Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ৭

সেদিন ছিলো আরেক বর্ষার রাত। আকাশ ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন। একটু আগে মুশলধারায় বৃষ্টি হয়েছে। হালকা বাতাস ছুটছে ক্ষণে ক্ষণে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোয় পথ চালিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরছে অপরাজিতা। এক বান্ধবীর বাসায় চলে গিয়ে আটকে পরে ছিলো বৃষ্টির কারণে। সাথে কেউ ছিলো না যে কি না বাসায় পৌঁছে দেবে। রাতটুকু সেখানে থাকতে বললেও সে মানা করে দিয়েছি সামান্য পথ একাই যেতে পারবে বলে। কিন্তু এখন তো ভয় করছে। এমনিতেই ভীষণ অন্ধকার পথ। যতক্ষণে বিদ্যুৎ চমকায়, তবেই বোঝা যায় পথ কোনদিকে। এর আগে কখনো এমন বিপদে পরে নি। অবশ্য দিনের বেলা ছাড়া কখনো বের হয়নি, হলেও সাথে ইউসুফ ছিলো। এখন তো ইউসফ ও জানে না আমি কোথায় চলে আসছি। কি সাংঘাতিক!
এই ঠান্ডার মাঝেও তরতর করে ঘেমে যাচ্ছে সে।


