Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ৩

অপরাজিতা এখনো কঠিন চোখে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও ইতিমধ্যেই ইউসুফের মিষ্টি হাসিতে খুন হয়ে গিয়েছে সে। সে শুভ্র ওড়না মাথা থেকে নামিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখলো, অতঃপর টেবিল থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটা মোটা বই হাতে নিলো। ইউসুফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপরাজিতার দিকে তাকালো। আজ ক্ষণিকের জন্য বাকশক্তি ফিরে পেলে ইউসুফ শুধু একটা কথাই বলতো -- তুমি অনেক সুন্দর অপরাজিতা। ঠিক অপরাজিতা ফুলের থেকেও মিষ্টি। তোমার ঐ দুটো আঁখির দিকে তাকালে আমি হারিয়ে যাই দূর অজানায়। টানা টানা চোখদুটো আমায় সম্মহিত করে। তুমি কি সেটা কখনো জানতে পারবে?

হঠাৎ চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা উধাও হলে ভাবনায় ছেদ ঘটে ইউসুফের। ইউসুফ চোখ তুলে তাকালো অপরাজিতার দিকে। সাথে সাথে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো অপরাজিতা। অপরাজিতা নিজের চোখে চশমাটা লাগিয়ে বিজ্ঞের স্বরে বললো-


- এইযে মিষ্টার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সারাদিন বইপুস্তক নিয়ে থাকিলে কি হইবে? আপনার ছোটভাই ঢাকা থাকিয়া আগমণ করিয়াছেন। দেখা করিবেন না?
ইয়াসিনের আসার সংবাদ পেয়ে হাসি বিস্তৃত হলো ইউসুফের। সে হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো - ' তাই নাকি?'
এই ভাষা পরিবারের সবাই বুঝে। তবে ইউসুফের সাথে সবসময় একটা নোটবুক থাকে
। যদি কখনো কেউ কিছু না বুঝে তখন সেটা লিখে বুঝাতে হয়। কিন্তু ইউসুফের মনে দূঃখ নেই। তার একটা আলাদা পৃথিবী আছে। যে পৃথিবীর একমাত্র মালকিন অপরাজিতা। যাকে ছারা সেই পৃথিবীর সূর্য উদোয় হবে না, সুর্যাস্ত হবে না। সেখানে অপরাজিতা ছারা ইউসুফের জীবন মুল্যহীন।
অপরাজিতা নিজের ওড়নাটা খুলে ইউসুফের মাথায় দিয়ে দিলো। প্রচন্ড রোদে এখানে থাকাই যাচ্ছে না। অথচ কিভাবে যে রোদে বসে পরাশোনা করছে ভেবে পায় না অপরাজিতা। সে হেসে হেসে বললো-
- আজ আমাকে সাইকেলে করে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে? অনেকদিন হয় আমায় সাইকেলে উঠাও না। নিয়ে যাবে না?
ইউসুফ হালকা হেসে ইশারায় বুঝালো সে রাজি। অতঃপর অপরাজিতা চুলের বেণী দুলিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে নিলে, সাথে সাথেই অপরাজিতার হাত ধরে ফেললো ইউসুফ। নিজের মাথা থেকে ওড়নাটা নামিয়ে অপরাজিতার গায়ে পড়িয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় নিচে নেমে যেতে বললো ।
---
বর্তমান,
রাত আটটা কি নয়টা। ২০১২ সালের আগষ্ট মাস এখন। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্নেহা। একটু আগেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় গরমটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এখানে বেশীক্ষণ ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না। দুইটা রুমের একটাতে স্বপ্ন আর একটাতে আমার আর শ্রেয়ার থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এখানে থাকতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু রাত হয়ে যাবার পর কেমন ভূতুরে লাগছে এই বাড়িটি। জানালা খুললেই সামনে পরবে সেই প্রাচীন বাড়ি। আজ সারাদিনে শুধু শুয়ে বসে কাটিয়েছি। সারারাত জার্নি করার ফলে শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন ভালোলাগছে। ভালোলাগাটাও গরমে পালিয়ে যাবার জোগার। একবার ছাদে গেলে কেমন হয়? কিন্তু এখন কি ছাদে যাওয়া উচিত হবে? অচেনা, অজানা জায়গায় এমন সাহস দেখানো ভূল। কিন্তু আমার ভয় করে না। ভয় পেলে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে একা একা এভাবে ঘুরে বেড়ানো হতো না হতো না ।
ছাদে উঠলাম একা একা৷ একটু ভয় ভয়ও করছে। তাই সাথে একটা টর্চ লাইটও নিয়েছি। ছাদে উঠে অন্ধকারে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। যখন টর্চ ফেললাম তখন বুঝলাম সেই সুদর্শন পুরুষটি, যে এখানে নিয়ে এসেছিলো৷ ভালোই হলো দেখা হয়ে। আপাতত এখন কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি একবার আমার দিকে তাকালেন। আবার পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আকাশে আজ চাঁদ উঠেনি। অথচ তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। বৃষ্টি নামবে বলেই হয়তো ভ্যাপসা গরম পড়ছে। বললাম-
- কেমন আছেন আপনি?
তিনি আমার দিকে তাকালেন না। গম্ভীর দৃষ্টিতে এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। চারপাশে প্রগাঢ় অন্ধকার। দূরে কোথাও নিশাচর ডাকছে ব্যতিব্যস্ত হয়ে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়েই বললেন-
- আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি এখন ছাদে উঠে আসলেন যে। অচেনা জায়গায় ভয় করবে না?
- না! আমার তেমন ভয় করে না। আপনার বাড়িতে থাকতে এলাম। খারাপ লাগছে না?
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসিটাও স্বপ্নের সেই পুরুষের মতো। আমি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলাম। অন্ধকারে তাঁর মুখটা পুরোপুরি
স্পষ্ট না। তিনি হেসে হেসে বললেন -
- দাদুর মুখে শুনলাম এটা আপনার দাদির বাড়ি। সেই হিসেবে এখানে থাকার অধিকার আপনি রাখেন।
- বাই দ্য ওয়ে আমার নাম স্নেহা চ্যাটার্জি।
-আমি মুগ্ধ
- মানে?
হঠাৎ এমন কথায় ভরকে গেলাম। কিসের মুগ্ধতার কথা বলছেন তিনি? উনি হাসি থামিয়ে বললেন -
-আমার নাম মুগ্ধ। বুঝলেন?
- ওহহ বুঝলাম। আমি আবার ভাবলাম কি দেখে এই অন্ধকারে আপনি মুগ্ধ হলেন। আপনার নামটা কিন্তু অনেক মিষ্টি। তিনি আর উত্তর দিলো না। আমি আবারো বললাম -
- এখানে যেহেতু কয়েকদিন থাকবো তাই এখানে কে কে থাকেন বা আপনার পরিবারে কারা কারা থাকেন। এই সম্পর্কে একটু জানালে ভালো হতো।
- তেমন কেউ থাকেনা। আমার দাদিমা মারা গিয়েছে কয়েক বছর হয়। আর দাদুকে তো দেখলেন'ই। তারপর আমার বাবারা দুইভাই। তাদের মধ্যে আমরা এখানেই থাকি আর এক ভাই ঢাকাতে থাকেন। ওনার গ্রাম তেমন ভালোলাগে না। তবে আমাদের সাথে সম্পর্ক অনেক ভালো। মাঝে মাঝে দেখা করে যান। উনার একটা মেয়ে আছে। যে ঢাকা ভার্সিটি পরে। এবার আমার বাবার সম্পর্কে আসা যাক। আমার একটা বোন আছে। নাম হলো মোহনা। সে এখানেই থাকে। তার বিয়ে হয়ে গেছে। একটা বাচ্চাও আছে। তবে ডিভোর্সের প্লান চলছে। আর আমি ঢাকা ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছি কয়েকদিন হলো। এখনো জয়েন করি নি। তবে যাবো কয়েকদিন পর। আর আমাদের বাসায় দুজন কাজের লোক আছে। উনার সম্পর্কে আস্তে আস্তে জেনে নিবেন। আশা করি সব তথ্য জানা হয়ে গেছে।
- ওয়াও। আমরাও ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি। তাহলে আপনিই সেই আবরার মুগ্ধ? যাকে দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
বলেই জিভ কাটলাম। হায় হায় কি বলতে কি বলে ফেললাম। তবে উনি কি আমার উপস্থিতিতে বিরক্ত হলেন। নাহলে এভাবে হরহর করে সব বলে দিলেন যে। কথাটা এড়িয়ে যেতে বললাম -
- আপনি কি আমার উপর বিরক্ত? এভাবে হরহর করে সব বলে দিলেন যে। কেউতো এমন করে বলে না। যাই হোক, আপনাকে আমি স্যার বলে ডাকি তাহলে? যেহেতু সামনেই আমাদের ক্লাস নিবেন।
- নাহ। স্যার কাকে বলে জানেন? যে আপনাকে কিছু না কিছু একদিন হলেও শিখিয়েছে সেই আপনার শিক্ষক। আমি তো আপনাকে কিছুই শিখাই নি। যেদিন শিখাবো সেদিন থেকে নাহয় বলেন।
আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। এ্যাঁ! মনে হয় দার্শনিক হু!। আমি ওনার আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম -
- তাহলে কি বলে ডাকবো?
- আমাকে বোধহয় আর আপনার প্রয়োজন পড়বে না। যেটুকু প্রয়োজন ছিলো তা বলে দিয়েছি। আর কিছু জানার আছে?
আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম। এটা কেমন মানুষ? শুধু অস্ফুটে স্বরে বললাম -
- উঁহু।
ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ এসে গেছে। চারপাশ সোডিয়াম আলোয় হালকা আলোকিত। ছাঁদেও একটা লাইট জ্বালানো আছে। আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। সুদর্শন পুরুষ। স্বপ্নের সেই পুরুষের মতোই ধবধবে ফর্সা শরীর। এখনো বন্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কি খুঁজছেন বুঝতে পারলাম না। মনে হয় এই নিস্তব্ধ অন্ধকার গগণে কোনো সুন্দরী রমণী বসে আছেন। যাকে একমাত্র চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করা সম্ভব। আমিও কি চোখ বন্ধ করে তাঁর খোঁজ করবো? থাক।
আশেপাশে হালকা আলোকিত হওয়ায় ছাদের চারপাশটা একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম নিচে কে যেনো বিড়ি ফুঁকছে। সেটার তীব্র গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে আঘাত করলো। আমি হালকা কেশে বললাম-
- কে ওখানে সিগারেট খাচ্ছে।
কথাটা শোনা মাত্রই মানুষটা উপরের দিকে একবার তাকালো। অতঃপর দিক বেদিক চিন্তা না করে কোথায় যেনো ছুটে পালালো। আমি ভেবেই পেলাম না কেনো মানুষটা পালিয়ে গেলো। ছাদের ওপাশে একবার তাকালাম। ছাদ একদম ফাঁকা। কোথায় গেলো তাহলে মানুষটা? বাড়িটা কেমন জানি ভূতুড়ে। হঠাৎ পুরোনো সেই বটগাছ থেকে স্বশব্দে দুটো বাদুর উড়ে গেলো। সেই শব্দে আমি চমকে উঠলাম। মস্তিষ্ক স্থির হচ্ছে। আশ্চর্য ভাবে আমার সেই স্বপ্নের মতোই নিজেকে এখন প্রচন্ড একা লাগছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। অসহ্য এক ভালোলাগার যন্ত্রণা।


চলবে.................


গল্প: বিদেশিনী

#পর্ব_৩

লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments