছিল। তোমার কোন ক্ষতি করা তো দূরের কথা। তাহলে ওকে কেন মারলে?
—উষার নাম শুনতেই দিপেশ এর চোখ ছাপিয়ে জল নামে। চিৎকার করে ব'লে ওঠে। হ্যা, আমি মেরেছি। আমি আমার বোন'কে মেরেছি। আমার শাস্তি পাওয়া উচিত। আমাকে মারো কিন্তু তার আগে ভূমেন্দ্র বংশের সবাইকে মারার একটা সুযোগ করে দাও। দিপেশ এর কথা শুনে অরুনিকা আর মৃণাল দু'জনেই অবাক হয়ে যায়। তোমার বোন এর মানে কি?
—হ্যা, হ্যা উষা আমার বোন। আমি জানতাম না ও আমার বোন। জানলে এই জঘন্য পাপ কোনদিন করতাম না।
—অরুনিকা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, নিজের বোন'কে মারা জঘন্য পাপ আর অন্যের বোন'কে মারা পাপ নয় বুঝি।
—অন্যের বোন'কে মারা পাপ হতে পারে। কিন্তু রণকের বোন'কে মারা পাপ ছিল না। রণকের বাপ-মায়ের জন্য আমার সহজসরল মায়ের জীবন ধ্বংস হয়েছে। সারাজীবন রক্ষিতা হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। আমার বাপ চয়ন আমার মা'কে মেনে নেয়নি। কারণ তার একমাত্র ভালো বন্ধুর রক্ষিতা হয়েছিল তার নিজের স্ত্রী।
কোন দিন বাপ বলে ডাকতে পারিনি আমি তাকে। কার জন্য! শুধু ওই ভূমেন্দ্র সেন এর জন্য। আমার ভালোবাসা অক্ষরা কেউ ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছিল।
এতো কিছু পরে যখন প্রতিশোধ নিতে ভূমেন্দ্র মেয়ে উষা'কে মেরে ফেললাম। তখন জানতে পারলাম উষা আমার নিজের বোন। উষা দিলাত্রী সেন এর মেয়ে না। আমার মায়ের মেয়ে ছিল উষা। তুমি ভাবতে পাচ্ছ অরুনিকা? উষার জীবন আমি নিজে ধ্বংস করেছি। আর তারপর তো নির্যাতন করতে করতে ওকে মেরেই ফেলেছি।
—দিপেশ এর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অরুনিকা। কিছুটা সময় নিয়ে অরুনিকা বলল, সে তুমি যে কারণেই এই সব করে থাকো না কেন।তুমি অন্যায় করেছ এটাই বড় কথা। বেচারি অসুস্থ মেয়েটার জীবন নিয়ে দীর্ঘ সময় তোমরা খেলেছ। আর তারপর নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করেছে। তোমাকে একবারে মারব না আমি। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর মুখ যখন পতিত হবে। আমি তখন দাঁড়িয়ে দেখব সেই দৃশ্য।
—মৃণাল এর দিকে তাকিয়ে অরুনিকা বলল, ঘরে বন্দী করে রাখুন। না খেতে পেয়ে ওর মরণ আসুক। এই বলে বেড়িয়ে আসে অরুনিকা। ইচ্ছে ছিল নিজের জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার কিন্তু হটাৎ করেই উষার কথা মনে পড়ে গেল। রণকের বক্তব্য অনুসারে উষা'কে খুব কষ্ট দিয়ে এই শয়তান মেরেছে।
*****
বেশ কিছুদিন হলো আভা আর তার ফ্রেন্ড সার্কেল কোরিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার চিন্তা-ভাবান করছিল। কিন্তু দি-ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ কম থাকার কারণে পারমিশন নিতে পাচ্ছিল না। তাই আজ অরুনিকার কাছে ফোন দেয় আভা। ফোনের রিং বাজতেই অরুনিকা রিসিভ করে।
—হ্যালো, হ্যা বল আভা। কি খবর তোর?
— দি-ভাই আমার কথা ভুলে গেছো?
—আরেহ না ভুললাম কোথায়!
—দি-ভাই একটা কথা বলতাম।
—হ্যা, বল।
—কিছুদিন হলো বলবো বলবো করে বলে ওঠা হয়নি। আমি আর আমার কিছু বন্ধু বান্ধবী মিলে কোরিয়াতে বেড়াতে যাওয়ার প্লান করছিলাম। এখন তুমি রাজি হলে আর কি।
—কতজন মিলে যাচ্ছিস?
—আট-দশ জন হবে দি-ভাই। টেনশন এর কারণ নেই। যারা যাচ্ছি আমরা সবাই ইউনিভার্সিটির বন্ধু-বান্ধবী।

বেশ কিছু-দিন কেটে গেছে আভার সাথে যোগাযোগ হয়নি। বলেছিল উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছেই ফোন করে জানাবে। কিন্তু ফোনেই পাওয়া যাচ্ছে না এখন ওকে। অরুনিকাও যে কোরিয়া যাচ্ছে এই খবর জানাবে কি করে! এই চিন্তায় চিন্তিত অরুনিকা।
সকাল সকাল রণক এসেছে অরুনিকার বাড়িতে। সেখানে ডক্টর মৃণাল এর উপস্থিতি তার মোটেও পছন্দ হয়নি। অরুনিকা কি কারণে এই অপরিচিত লোকটিকে সাথে নিয়ে ঘুরছে রণকের তা জানা নেই। জানবার ইচ্ছেও নেই। অরুকে সে ভালোবাসে। কিন্তু অরু ইদানিং কেমন জানি হ'য়ে গেছে। ঠিক কেমন হয়েছে তা এখনো রণক বুঝে উঠতে পারে না।
অরুনিকা ঘর থেকে বাইরে এসে রণককে দেখে অসম্ভব খুশি হয়। কিছু দিন হলো রণকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা সে করেছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুর শোকে নিশ্চয়ই শোকাহত রণক।তাই যোগাযোগ করে এই মূহুর্তে রণকে বিরক্ত করাটা ঠিক বলে মনে করেনি। নিজের খুশিকে চেপে রেখে গম্ভীর মুখে অরুনিকা বলল, আপনি এখানে! হটাৎ কি মনে করে?
—এই কথা তো আমার জিজ্ঞেস করা উচিত অরু। আজকাল মৃণাল এর সাথে ঘোরাঘুরি টা তোমার বেশি হয়ে যাচ্ছে না!
—সে কি কথা! বেশি হতে যাবে কেন? মানুষের প্রয়োজন কি থাকতে পারে না! নাকি আমরা পতিতা বলে, আমাদের কোন প্রয়োজন থাকে না।
—কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বললেও পারো অরু।
রণকের ব্যবহারে মৃণাল কিছুটা কষ্ট পায়। অরুনিকাকে নিজের দিদির মতোই সে দেখে। যদিও বয়সে হয়তো অরুনিকা ছোট হবে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা অরুনিকার থেকে বেশি হয়তো কেউ দেখেনি।জীবন যুদ্ধ এখনো যে টিকে আছে এটা অনেক। আর এই কারণে সে অরুনিকা কে সম্মান করে। অরুনিকার যাবতীয় কাজে সে সাহায্য করছে কারণ নিজের বোনের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ এর একমাত্র মাধ্যম হলো অরুনিকা।
অরুনিকার ডাকে স্বজ্ঞানে ফিরে মৃণাল। অরুনিকা বলল, কোথায় হারিয়ে গেছিলেন? এতক্ষণ হলো ডাকছি।
—মৃণাল বলল, না আসলে। একটু থেমে কথা ঘুরিয়ে বললেন, কিছুই ভাবছি না। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন? আমার আবার হসপিটালে যাবার সময় হ'য়ে গেছে। আজকে তো আবার ছুটিও নিতে হবে গোছগাছ করা হয়নি কিছুই।
—আচ্ছা তাহলে আপনি এখন যান সন্ধ্যাই দেখা হচ্ছে।
মৃণাল আর কিছু না বলে বেড়িয়ে গেল।
—রণক অরুনিকার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, কিসের গোছগাছ? কি লুকাচ্ছ আমার কাছে? তুমি কি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পাচ্ছো না অরু? তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু তোমার এই জীবনের মুক্তির পথ আমার অজানা। নিজের জীবন নিয়েও আমি এখন অনিশ্চিত। বাবা মারা গেছেন। পুলিশের ভাষ্যমতে উনি আত্মহত্যা করেছেন। ছোট বেলা থেকে যে মানুষটাকে কঠোর বদমেজাজি যেনে এসেছি। সেই মানুষ কি করে আত্মহত্যা করতে পারে! এই দিকে দিপেশ সুস্থ হয়ে,জেল থেকে পালিয়েছে আর তার উপর তোমার এই পরিবর্তন। ডক্টর মৃণাল এর সাথে অবাধ চলাফেরা আমার কিছুই ঠিক মনে হচ্ছে না।
—অরুনিকা মৃদু হেসে বলল, আপনার সব দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় আমার কাছে আছে।
—কিসের উপায়?
—এইতো এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে আমি পারি যদি আমাকে তুমি জড়িয়ে ধরো। অরুনিকা ঠোঁটে দুষ্টুমি মাখা হাসি।
—এই প্রথম অরুর মুখে তুমি ডাক আর এমন আচরণে রণক অবাক হলো। এর আগে কখনো অরু তুমি বলে সম্মোধন করেনি। নিজের থেকেই কাছে আসার আহ্বান তো কখনোই করেনি। সব সময় দূরে যাওয়ার একটা না একটা বাহানা করতো সে। কিন্তু আজ!
—কি হলো তুমি আবার কি ভাবতে শুরু করলে। আচ্ছা জড়িয়ে ধরতে হবে না। তোমার মনের দুশ্চিন্তা আগে দূর করি।
তোমার ভালোবাসা আমি বুঝতে পারি ব'লেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অরুনিকা একটু থামল।
—কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ বলো।
—সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা এক সাথেই থাকব। আমার মুক্তির পথ তোমার খুঁজার প্রয়োজন নেই। ধর্মে একটা কথা আছে। এক জন্মের পাপের শাস্তি অন্য জন্মে হয়। নিশ্চয়ই কোন জন্মে আমার কঠিন কোন পাপ ছিল তাই এই জন্মে নটি হয়েছি। আর ভগবান যাকে যে অবস্থায় রাখে সেই অবস্থায় থেকেই ভগবান নাম যপাই হলো ভবিষ্যতের মুক্তির পথ। আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। সমাজ আমাকে কখনো মেনে কোনদিনই নিবে না। সেই কষ্ট আমার নেই কারণ এই দেখ না তোমার মতো একজনকে আমার জীবনে ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছে।
—অরুর কথায় রণকের চোখ ছাপিয়ে জল নামে । জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে চলো দু'জনে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে না জানবে কেউ তোমার পরিচয় আর না আমার। সেখানে তুমি আমি সংসার পাতবো।
—হ্যা, যাওয়া তো যায়। তবে তার আগে কিছু কাজ আছে আমার আর তোমার।
—আমার আবার কি কাজ আছে! যা আমি নিজেই জানি না। আর তোমারই বা কিসের কাজ?
—আছে অনেক কাজ আছে। তোমার বাড়ির অতীতেই লুকিয়ে আছে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর। তোমার বাবা সেই অতীতের বোঝার ভার সামলাতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে।
—এই সব তুমি কি বলছো অরু?
—আমি ঠিকই বলছি। বলে ছিলাম না তোমার দুশ্চিন্তা দূর করবো। তাইতো একে একে উত্তর গুলো দিচ্ছি। দিপেশ আমার কাছে আছেই। আমি আর ডক্টর মৃণাল ওকে অপহরণ করেছি। আর ডক্টর মৃণাল এর বাড়িতে বেঁধে রেখেছি। প্রথমে দিপেশকে মারতে চাইলেও যখন জানতে পারলাম।
—কি! কি জানতে পারলে অরু?
—জানতে পারলাম উষা দিপেশ এর বোন। নিজের বোন'কে খুন করেই সে পাগল হয়েছিল।
—কি সব যা-তা বলছো অরু? একটা খুনির কথা তুমি বিশ্বাস করেছ?
—না, করিনি বিশ্বাস। এই কথা জানার পর তোমার মতো আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যখন তোমার বাবার মৃত্যুর খবর শুনলাম তখন আমার মনে হলো। দিপেশের বলা কথা কোথাও না কোথাও কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও সত্য। তোমার মা সব জানে আমার তাই মনে হয়।
—রণক ধপাস করে সোফায় বসে পরে। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না। উষা কি করে দিপেশের বোন হতে পারে! দিপেশের মা ছিল রক্ষিতা। আর তার একমাত্র সন্তান হলো দিপেশ। চয়ন কাকা দিপেশের বাবা তার স্ত্রী রমা কাকির দুশ্চরিত্রার কারণেই ত্যাগ করেছিল। ছোট বেলা থেকে এটাই এতদিন শুনে এসেছে।
—রণকের পাশে বসে অরুনিকা হাত রাখল রণকের কাঁধে। কান্নায় ভেঙে পড়ে রণক জড়িয়ে ধরে অরু'কে। রণকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অরু আরও বলল, যা হয় তা ভগবানের ইচ্ছে তেই হয়। এখানে আমাদের কোন হাত নেই। তুমি কষ্ট পাও না।
অনেকক্ষণ পর রণক কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, মৃণাল এর ব্যাপারে তো কিছু বললে না?
—অরুনিকার হো হো করে হেসে উঠে। তার এই অট্টহাসি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রণক কিছুটা লজ্জিত হয়। তারপরও আবার বলে ওঠে। এতো হাসির কি আছি? আমার প্রেমিকা অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে থাকলে আমার তো ঈর্ষা হবারই কথা।
—রণকের গলা জড়িয়ে ধরে অরু বলল, ওরে আমার প্রেমিক তুমি কয়েকজন'কে নিয়ে ঈর্ষা করবে শুনি? আমার তো প্রতিরাতেই নতুন নতুন পুরুষ আসে জীবনে।
—রণক রেগে গিয়ে গলা থেকে অরুনিকার হাত ছাড়িয়ে বলল, তোমার এইসব কথা আমার মোটেই ভালো লাগে না। কথা না ঘুরিয়ে মৃণাল এর ব্যাপারটাই শুধু বলো।
—ঠিক আছে আমার ঈর্ষা প্রেমিক আর বলবো না। এই কান ধরলাম। মৃণাল উনার বোন'কে খুঁজে বেড় করতে চায়। আমি ছাড়া এই কাজ আর কেউ করতে পারবে না। সেই জন্য আমার সাথে উনি সব সময় থাকে। আর যতটুকু পারে আমার কাজ করে দেয়।
—ডক্টর মৃণাল এর বোনকে তুমি কি করে খুঁজে বেড় করবে? কি হয়ছে উনার বোনের?
—আজ থেকে কয়েক বছর আগে। যখন আমি রূপাগাছিতে নতুন। তখন ওখানে আরও একটি মেয়ে আসে নাম তার মৃধা। মৃধাকে অপহরণ করে পাচারচক্র ডক্টর মৃণাল এর কথাতেই। যদিও ডক্টর মৃণাল তখন জানত না। উনি যাদেকে মৃধাকে অপহরণ করতে বলেছে তারা আসলে পাচারকারী।
—কি বলছো তুমি অরু? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ডক্টর মৃণাল কেনই বা তার বোনকে অপহরণ করতে চাইবে? এর পেছনের ঘটনা কি? আমাকে খুলে বলো সব।


To be continued.....


গল্প: নিষিদ্ধ নারী (প্রেম কাহিনী)

পার্ট:-১১
লেখনীতে: সামিনা সামি

Post a Comment

0 Comments