অপরাজিতা শুকনো ঢোক গিললো। ওড়না দিয়ে কপালের ফোঁটা ফোঁটা ঘামগুলো মুছে সামনে তাকাতেই দেখলো হারিকেন নিয়ে কে জেনো হেঁটে আসছে এদিকে। প্রথমদিকে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলেও একটু পর বুঝলো এটা ইউসুফ। ইউসুফকে দেখেই জেনো সে প্রাণ ফিরে পেলো সে। হারিকেনের হলদেটে আলোয় ইউসুফ অপরাজিতার সামনে এসে দাঁড়ালো। অপরাজিতা সেই আলোয় ইউসুফের মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারলো ভীষণ রেগে আছে মহাশয়। আজ কথা বলতে পারলে বোধহয় অনেক অনেক কথা শুনিয়ে দিতো অপরাজিতাকে। ইউসুফ রাগী চোখে অপরাজিতার দিকে চাইলো। চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। অপরাজিতা কোনোভাবে বললো-
- আমায় তারাতারি বাড়িতে নিয়ে চলো। ভয় করছে এখানে।
বলেই হাঁটা ধরলো সে। ইউসুফ চারপাশে একবার দেখে নিলো কেউ আছে কি না! এতরাতে কেউ একসাথে দেখলে একদম ঝামেলা বেঁধে যাবে। এমনিতেই গ্রামের অবস্থা বেশী ভালো না। বৃষ্টি শেষ হয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। চারপাশ থেকে মাটির একধরনের সোঁদা গন্ধ বের হচ্ছে। এই গন্ধটা যে কত মনোরোম তা গ্রামের মানুষজন ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। একটু সামনে এগোতেই হঠাৎ বৃষ্টির কবলে পড়লো তারা। এমন সময় বৃষ্টি আসায় বিপাকে পরে গেলো ইউসুফ, আর মাত্র দুয়েক মিনিটের পথ অথচ শেষ পর্যন্ত ভিজতেই হলো দুজনকে। শেষ রাস্তাটুকু দৌড়ে এলো কোনোভাবে। বাড়ির প্রধান ফটকে এসে দেখলো সেটা বন্ধ। আশ্চর্য! একটু আগেই বাইরে থেকে বন্ধ রেখে গিয়েছিলো ইউসুফ। অথচ এখন উল্টোবিষয় দেখা যাচ্ছে। কি ঝামেলা! ইউসুফ হারিকেন টা অপরাজিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় মহসিনকে ডাকতে বললো। কিন্তু প্রচন্ড গতিতে বৃষ্টি হওয়ায় অপরাজিতার কন্ঠস্বর বাড়ির ভেতরের কেউ শুনতেই পেলো না। ফটকের উপরেও ছাদ আছে, কোনোভাবে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা সম্ভব কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে তো মানুষজন চলাচল করে। একবার দেখে ফেললেই বিচার বসাবে এটা নিয়ে নিশ্চিত ইউসুফ। এখানকার হিন্দুরা মুসলিমকে সহ্য করতে পারে না আর মুসলিমরা হিন্দুকে। কোনোভাবে একটা সুযোগ পেলেই ঝামেলা বাঁধাবে নিশ্চিত। বাড়ির পেছনের ফটক দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব, কিন্তু সেটাও তো বিকেলবেলা তালা মেরে দিয়েছে ইউসুফ। দুঃচিন্তায় কাহিল হচ্ছে দুজনেই। ইউসুফ ক্রোমাগত ফটকে ধাক্কাছে, সে যতজোরে ধাক্কাছে বৃষ্টির শব্দের গতি বোধহয় তার থেকে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সর্বোশেষ যা হবার তাই হলো। পাশ দিয়ে এক স্কুল শিক্ষক দেখে ফেলায় ঝামেলার মুখে পরতে হলো দুজনকেই। সেই শিক্ষক হিন্দু আর তাঁর সাথে দুজন ছাত্রও দেখা যাচ্ছে। অপরাজিতা নমষ্কার জানিয়ে সব বিষয় খুলে বলার পরেও মুক্তি দিলো না। দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় রইলো। মনে হলো আজ উনার নিজ বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই। এই বিচার করতে পারলেই তার শান্তি। পাশের দুই ছাত্র ছাতা মাথায় দারুণ মজা নিচ্ছে। হিন্দু শিক্ষকের অভিযোগ, এত রাতে একটা হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলিম ছেলে বের হবে কেনো? ইউসুফ নির্বাক ভঙ্গিতে সবার কথা শুনছে। অনেক কথাই বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে অথচ বয়সে বড় বলে কিছু করতেও পারছে না। অপরাজিতাও ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। যদিও ইউসুফের সাথে মেলামেশায় বাড়ি থেকে যথেষ্ট পারমিশন আছে কিন্তু বাইরের এমন স্বনামধন্য মানুষেরা বিচারে বসলে তো ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবে বাবা। অপরাজিতা শুকনো ঢোক গিলে বললো-
- স্যার বোঝার চেষ্টা করুন। এসব কি বলছেন?
- তোমার বাপ একটু বেশিই বারাবারি করছে। আমরা গ্রামের মানুষজন বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারি নাই। তোমাকে নিয়ে তো তোমার বাপ গল্প করতে বাঁচে না। হেন তেন। এই তাঁর পরিচয়? ঝড়ের রাতে মুসলিম পোলার সাথে নষ্টামি! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। আজকেই এর বিচার করতে হবে। বৃষ্টিখান থামুক।
বলেই পাশের এক ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললো-
- কি বলিস তুই? ঠিক বলছি না?
- হ্যাঁ স্যার। ভালো হবে।
বলেই ভ্যাবলা মার্কা হাসি দিলো ছেলেটি। এতক্ষণ কাঁদা মাটিতে হেঁটে আসতে যে কষ্টটা হয়েছে তার থেকেও বোধহয় শতগুণ আনন্দ পাচ্ছে স্যারের কথায়। বৃষ্টি থামার জন্য সবাই উদগ্রীব। এদিকে ইউসুফ ঠাই দাঁড়িয়ে কথাগুলো গিলছে। যতটা সম্ভব ধৈর্যধারণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
