Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ২

ছেলেটিকে আমার স্বপ্নে দেখা সেই সুদর্শন পুরুষ মনে হলো। স্বপ্ন ক্ষণস্থায়ী, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর অধিকাংশই মনে থাকে না। ছেলেটির নাম এখনো জানা হয় নি। এতো গম্ভীর হয়ে থাকেন কিভাবে জানি না। তিনি যে বাড়িতে নিয়ে আসলেন সেটা একটা প্রাচীন ভাঙ্গা বাড়ি বলা চলে। প্রাচীন একতলা বাড়ি, তবে সেই বাড়ির অবস্থা এখন নাজেহাল। ইটগুলার সাথে লাগানো সিমেন্ট খুলে খুলে পড়ছে। হয়তো আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাবে এখানে লুকিয়ে থাকা সেই স্মৃতিগুলো। কিন্তু আমাকে যেভাবেই হোক আজ থেকে ষাট বছর আগের সব ঘটনা জানতেই হবে। সেটা কি আদৌও সম্ভব? মেইনরোড থেকে উত্তরপাশে ছোট একটা গলি রাস্তা দিয়ে ভীতরে ঢুকলে বাঁ পাশেই বাড়িটার অবস্থান। বাড়িটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রশস্ত। তাঁর আশেপাশে বড় বড় দুটো বট গাছ ভৌতিকরূপে বাড়িটিকে পাহারা দিচ্ছে। একটা কৃঞ্চচুড়ার প্রকান্ড গাছ আঙ্গিনার মাঝে দাপদে দাঁড়িয়ে আছে। পুরাতন বাড়িটার সামনে নতুন দোতলা বাড়ি। যার অর্থ মহসিন সরকার এই পুরাতন বাড়িটায় থাকেন না। সামনের নতুন বিল্ডিংয়ে থাকেন। আমি, শ্রেয়া আর স্বপ্ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বাড়িটা দেখছি। ছেলেটি এখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। উনার সিল্কি চুলগুলো ঘেমে কপালের সাথে লেপ্টে রয়েছে। হঠাৎ তিনি নিম্নসুরে দাদু, দাদু বলে কয়েকবার চিৎকার করলেন। অতঃপর আমাদের ইশারা করে ভীতরে যেতে বললেন । যার অর্থ ছেলেটি এই বাড়ির সন্তান। আস্তে আস্তে পুরোটা বোঝা গেলো। তিনি যে এই বাড়ির ছেলে সেটা আগে বললেই তো হতো। কেমন গম্ভীর চাহনি নিয়ে চলাফেরা করে। নিচতলার ডান পাশের রুমটায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। রুমের ভীতর প্রবেশ করে দেখলাম কতটা সৌখিনতার সাথে মানুষ থাকে এখানে। ছোট রুমটা বেশ গোছালো। আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট। বিছানার মাঝখানে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে শায়ে আছে এক বৃদ্ধ। বয়স সত্তর পার হয়ে আশির কাছাকাছি বোধহয়। ছেলেটা চুপচাপ শুধু একটা কথাই বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।


- দাদু তোমার সাথে কারা যেনো দেখা করতে এসেছে।
আমাদের বসতে দেয়া হলো সোফায়। আমরা তিনজন সবাই সবার দিকে চাওয়াচাওয়ি করছি। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলাম। সকাল ৭ টা ১৩ বাজে। এত সকাল সকাল এখানে আসা বোধহয় ঠিক হয়নি। ঘুমে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। বৃদ্ধা অস্পষ্ট দৃষ্টিতে একবার আমাদের দিকে তাকালেন। বললেন -
- তোমরা কারা মা? এত সকাল সকাল দেখা করতে এসেছো যে। তুমি করেই বললাম কিন্তু।
কিছু মনে করিও না।
উনার কথা শুনে একটু শান্তি পাওয়া গেলো। এতক্ষণ কেমন একটা অস্বস্তি ভর করে ছিলো আমাদের মাঝে। কথা শুনে যা বুঝলাম উনি যথেষ্ট শিক্ষিত। আমি বললাম -
- অপরাজিতা'কে চিনেন? আমি উনার নাতনি হই। কলকাতা থেকে এসেছি। দাদিমা আমাকে এখানে আসতে বলেছিলো।
কথাটা বলেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। উনি কি চিনবেন দাদিমা'কে। এই বয়সে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। যদি ভূলে যান তাহলে তো সব চেষ্টাই বৃথা। আমার কথা শুনে উনি চমকে উঠলেন। হয়তো বিছানা থেকে উঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন কিন্তু শরীরের কাছে হেরে গেলেন। শোয়া অবস্থায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখদুটো জলে টুইটুম্বুর। বোধহয় তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না কথাটা। বললেন-
-কেমন আছেন তোমার দাদিমা?
আমি বললাম -
- তিনি বছর দুয়েক হয় মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর আগে আমার জন্য একটা চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে এই বাড়ির কথা বলেছিলেন তিনি। জীবনে একবারের জন্য হলেও যেনো বাড়িটা দেখে যাই। চিঠিটা আমার বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলেন এটা যেনো আমাকে দুই বছর পর দেয়া হয়। দুইবছর পর কেনো দিতে বলেছিলেন আমি জানি না। কথাটা বলেই একটু চুপ থাকলাম। উনার দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল পড়ছে। আবার বললাম -
আমি এখানে এসেছি আমার দাদিমা'র বাড়িতে। কিন্তু এখানে আমার কোনো আত্মীয় নেই। শুধু বাড়িটা যা পরে রয়েছে। এখানে কয়েকদিনের জন্য এসেছি। থাকতে দিবেন?
অকপটে আবেদন করে ফেললাম। শ্রেয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্বপ্ন আপন মনে রুমের চারপাশটায় চোখ বুলাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথা শুনছে। সাথে সাথে রুমে প্রবেশ করলো এক মধ্যবয়স্ক মহিলা। হয়তো সেই ছেলেটার মা হবে। মহিলাকে দেখে উনি বলে উঠলেন-
- ওদের জন্য সকালের নাস্তা রেডি করো মা। আর উপরের রুমগুলো পরিষ্কার করে থাকার ব্যাবস্থা করে দাও।
______
১৯৪৮ সাল,
-ভাইয়া ভাইয়া! ও ভাইয়া।
চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভীতর পা রাখলো ইয়াসিন। অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ। সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। ঢাকা থেকে ফিরেই সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার বড় ভাই ইউসুফ কে ডাকছে। যদিও সে জানে তার বড় ভাই জবাব দিবে না। তবুও বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে ফেরার সময় এভাবেই চিৎকার করে তার ভাইকে ডাকে। বাড়িতে প্রবেশ করেই দেখলো আঙ্গিনায় মহসিন চুপচাপ অপরাজিতার সাথে লুডু খেলছে। মহসিনের বয়স আট বছর। তবে এই বয়সেই সে দুষ্টুমি করার লিডার হয়ে গেছে। এক মহুর্ত স্থির থাকতে পারে না সে। ভয় পায় একমাত্র ইউসুফকে, আর এই দুনিয়ায় ভয় পাওয়ার মতো মানুষ হয়তো তার নাই। ইয়াসিনকে দেখেই লুডু খেলা রেখে দৌড়ে আসলো তার কাছে। তার সামনে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো-
- আমার জন্য কি আনছো ভাইয়া?
ইয়াসিন বিরক্তমুখে মহসিনের দিকে তাকালো। বাইরে থেকে আসলেই কিছু একটা আনতেই হবে যেনো। ইয়াসিন অপরাজিতার দিকে একবার তাকালো। অতঃপর বললো-
- ভাইয়া কই দিদি? আর এই হতচ্ছরাটাকে লাই দিয়ে দিয়ে তুমি মাথায় তুলছো। একে সোজা করতে ভাইয়াই যথেষ্ট। তুমি একটু দেখোতো ভাইয়া কোথায়।
অপরাজিতা স্বলজ্জিত দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর লুডু খেলা রেখে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো ইউসুফকে খোঁজার জন্য। অপরাজিতার বয়স আঠারো পেরোলো সবে। কিশোরী মন রেখে যৌবনে পা দিয়েছে। অত্যন্ত ফর্সা ত্বক, এই সামান্য রোদেই লাল হয়ে গেছে। সে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে ছাদে উঠলো। বন্ধু বলতে একটাই, সে হচ্ছে ইউসুফ। পুরো নাম স্বাদ আবদুল্লাহ ইউসুফ। ছাদে উঠে দেখলো ইউসুফ কাঠের একটা চেয়ারে বসে বই পড়ছে এই কড়া রৌদ্রে। অপরাজিতা রোদ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে মাথায় ওড়ানা ধরলো। এই রোদে বসে কিভাবে বই পড়ছে মানুষটা কে জানে। অপরাজিতা কপট রেগে সামনের টেবিলের একটা বই নিয়ে ঠাস করে সেখানেই রেখে দিলো। হঠাৎ শব্দে চমকে উঠলো ইউসুফ। হাতের বইটা রেখে সামনে দৃষ্টি রাখলো। অপরাজিতা দাঁড়িয়ে আছে মুখ গোমড়া করে। এটা তাঁর সচারাচর স্বভাব। অপরাজিতার গোমড়া মুখ দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিলো ইউসুফ। সে জানে, একটা হাসিই অপরাজিতার রাগ ভাঙ্গাতে যথেষ্ট। অপরাজিতা সত্যি সত্যি হাসি দেখে সম্মহিত হয়ে গেলো। এই মানুষটা কিভাবে এত হাসে? দাঁত গুলো তো চকচকে হিরা মনে হচ্ছে। আশ্চর্য! এভাবে হাসলে তো আমি আমার রাগ ধরে রাখতে পারিনা। অপরাজিতা ইউসুফের পুরো শরীরের দিকে এক দৃষ্টি ছুড়লো। ঝাঁকড়া চুলগুলো তপ্ত রোদে সোনালি রঙে রঙিন দেখাচ্ছে। চোখে মোটা ফ্রেমে সাদা চশমা। বোধহয় এই চশমার কারণেই তাকে এত সুন্দর লাগে। একটা সাদা শার্ট পরেছে আর কালো লুঙ্গি। অপরাজিতা যতটাসম্ভব রাগ আনার চেষ্টা করলো। রেগে বললো-
- এই রোদে বসে বই পড়তে তোমার অসুবিধা হয় না? গন্ডারের চামরা নাকি? ঐতো কৃঞ্চচুড়ার ছায়া এসে পড়েছে। ওর ছায়ায় বই পড়লেই তো হয়। এ্যাঁ! এমন ভাব ধরছে যেনো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছোটভাই। ভাব দেখলে মরে যাই।
ইউসুফ জবাব দিলো না। তাঁর পক্ষে জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতে সে বাক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছে। তবে কণ্ঠের সেই অভাব তার হাতে রেখে দিয়েছে মহান আল্লাহ। একটা মানুষকে সামনে রেখে মহুর্তেই তার প্রতিকৃতি এঁকে দিতে সক্ষম সে। তবে তাঁর সব কথা একমাত্র অপরাজিতা বুঝতে পারে। অনেক সময় চোখ দেখেই বুঝে যায় তাঁর মনের সব কথা।


চলবে.............

গল্প: বিদেশিনী

#পর্বঃ০২
লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments