Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ১

 -'আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন? '

ছেলেটির কথায় থেমে গেলাম। এই মাঝরাতে গহীন জঙ্গলে পথচলতে এমন উদ্ভট প্রশ্ন কিভাবে করতে পারলো ছেলেটা? উনি কি আমায় ভয় দেখাতে চাইছেন নাকি? আমি উত্তর দিলাম -
-' না। আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ভূত বলতে কিছু হয় না। '
আমি লক্ষ্য করলাম ছেলেটার মুখচোখ হঠাৎ পরিবর্তন হতে শুরু করলো। কেমন কাঠিন্য ভাব।
ছেলেটি পকেটে হাত রেখে বললেন -
-' আমিও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তবে পৃথিবীর সব কিছু বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আপনার নাম'টা কি? '


উনার এমন প্রশ্নে ভরকে গেলাম। আসলেই তো! আমি উনাকে চিনি না। কখনো দেখেছি বলে মনেও হয় না। অথচ এই মধ্যরাতে পথ চলছি। ঠিক কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না। বললাম -
- আমি স্নেহা চ্যাটার্জি। কলকাতায় থাকি, তবে বাংলাদেশে আমার দাদিমা'র বাড়ি আছে। এখন হয়তো কেউ বেঁচে নেই তবে সেখানে যেতে মন চায়। রক্তের টান বলে কথা। ছেলেটা বললো-
-আমার পরিচয় জানতে চান না?
- উঁহু। আপনা'কে আমার পছন্দ হয়নি। আর যা'কে আমার পছন্দ হয় না, তার সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে আগ্রহী নই আমি।
কথাটা শুনে ছেলেটি হাসতে লাগলো। এমন হাসি কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না ৷ হাসিটা'কি সুন্দর? না কুৎসিত বোঝা গেলো না। উনি বললেন-
-আপনি কিন্তু আমাকে খুঁজতেই বাংলাদেশে যাচ্ছেন। আমার পরিচয়টা আপনি জানতে পারলে সুবিধা হতো। যাই হোক, সামনে একটা কুয়ো দেখতে পারছেন?
- হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি?
ছেলেটি আবার হাসলো। সাথে সাথে চকচক করে উঠলো দুপাটি দাঁত। চাঁদের শুভ্র আলো চারদিক দিনের মতো আলোকিত করে দিচ্ছে। এমন সুন্দর পরিবেশে ভালোলাগছে। তবে মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোনো অজানা পানে। একবার চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মনে হলো এই বিশ্বজগতে একটিমাত্র মানুষ বেঁচে আছে। সেটা হচ্ছে আমি। আচ্ছা আমার বয়স কত হবে? মনে হচ্ছে আমার বয়স ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আশ্চর্য! নিজের বয়সটাও ভূলে যাচ্ছি নাকি?
চোখখুলে ছেলেটির দিকে তাকালাম। এখনো হাসছে ছেলেটি। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ক্লিনশেভ করেনি বোধহয়। হয়তো উনার কোনো আজন্ম প্রেমিক বলেছিলো ' খবরদার দাঁড়ি কাটবেন না আপনি। দাঁড়ি কাটলে আপনা'কে চোর চোর লাগে। আমি কোনো চোরের সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নই। ছেলেটির পরনে নীল পান্জাবী আর সাদা পাজামা। ঠোঁটদুটো রক্তজবার মতো লাল। হাসির ঝলকে ঠোঁটদুটো কাপছে ভয়ংকরভাবে। নাহ! আর তাকানো যাচ্ছেনা। চোখদুটো ঝলসে যাচ্ছে। পুরুষমানুষের এমন সৌন্দর্য থাকা অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তার মৃত্যুদন্ড হওয়া দরকার। মৃত্যুদন্ড!
-তোর কি শরীর খারাপ লাগছে স্নেহা? এ'কি এত ঘামছিস কেনো?
শ্রেয়ার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। বামচোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরছে জল। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। কোথাও সেই ছেলেটিকে দেখা গেলো না। সেই নির্জন জঙ্গেলটাও নেই। মানে এতক্ষণ কি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম? উফফ! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম একদম। বাইরে ফজরের আজান হচ্ছে। মোয়াজ্জিন তাঁর সুরেলা কন্ঠে আল্লাহর ঘরে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পাশের সিটে ঘুমিয়ে আছে স্বপ্ন। আর একটু আগে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো শ্রেয়া। দুজনেই আমার ফ্রেন্ড। শ্রেয়ার বাসা আমার সাথে ইন্ডিয়ায় আর স্বপ্ন বাংলাদেশের ঢাকায় থাকে। ওর পুরো নাম মোঃ স্বপ্ন আহমেদ। আমরা ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট। ভারতে থাকা স্বত্বেও হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরাশোনা করারও যথেষ্ট কারণ আছে। আমার দাদির বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন আমাকে যেনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরাশোনা করানো হয়। তার কথা রাখতেই আমার বাংলাদেশে থাকা। আর আমার একমাত্র বেষ্টফ্রেন্ড শ্রেয়াকেও আমার সাথে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশে পরাশোনা করার জন্য। আর এই ভার্সিটিতেই আরেকটা বেষ্টফ্রেন্ড জুটে। সেই স্বপ্ন এখন মরার মতো ঘুমাচ্ছে পাশের সিটে। আমরা এখন কোথায় আছি ঠিক ধরতে পারছি না। ড্রাইভার আঙ্কেল তাঁর আপন মনে মাইক্রোজিপটা ছুটে চালাচ্ছেন। শ্রেয়ার দিকে একবার তাকালাম। সে উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। আমি সিটে হেলান দিয়ে বললাম -
- এই ভোরবেলা জেগে আছিস যে? বোতলে জল থাকলে একটু দে'তো।
শ্রেয়া কোনো কথা বললো না। সে তাঁর ব্যাগের চেইন খুলে এক বোতল জল আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি বোতলটা হাতে নিয়েই জল খেতে খেতে বললাম-
- একটা প্রশ্ন করেছি তোকে। উত্তর দিবি না?
- আমার একটু ভয়ভয় করছে দোস্ত। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কি আমাদের থাকতে দিবে? তুই শুধু শুধু একটা ডায়েরির আশায় ময়মনসিংহে যাচ্ছিস। এই দেশের সম্পর্কে তেমন কিছু জানিস?
- জানি না। তবে জানার চেষ্টা করবো। আর যদি একান্তই না থাকতে দেয়। তাহলে কোনো হোটেল-মোটেল ভাড়া করে নিবো নাহয়। স্বপ্ন তো আমাদের সাথে আছেই। এত ভয় কিসের তোর?
কথাটা বলে শ্রেয়ার দিকে লক্ষ্য করলাম। মনে হলো ভয় কমেনি একটুও। বরং আরো বাড়ছে।
আমি আর কোনো কথা না বলে ড্রাইভার আঙ্কেলকে বললাম -
-ওখানে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে আঙ্কেল?
ড্রাইভার একবার পেছনে ঘুরে আমাদের সবার দিকে তাকালেন। বললেন -
- আর বেশিদূর না। দুএক কি.মি হইবে। রাস্তা তো একদম ফাক্কা, খুব তরাতারি পৌঁছে যাবো মনে অয়। আন্নেরা ব্যাগপত্র গুছায় নেন।
ড্রাইভারের কথা শুনে জানালার বাইরে একবার তাকালাম। এখনো ভোরের আলো ফুটেনি। আজান শেষ হয়েছে মাত্র। জানালার কাচটা বন্ধ করে দিয়ে স্বপ্নকে ডাকতে লাগলাম। কয়েকবার ডাকার পর ঘুম ভাঙ্গলো।
গাড়ি থেকে নেমে যার যার ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম সবাই। ড্রাইভারের ভাড়া বুঝিয়ে দিলে তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছেন একটু আগে। স্বপ্ন এখনো ঘুমে ঢুলছে। পূর্বাকাশে লক্ষ্য করে দেখলাম সূর্যের আগমণের উৎস স্বরুপ লাল আভা ছড়িয়ে রেখেছে। আর একটু পরেই ঘুম ভাঙ্গবে রাজপুত্রের। সামনে একটা মসজিদ লক্ষ্য করলাম। নামাজ শুরু হয়েছে মাত্র। স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে বললাম -
- নামাজ পড়ে আয় স্বপ্ন। তোর ব্যাগগুলো আমার হাতে দে।
নামাজের কথা শুনে স্বপ্ন বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নামাজের কথা শুনলেই তার অযুহাতের মেশিন বেড়িয়ে আসে সবসময়। এখন নিশ্চই বলবে ' আমার শরীরটা ভালোলাগছে না দোস্ত। দুপুরের যোহরের নামাজ থেকে শুরু করবো। ' বলেই ভ্যাবলামার্কা একটা হাসি দিবে। যা ভাবা সেই কাজ। স্বপ্ন সেটাই করলো যেটা স্নেহা ভেবেছিলো। স্নেহা বললো-
- জুতার বারি না খেতে চাইলে আমার কথা মতো কাজ কর।
অতঃপর স্বপ্ন নামাজ আদায় করে মেইনরোড দিয়ে হাটতে লাগলো। শ্রেয়াও চুপচাপ হাটছে। বোধহয় এখনো ভয় পাচ্ছে। এই মেয়েটা বাংলাদেশকে এত ভয় পায় কিভাবে আমি জানি না। স্বপ্ন বললো-
- কইরে তোর দাদির বাপের বাড়ি?
- জানি না। আমি তো কখনো আসি নি এখানে। শুধু দাদির মুখে শুনেছি। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে বোধহয়।
আমার কথা শুনে স্বপ্ন কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। রাগে হিরহির করছে ওর শরীর। বললো-
- এই সকাল সকাল এখন মানুষকে জিজ্ঞাসা করবো কোথায় তোর দাদির বাড়ি?
-হু
আরো একবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো স্বপ্ন। কোনো কথা না বলে সামনে এগোতে থাকলো। একটু পরেই একটা চায়ের স্টল সামনে পেলো স্নেহারা। সেখানে গিয়ে স্নিগ্ধ সকালের এককাপ গরম গরম চা খেলো সবাই। দোকানি বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সকাল সকাল এমন অপরিচিত মুখ হয়তো তিনি আগে কখনো দেখেনি। তিনি শুষ্কমুখে একবার জিজ্ঞেসা করলো -
- আপ্নেরা কোনহান থাকি আইছেন?
স্বপ্ন, শ্রেয়া, স্নেহা সবাই সবার দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হলো দোকানিকে একটু ভরকে দেয়া যাক। আমি পায়ের উপর পা তুলিয়ে বললাম -
- আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি একটা জরুরী কাজে৷ আপনি কি বলতে পারবেন মহসিন সরকারের বাড়ি কোনটা?
দোকানি ইন্ডিয়ার কথা শুনে সত্যি সত্যি ভরকে গেলো। তিনি একটু ভয় পেয়েছেন বোধ হয়। উনি বললেন -
- মহসিন সরকারকে দিয়ে আপনাদের কি কাম?
- উনাকেই দিয়ে সব কাম।
বৃদ্ধ দোকানি চুপসে গেলেন। বললেন -
- সামনের গলি দিয়ে যাবেন। বাঁ দিকে দেখবেন একখান ভাঙ্গাচুরা পুরাতন বাড়ি আছে। ওখানেই মহসিন সরকার থাহেন।
স্নেহা দোকানির টাকা পরিশোধ করে দিয়ে রাস্তা ধরলেন। সকালের সূর্য ইতিমধ্যেই পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস সবার মনটা'কে ফুরফুরে করে দিচ্ছে। আশেপাশে কিছু মানুষকেও লক্ষ্য করা গেলো। হয়তো তারা নিজ নিজ কাজের উদ্দেশ্যে সকালের ঘুম হারাম করে ঘর ছাড়ছেন। হঠাৎ সামনে দিকে একটা ছেলেকে জগিং করতে দেখা গেলো। ছেলেটাকে থামালো স্নেহা।
- এক্সকিউজ মি ভাইয়া। একটু শুনেন তো।
ছেলেটি দাঁড়ালো। মুখে হাসি নিয়ে নেই। বরং এক আকাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে। এখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো তাকে কি জন্য দাঁড় করানো হয়েছে সেটা জানা আর যথাসাধ্য হেল্প করা। আর তারপর জগিংয়ের উদ্দেশ্যে পুনরায় দৌড়ানো। ছেলেটি স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো-
- কিছু বলবেন?
এখন ছেলেটার পুরো শরীর দেখা গেলো। একটা রেড কালারের টিশার্ট আর একটা অ্যাশ থ্রি - কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে ছেলেটি। স্নেহার মনে হলো এই সেই স্বপ্নের ছেলেটা। যে ঘন্টাখানেক আগে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলো সে। এখন শুধু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে মাথার চুলে। এই ছেলেটার মাথায় সিল্কি চুল ঘামে চুপচুপ করছে। কিন্তু স্বপ্নে আসা ছেলেটার মাথায় কোকড়া চুল ছিলো। স্নেহার এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি আবার বললো-
- এইযে ম্যাম। কিছু বললে বলুন নাহলে আমি চলে যাচ্ছি।
স্নেহা সম্ভিত ফিরে পেয়ে বললো-
- আপনি কি মহসিন সরকারকে চিনেন?
ছেলেটি বাঁকা চোখে একবার আমার দিকে তাকালো। অতঃপর বললো-
- হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
- আমাদের একটু উনার বাসায় পৌঁছে দিন। যেতে যেতে পরিচয় দিচ্ছি।



চলবে..............

গল্প: বিদেশিনী
#পর্বঃ০১
লেখনীতে: রিফাত আমিন

Post a Comment

0 Comments