Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বিদেশিনী - পর্ব ৮

সন্ধ্যাঁ ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে সিঁদুর রাঙ্গা সুর্যটা উত্তাপ কমিয়ে মিষ্টি হওয়ার ক্রমশ চেষ্টা চেলাচ্ছে। আমি টঙে পা দুলিয়ে সেই সুর্যের পানে তাকিয়ে আছি। তখনই সেখানে উপস্থিত হলো মুগ্ধ। সঙ্গে ছোট্ট একটা প্লাসটিকের বালতিতে মাছের জন্য খাবার দেখতে পেলাম। উনি টঙ এর সামনে এসে খুবই অস্থিরকন্ঠে বললেন-
- দুঃখিত। আসতে একটু দেরী করে ফেললাম। আসলে দাদুর সাথে একটু জরুরী কথা ছিলো। চলুন যাওয়া যাক পুকুর ঘাটে।
আমি কোনো জবাব দিবো না ভাবতে যাবো তার আগেই শ্রেয়া হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বললো-
- না না। একটুও দেরী হয়নি। চলুন যাওয়া যাক।


আমরা টঙ থেকে নেমে সামনে হাটা ধরলাম। তখনি শ্রেয়া আমার কানে কানে বললো-
- দেখছিস দোস্ত। স্যার কিন্তু আমাকে তুমি করে বলে অথচ তোকে দেখ আপনি করে সম্মোধন করলো। তাহলে ভাব!
- কি?
আমি বিরক্ত হলাম ওর কথায়। কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না। এখান থেকে যত তারাতারি সম্ভব ঢাকা চলে যেতে হবে। কিন্তু সেই ঘটনা না জেনে যাই কিভাবে! আমরা পুকুরের কংক্রিটের ঘাটে উপস্থিত হলাম। ঘাটটা ইট সিমেন্টের। তবে প্লাস্টার করা নয়। আমি মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ড্রেস পালটে এসেছেন। এখন গায়ে ব্লাক টিশার্ট আর অফ হোয়াইট জিন্স। উনার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললাম -
- দাদিমা যখন ছিলো। তখন কি এই পুকুটা ছিলো?
-হ্যাঁ। এই পুকুরটার বয়স শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। তবে কিছুদিন আগে বাবা এটাকে নতুনভাবে খনন করে ইট সিমেন্ট দিয়ে বেঁধেছে। আর আমি রঙ্গিন মাছ ছেঁড়েছি। ভালোই লাগে।
-ওহহ
আমরা মাছগুলোকে খাবার ছিটিয়ে দিলাম। সাথে সাথে সবরকমের রঙ্গিন মাছ এসে হাজির। লাল, নীল, হলুদ, বিভিন্ন রঙের মাছ আছে। একটা মাছের গায়ে আবার বিভিন্ন কালারও দেখা যায়। মাছগুলোর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে টঙের দিকে ফিরে আসলাম। শ্রেয়া চলে গেছে একটা জরুরী কল আসায়। আমি ওনার সাথে সেই টঙে বসলাম। ইতোমধ্যে সুর্য লাল বর্ণধারণ করে অস্তগামী। কিছুটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো আশপাশটা। আমি মুগ্ধর দিকে দৃষ্টি রেখে বললাম-
- গতকাল পুরাতন বাড়িটায় যে লোকটাকে সিগারেট ফুঁকতে দেখলাম। উনি কে? আমি জানি আপনি চিনেন। কিন্তু বলতে চাইছেন না কেনো?
উনি আমার প্রশ্নে আমার দিকে দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললেন-
- আমি তো আপনাকে বলেইছিলাম উনি পাগল। তাহলে আবার প্রশ্ন করছেন কেনো?
- প্রশ্ন করার কারণ আছে মি. আবরার মুগ্ধ। উনি আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন কেনো বুঝতেছি না। উনি তো আমাকে চিনেন না।আমার বিশ্বাস আমাকে কখনো দেখতেও পাননি।
আমি প্রশ্ন করে ক্ষান্ত হলাম। তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিকে তাকিয়ে আছি। উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন -
- উনি কিন্তু আমাকে দেখে তেমন রিয়েক্ট করেনি। কারণ পাগলরা চেনা মানুষকে দেখে তেমন রিয়েক্ট করে না। কিন্তু যখন অচেনা কেউ তার সামনে এসে যায়। তখনই কেবল তারা বাজে রিয়েক্ট করে।
- সেটা হলেই ভালো। কিন্তু আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই। আমার মনে হয় উনি আমাকে কিছু বলতে চান। কিন্তু আপনি আর দাদু সেটা বলতে দিচ্ছেন না উনাকে। আপনি দয়া করে কথা বলার সুযোগ করে দিলে খুশি হবো।
- আপনি খুবই জেদী মিস. বিদেশিনী। এত জেদ থাকা ভালো না। সমস্যা নেই, আমি কথা বলিয়ে দেবো। আর আমি, আমার দাদু কিছুই লুকোচ্ছি না। যদিও আপনি সেটাই ভাবছেন।
সাথে সাথে মাগরিবের আযান হলো পাশের মসজিদে। আমি টঙ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যার পর বাইরে না থাকাই ভালো। আমি বিশ্বাস না করলেও অন্তত সম্মান জানালাম। মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম -
- আপনি নামাজ পরতে যান। আর যাওয়ার আগে বলেন যে ইউসুফ দাদুর ডায়েরীটা কোথায়? দাদিমা আমাকে বলেছিলেন তিনি নাকি প্রতিদিন রাতে সারাটাদিনের সকল কার্য লিপি লিখে রাখতেন। আশা করি সেটা আপনাদের কাছেই আছে। ওটা পেলেই আমি চলে যাবো এখান থেকে।
মুগ্ধ হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। বোধহয় আমার কাছ থেকে এমন কঠর বাণী আশা করেননি। আমি ওনার থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। চোখ ভীষণ জ্বলছে। আমি কি করবো, কি জানতে এসেছি, কি নিয়ে ফিরবো কিছুই ভাবতে পারছি না। হতাশার মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
------------
সেদিন রাতে হঠাৎ কি মনে করে বৃদ্ধ হিন্দু শিক্ষক তার ছাত্রদের নিয়ে চলেন গেয়েছিলেন নিজ নিজ বাড়িতে। অপরাজিতা যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় অপরাজিতা আবারো মহসিনকে হাঁক পারলো। মহসিন এসে ফটক খুলে দিয়ে অপরাধীর ন্যায় মুখ করে রইলো। ইউসুফ চলে যাওয়ার পর ভুলবসত ফটক ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছিলো সে। যদিও ইউসুফ ভাবছে অন্য কথা। এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র তো উনি না। অন্য কোনো মতলব নিশ্চই আছে সেই শিক্ষকের। সেদিন রাতটা কাটলো কোনো রকম। কিন্তু যখন সকাল হলো। অপরাজিতার ঘুম ভাঙগো বাইরে কিছু মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে। বাবা এত সকালে কোনো বিচার নিয়ে বসলেন নাকি? বিচারের কথা মনে হতেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করলো তার। সেই শিক্ষক আবার আসেনি তে? আসলে তো নিশ্চই গ্রামবাসীকে নিয়ে এসেছে। এবার তাহলে কি হবে?
অপরাজিতা হন্নে হয়ে বিছানা থেকে দ্রুত গতিতে নেমে বারান্দায় চলে এলো। দোতলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো মানুষের ভীর। অপরাজিতার বাবা মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উনার দুই সহযোগী চিৎকার করে মানুষগুলোকে থামতে বলছে। সেগুলো নিজ চোখে দেখার পর হাত পা কাঁপতে থাকলো অপরাজিতার। গায়ে কোনোরকম ওড়না জরিয়ে ইউসুফের রুমের দিকে দৌড় লাগালো। কিন্তু আর যাওয়া হলো না। মাঝপথে তার মা থামিয়ে দিলো। মায়ের শক্ত কন্ঠস্বর শুনে স্থির হয়ে গেলো অপরাজিতা। মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে দৃষ্টি রাখলো সে। অপরাজিতার মা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
- তোকে নষ্টামি করার জন্য ইউসুফের সাথে মিশতে দিছিলাম? রাখলি তো তোর বাবা মায়ের মানসম্মান?
অপরাজিতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো -
- এমন কিছুই হয়নি মা। তুমি ভুল....
কথা মাঝপথে থামিয়ে দিলো অপরাজিতার মা। তীব্র কন্ঠে বললো-
- আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। তুই রুমের ভীতর চলে যা দ্রুত।
অতঃপর সেকেন্ডখানিক বিরতি নিয়ে আবার বললো-
- পিপিলিকার পাখা গজায় মরবার জন্য সেটা নিশ্চই জানিস? তোকে উড়তে দিয়ে ভুল করছে তোর বাপ। আমি আগেই বলছি মেয়েকে সামলাও। কিন্তু তা আর হলো কই? তার একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আর উনার বন্ধুর ছেলে নাকি অনেক চরিত্রবান। এটাই চরিত্রের নমুনা?
- তুমি ভুল বুঝছো মা। কাল যদি ইউসুফ আমাকে নিতে না আসতো তাহলে হয়তো আরো বড় কোনো বিপদ হতে পারতো। আমি তো এতরাতে আসতেই পারতাম না। যেই ছেলেটা আমার জন্য ঝড়ের রাতে ঝড় উপেক্ষা করে আমাকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে পরেছিলো তার চরিত্র সম্পর্কে এমন মন্তব্য করছো কিভাবে আমি জানি না।
অপরাজিতার মা আরো রেগে গেলেন। অপরাজিতার সামনে দ্রুত এসে, সশব্দে পরপর দুটো থাপ্পর মারলেন। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন-
- তোর কাছ থেকে আমাকে সেসব শিখতে হবে তাইনা? দ্রুত চলে যা চোখের সামনে থেকে।
অপরাজিতা ছলছল চোখে গালে হাত দিয়ে তাঁর মায়ের দিকে তাকালো। সদ্য স্নান করে আসা মায়ের শরীর দিকে যেনো রাগের ফুলকি বেড়োচ্ছে। কপালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাম। অপরাজিতা রাগে, অভিমানে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো। রুমের ভীতর এসে সব কিচু তছনছ করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেসব না করে ক্রমাগত কাঁদতেই থাকলো সে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলো আবার মনে নেই। যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন বেলা দুপুর। বিষন্ন মন হঠাৎ করেই ইউসুফকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠলো। কিন্তু বিচার কি হয়েছে? বাবা কি সিদ্ধান্ত নিলেন কে জানে? অপরাজিতা ক্লান্ত শরীরে ঢুলে ঢুলে দরজার সামনে আসলো। দরজার সামনে এসেই দেখতে পেলো দরজার ভীতরে একটা কাগজ পরে রয়েছে। সাদা কাগজ, সেখানে কিছু লেখা রয়েছে। অপরাজিতা হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারলো এটা ইউসুফের। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পড়লো-
"প্রিয় অপরাজিতা,
আমাকে চলে যেতে হচ্ছে ঢাকা। তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ তাই কঠর কোনো শাস্তির ব্যাবস্থা করেননি। অথচ আমরা কিন্তু কোনো ভুল করিনি, তবুও দেখো এর ফল ভোগ করছি। মাঝে মাঝে পাপ না করেও কিন্তু পাপের ফল ভোগ করতে হয় জানো? জেনে না থাকলে আমাদের পরিস্থিতিটা বুঝে নাও। পরিবারের সবাই চলে যাচ্ছে না, শুধু আমি আর ইয়াসিন একসাথে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে কি করবো বুঝতে পারছি না। পরাশোনা বলতে আমার বই পড়তে শুধু ভালোলাগে। অন্যথায় আর কিছু ভালোলাগে না। আমার দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় তোমার সাথে হাসি, ঠাট্টা, গল্পে আর বই পড়ায়। কিন্তু এখন সব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। খুব বেশিদিনের জন্য না। মাত্র এক বছর, তারপর ফিরে আসবো তোমার কাছে। আগের মতো আড্ডা হবে। দুকাপ চা'য়ে ছাদের মধ্যে তোমার বকবক শুনা হবে। এই বকবকানি'টা আমি কত মিস করবো সেটা হয়তো তুমি বুঝতে পারছো না। আমি তোমার জন্য আমার কিছু প্রিয় বই রেখে যাচ্ছি। ওগুলো মহসিনকে বললেই দিয়ে দেবে। আর পিচ্চুটাকে দেখে রাখিও, এত দুষ্টামি করে ছেলেটা। তোমার সঙ্গ ওর মন ফুরফুরে রাখে। কখনো আমার জন্য মন খারাপ করিও না। আমি ফিরছি অতি শীঘ্রই।
ইতি
তোমার বন্ধু (ইউসুফ)  


চলবে................

( বিঃদ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

গল্প: বিদেশিনী 

#পর্বঃ০৮

লেখনীতে: Rifat Amin

Post a Comment

0 Comments