________
বিকাল ৪ টা। সারাদিনে একবারো মুগ্ধের দেখা পেলাম না। মানুষটা থাকে কোথায় সবসময়? সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মুগ্ধকে পাইনি। তখন হঠাৎ মনে হলো বাড়ির পিছনের পুকুর ঘাটের কথা। যেখানকার কথা মুগ্ধ বলেছিলো গতকাল। আমি শ্রেয়াকে সাথে নিয়ে বাড়ির পিছনটায় হাঁটতে বের হলাম। স্বপ্ন সবসময় রুমের ভীতর নিজেকে বন্দি রাখে। বের হতে চায়না। পুকুর ঘাটে এসে সত্যি সত্যি মুগ্ধকে পাওয়া গেলো। কার সাথে জেনো কথা বলছে ছোট্ট একটা টঙে বসে। আমরা আরেকটু কাছাকাছি আসলে উনি কারো উপস্থিতি পেয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। কেটে দেয়ার আগে বললেন - ' একটু পর কথা বলছি। বায় '
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। সৌজন্যতার খাতিরে হেসে বললো-
- আজ দুই বিদেশিনী একসাথে! তাও আমার এখানে! কোনো মতলব আছে নাকি?
আমার মনে হলো উনি আজ ভালো মুড এ আছে। তাই এত খাতির। নাহলে তো কথাই বলে না তেমন। শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভীষণ এক্সাইডেট দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ভার্সিটির সুদর্শন টিচারকে পেয়ে ভাবনার অতল সমুদ্রে গা ভাসাচ্ছে।
শ্রেয়া ভীষণ খুশি খুশি হয়ে বললো-
- কেমন আছেন স্যার? ভালোই আছেন মনে হয়। ভালো থাকাই ভালো স্যার। আমি একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি স্যার। আমাদের ভার্সিটির সবাই খুলছে। একটা ছবি তুলবো আপনার সাথে স্যার। নিচে ক্যাপশন দেবো ' With our new collage teacher Mr. Abrar Mugdho '। ভালো হবে না স্যার?
মুগ্ধ ভ্যাবলার মতো শ্রেয়ার দিকে তাকালো। হায়রে, একটু কথা বলার চান্স পেয়ে একসাথে সব উগরে দিচ্ছে। মনে হয় আর কথা বলতেই দিবো না। মুগ্ধ ভাবনা ছেড়ে টঙ এ দুজনের বসার জায়গা করে দিলো। অতঃপর হালকা হেসে বললো-
- অবশ্যই ভালো হবে। তার আগে তুৃমি এখানে বসো। তবে এতবার স্যার বলা লাগে? একবার বললেই তো হয়।
- জি স্যার। আর হবে না স্যার।
বলেই মন খারাপ করে টঙে বসে পড়লো সে। আমি শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম এই মেয়েটা না বাংলাদেশের মানুষকে ভয় পায়। অথচ স্যারকে দেখেই কেমন সব ভুলে গেলো। আমার কাছে ভীষণ রাগ লাগলো। এত ন্যাকামি করার কি আছে? চারপাশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম। ভীষণ সুন্দর যায়গা। ছোট ছোট কয়েকটা লিচু গাছ আছে। বোধহয় মাঝে মাঝে যত্ন নেয় গাছগুলোর। পুকুরটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম পুকুটা আরো সৌন্দর্যে ভরপুর। পুকুরে মাঝখানে একটা সোডিয়াম লাইট বাঁশের সাহায্যে আটকে রাখা। রাত হলেই জ্বলে উঠবে আর পুকুরটা আলোকিত হয়ে যাবে। দেখে মনে হয় মাছ চাষ করে। আমি মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ফোন চাপছেন মনোযোগ দিয়ে। আর শ্রেয়া বাকা চোখে নজর রাখছেন মুগ্ধর দিকে। আমি মুগ্ধর দিকে দৃষ্টি রেখে বললাম -
- আপনারা পুকুরে মাছ চাষ করেন?
- না করা হয় না। এমনিই অনেক প্রজাতির মাছ আছে। এটা আমার শখ। তবে এখান থেকে মাছ উঠিয়ে আমরা খাই মাঝে মাঝে। রঙ্গিন মাছও আছে কয়েকটা। দেখবেন?
-দেখালে অবশ্যই দেখবো।
কথাটা বলে স্থির হয়ে বসলাম। এক্সাইডেট লাগছে অনেক। মুগ্ধের সাথে রঙিন মাছ দেখবো দাদিমা'র বাড়িতে। তাও আবার ভীনদেশে। অথচ কখনো মনে হয় না এটা ভিন্ন দেশ। মনে হয়, এটাই তো আমার আসল ঠিকানা। আমার বাংলা। আমার এমন কথা শুনে শ্রেয়া খানিকটা তেজ নিয়ে বললো-
- আপনির সাথে স্যার যোগ করতে পারিস না? উনি আমাদের স্যার হয়।
শ্রেয়ার হঠাৎ এমন কথায় লজ্জায় পরে গেলাম। যদিও মুগ্ধ বলেছিলো স্যার না ডাকতে। কিন্তু তাই বলে স্যার ডাকতেই হবে না এমন তো কথা নেই। মুগ্ধ, শ্রেয়ার কথায় টঙ থেকে উঠে বললেন -
- আমি নিজেই মানা করেছিলাম স্যার ডাকতে। তুমিও নাহয় স্যার ডাকিও না। আচ্ছা তোমরা এখানে থাকো, আমি মাছের খাবার নিয়ে আসি। খাবার ছিটিয়ে দিলে একসাথে সব মাছ আসবে। তখন দেখতে পারবো।
বলেই হাটা ধরলেন উনি। আমি শক্তচোখে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছি। এ্যাঁ! ও স্যার ডাকবে না কেন? ডাকলে সমস্যা কি? যত্তসব ঢং।
অতঃপর শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম-
- স্যারকে দেখে পাগল হইছিস নাকি? স্যারকে কেউ এভাবে পিক তুলতে বলে?
- সরি দোস্ত।
------
আমি আজ কয়েকবছর পর লিখতে বসে বুঝতে পারছি কেমন সুন্দর মহুর্ত ছিলো সেসব। সাধারণ একটা স্মার্টফোনে বন্ধুমহলের ছবিধারণ করে দারুণ এক্সাইটমেন্ট এ ফেইসবুকে ছবি আপলোড করতাম। অথচ আজ কুড়িসালে পা দিয়ে বুঝলাম, সময় আসলেই চলে যায়। কোথায় সেই মুগ্ধ স্যার আর কোথায় আমি? শ্রেয়াটাই বা কোথায়? বাংলাদেশে কি ভালো আছে স্বপ্ন? ওকে একবার কলকাতায় নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে।

 


চলবে................

( বিঃদ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

গল্প: বিদেশিনী 

#পর্বঃ০

লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments